[এই লেখাটা ক্রিকেট নিয়ে। লেখাটা প্রথম যেদিন লিখি, মনে আছে, লিখতে লিখতে কেঁদে ফেলেছিলাম। আজ লেখাটা আবার পড়ছি, কাঁদছি, কাঁদতে কাঁদতেই লেখাটার শেষের কয়েক লাইন বদলে দিলাম। বদলে দিলাম... ফিসফিস করে বললাম, তোমরা আমাদের নিঃস্ব করতে পারো না, পারো না। আমাদেরতো শুধু এই একটা জিনিসই আছে, আমাদের সকলের, সবার। এই একটা মাত্র জিনিস, তোমরা তা কেড়ে নিতে পারো না, কেউ তা কেড়ে নিতে পারে না। খোদার কসম! কেউ না।]
'১৯৯৭ সাল।
আমাদের বেড়ে ওঠা অঁজপাড়া গায়ে। সেই গায়ে ইলেকট্রিসিটি নেই। পত্রিকা নেই, রেডিও নেই, টেলিভিশন নেই। ভরা বর্ষায় আমরা প্যাচপ্যাচে কাদা মাখা কাঁচা রাস্তায় জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলি। সেই জাম্বুরা ফুটবলে আমরা একেকজন ম্যারাডোনা। কিভাবে কিভাবে যেন ম্যারাডোনার নাম শুনেছিলাম। কেউ ভালো খেললেই আমরা হুটহাট তার নাম দিয়ে দেই ম্যারাডোনা। এমনকি আমাদের বাড়ির পাশের ছালেক, যে কিনা সেই জাম্বুরা ফুটবলেও ছিলো অসাধারণ গোল্লি। (আমরা তখনও জানতাম না গোলপোষ্টের নিচে যে থাকে তাকে গোলকিপার বলা হয়, আমরা গোলকিপারকে বলতাম গোল্লি)।
সেই ছালেককেও আমরা একটা ‘ম্যারাডোনা’ নাম দিয়ে দিলাম, তার নাম হলো- ‘গোল্লি ম্যারাডোনা’!!
সