তেলের নাম নিদ্রাকুসুম।
নিদ্রাকুসুমের সুবাসটা প্রথম মাথায় ঢোকে ক্লাস থ্রীতে। পলেস্তরা খসা প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসরুমে গিয়ে ঢুকলাম। স্কুলে ক্লাস থ্রীতে ভর্তি হয়েছি। প্রথম দিন। ক্লাসরুমে ঢুকতেই অদ্ভুত সুবাসটা নাকে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। ধীরে, কিন্তু খুব গভীরভাবে। সেই সুবাস সরাসরি মগজে ঢুকে গিয়েছিলো সেদিন। কাঁচাপাকা চাপ দাড়িওয়ালা মাঝ বয়সি স্যার বসে আছেন চেয়ারে। পড়নে লম্বা ফতুয়া। তিনি চোখ তুলে তাকালেন, ‘যা তাড়াতাড়ি গিয়া বয়। ক্লাসতো প্রায় শেষ’।
তিনি অতি পরিচিতের মতো কথা বললেন। আমি খানিক অবাক হলেও গুটিগুটি পায়ে গিয়ে পেছনের বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। তিনি তখন পড়াচ্ছিলেন, ‘কমলা ফুলি, কমলা ফুলি, কমলা লেবুর ফুল...’
এই লাইনের পরের বাকী অংশ আর আমার কানে ঢোকেনি। আমার মনে হচ্ছিল স্যারের কথা বলার প্রতিটি ভঙ্গীতে নিদ্রাকুসুমের সুবাস ছড়াচ্ছে। তার হাত নড়ানো, মাথা নড়ানো, বইয়ের পাতা উল্টানো, প্রতিটি মুহূর্তই যেন অদ্ভুত সুবাসময়। আমি সেই সুবাসে ডুবে গেলাম।
এরপর সেই স্কুল ছেড়ে আসার আগে আরও মাস ছয়েক। এই ছয় মাসের প্রতিটি দিন আমি যেন উন্মুখ হয়ে থাকতাম সেই বাংলা স্যারের ক্লাসের জন্য। তিনি ক্লাসরুমে ঢুকতেই আমি চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতাম, ‘আহ! সুবাস!’
মাত্র ছয় মাস। কিন্তু বাকীটা জীবন আমি যেন ওই সুবাস খুঁজে বেড়িয়েছি। স্যারের জমজ দুই ছেলে হাইস্কুলে আমার ক্লাসমেট হয়ে গেল। দুটুকরো রত্ন যেন। ক্লাসে ফার্স্ট-সেকেন্ড, খেলাধুলায় ফার্স্ট-সেকেন্ড, আদব লেহাজেও তাই। গ্রামের বাবা মায়েরা এই দুই ছেলেকে দেখিয়ে বলে, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, হীরার টুকরা পোলা। অগো দুই ভাইয়ের পাও ধুইয়া পানি খা, তাও যদি কিছু শিখস!’
স্যারের চোখভর্তি স্বপ্ন। স্বপ্নের সারথী এই হীরের টুকরো একজোড়া জমজ। তিনি তার সর্বস্ব নিংড়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। স্কুলের বেতনের টাকায় ছেলেদের পড়াশোনার খরচ, সংসারের খরচ চালানো কঠিন। তিনি তাই স্কুল শেষে আমাদের বাড়ির পাশের হাটে মুদি দোকান দেন। সেই দোকানে আলু, পটোল থেকে শুরু করে চাল, আটা, কেরোসিন তেল অবধি পাওয়া যায়। আমি চুপচাপ গিয়ে সেই কেরোসিনের তেলের ড্রামের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। তারপর চোখ বন্ধ করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেই। স্যার দোকানের ভেতরে গদিতে বসে খদ্দেরদের বাজার-সদায় দিচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে টের পাই, কেরোসিনের তীব্র গন্ধ ছাড়িয়ে আমার মস্তিস্ক, আমার নাক, আমার সকল ইন্দ্রিয় সেই অদ্ভুত নিদ্রাকুসুম তেলের সুবাস শুষে নেয়। শরীরের কোষে কোষে যেন ছড়িয়ে যায় সুবাস। কি এক অপার্থিব আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
স্যারের জমজ হীরের টুকরোরা মাধ্যমিক পরীক্ষায় সবাইকে চমকে দিয়ে অসাধারণ রেজাল্ট করলো। সেই স্কুলে তার আগে অত ভালো ফলাফল আর কেউ করেনি! স্যার তার স্বপ্নের সলতেতে যেন নতুন করে আলো জ্বাললেন। আর মাত্র কটা বছর, তার স্বপ্নগুলো সত্য হবে! কষ্টের দিনগুলো আর থাকবে না! কিন্তু সদ্য কলেজে ভর্তি হওয়া দুই জমজের বড় ছেলেটা হঠাৎ প্রেম করে লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললো! এমন বিস্ময়কর ব্যপার ঘটতে পারে তা দশ গ্রামেও কেউ বোধ হয় ভাবে নি! বিনা মেঘে বজ্রপাতের চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা। খবর শুনে স্যার যেন শেকড়সহ উপড়ে গেলেন। তার ঝলমলে মুখখানা কি অদ্ভুতরকম ফ্যাকাসে হয়ে গেল। চোখজোড়া যেন মৃত মাছের চোখের মতন। তিনি আর কারও সাথে কথা বলেন না। কারও সাথেই না। আমি তারপরও সুযোগ পেলেই তার চারপাশে ঘুরঘুর করি। তিনি প্রায়ই বিকটভাবে খেকিয়ে ওঠেন, ‘যা ভাগ! দোকানের সামনে কি!’
আমি দোকানের সামনে থেকে সরে আসি। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করি সেই নিদ্রাকুসুমের অপার্থিব সুবাস যেন আর নেই! কোথাও নেই। হারিয়ে গেছে। নিদ্রাকুসুমের সেই সুবাসের জন্য আমার মন কেমন করে!
এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে যায়। কত কত মাস, বছর! স্যারের সাথে আমার আর দেখা হয় না। তার সেই ছেলের সাথে স্থায়ী বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয় তার। ছেলেটাও আর বাড়ি যায় না। এমনকি ঈদে-কুরবানীতেও না। কোন মুখে যাবে! কিন্তু সে তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে। মাঝে মাঝেই আমাদের ফোন করে লুকিয়ে চুড়িয়ে কাঁদে। নিজেকেই যেন অভিসম্পাত দেয়। কিন্তু তাতে কিছু পাল্টায় না। অনেক দেরী হয়ে গেছে। উচ্চ মাধ্যমিকে দুই ভাইই ভয়াবহ খারাপ রেজাল্ট করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না কেউ! জীবন কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। বাবার যেমন! সন্তানেরও। সীমাহীন স্বপ্নভঙ্গ, অপ্রাপ্তি আর দুর্ভোগ। সম্পর্কগুলো কেমন অচেনা হয়ে যায়! অনেক দূরের! অনেক! যেন এরা কেউ কারো নয়, কখনও ছিলও না। কেউ কাউকে চেনে না।
পরের বছর ছেলেটা চান্স পায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যামেস্ট্রি। ততদিনে তার বউ চলে আসে ঢাকায়। শুরু হয় অদ্ভুত জীবন। সাভারে একরুমের এক ছোট্ট বাসায় তারা সাবলেট থাকে, ছেলেটা টিউশন করে। মেয়েটার বাবা কিছু খরচ দেয়। জীবন চলে যায় জীবনের কিম্ভুত নিয়মে। একদিন হুট করে শুনি ছেলেটা বাবাও হয়েছে। ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হয়েছে তার। কিন্তু নিজের বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না সে। সেই সাহস তার নেই। হয়তো অধিকারও না। কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করে। একদিন সে দাঁড়াবেই বাবার সামনে। বাবার সেই ছোট্ট স্বপ্নময় হীরের টুকরো হয়ে। বাবার সব অতৃপ্তি দূর করবে সে। করবেই।
নাথিং ইজ ঠু লেট ইন লাইফ।
বাবা তখন কি করবে?
মাস্টার্স শেষ হতেই ভালো চাকুরিও পেয়ে গেল ছেলেটা। এবার স্বপ্ন পূরণের পালা! সে ধীরে ধীরে গুছিয়ে ওঠে। ঈদ-কুরবানী, পালা পার্বণে একটু একটু করে বাবার কাছে আসতে চায় সে। তার মনে আছে, ছোট বেলায় গলার দিকটা জুড়ে ঠাশবুনটের গভীর নকশাওয়ালা সিল্কের পাঞ্জাবী কি অসম্ভব পছন্দ ছিল বাবার। একটা দামী আতরের। সুন্দর একটা ছাতা, একজোড়া শতভাগ চামড়ার বাটা জুতো। প্ল্যাস্টিকের কালো জুতো জোড়া পড়তে পড়তে পায়ের দুই পাশে বিশ্রী দাগ বসে গেছে। ভীষণ শীতে তার একখানা কাশ্মীরি চাদরেরও ভারী শখ। একটা নরম তুলোর মতন কম্বল। একটা টেলিভিশনও। রোজ রোজ রাস্তার ধারে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে খবর দেখতে তার ভীষণ অস্বস্তি লাগে। ছেলেটা একটু একটু করে বাবার কাছে যায়। বাবা তার দেয়া চাদর পড়ে স্কুলে যায়, হাটে যায়, পায়ে বাটার চামড়ার জুতো। কিন্তু কোথাও যেন সেই পুরনো সুতো আর জোড়া লাগে না। সব অচেনাই থেকে যায়। ভীষণ অচে না। ছেলেটা আমাকে প্রায়ই ফোন দেয়, তারপর কাঁদে। আমি সেই কান্না শুনি। কান্নার ভেতর কি যেন কি আছে! সেই নিদ্রাকুসুমের সুবাস নয়তো!
না। সেই সুবাস না। ওর কান্না শুনলেই আমার কেবল সেই ক্লাস থ্রী’র প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে। কেরোসিনের ড্রামের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আতিপাতি করে আমার সেই সুবাস খোঁজার কথা মনে পড়ে! আমি সেই স্মৃতিতে ডুবে থেকে সেই সুবাসের জন্য ছটফট করি। ও কেঁদে যায়!
গভীর জলের ভীষণ কান্না।
আমি এবার একটা কাজ করেছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম কাজের একটা। আম্মা আব্বাকে নিয়ে কুয়াকাটা ঘুরে এলাম। প্রতিটি মুহূর্ত তুলনাহীন, আরাধ্য, অবর্ণনীয় অনুভূতির। শব্দের সাধ্য কি তা ছোয়! হঠাৎ গভীর রাতে ফোন, সেই ছেলেটা, ‘দোস্ত, তোদের কুয়াকাটার ছবিগুলা দেখে বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল। আমি সমাধান পেয়ে গেছি দোস্ত, পেয়ে গেছি’।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কি সমাধান?’
ও ভেজা গলায় বলল, ‘অফিসে ছুটির আবেদন করেছি, লম্বা ছুটি। সামনের মাসেই আম্মা আব্বাকে নিয়ে কুয়াকাটা যাব। ওই ঘিঞ্জি বাড়ি, স্কুল ঘর, হাটের মুদি দোকান ছাড়া এই মানুষ দুইটা দুনিয়ার আর কোথাও যায় নাই। এই মানুষ দুইটাকে বিশাল সাগরের পারে ছেড়ে দিয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই। আমি জানি, এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। সব’।
ওর এই কথাটা আমার প্রবলভাবে বিশ্বাস হলো। আমি জানি, দিকভ্রান্ত বিচ্ছিন্ন এই পরিবারটির এমন একটা সময় খুব দরকার। তারা অন্য সেই চেনা মানুষ হয়ে ফিরে আসবে, আসবেই। আবার অন্তহীন স্বপ্ন আর তীব্র ভালোবাসায় ভরে উঠবে প্রবল দহনে পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া ক্লান্ত বুক। বুকের ভেতর।
ও বলল, ‘দোস্ত, সময়তো আর কাটে না, আগামী মাস কবে আসবে?’
আমার কেমন অদ্ভুত ভালোলাগায় বুকের ভেতরটা ডুবে যায়। কি সীমাহীন প্রশান্তি। আমিও অপেক্ষায় থাকি।
সেদিন কাক ভোরে আমার ফোন বাজল। আমি ফোন তুলে দেখি ও। বললাম, কি রে? এতো সকালে?’
ও একটুও কাঁদে না। খুব শান্ত গলায় বলে, 'রাত তিনটায় আব্বা মারা গেছে, আমি বাড়ি যাচ্ছি। আব্বার জন্য দোয়া করিস। রাখি’।
ও ফোন কেটে দেয়। আমি ফোন রাখি না। কানে চেপে ধরে বসে থাকি। আমার হঠাৎ মনে হয়, ভোরের শীতল বাতাস জুড়ে অদ্ভুত এক সুবাস।
এই সুবাস আমি চিনি।
-----------------------------------------------------------------------
চেনা-অচেনা/ সাদাত হোসাইন
২৭.০৩.২০১৪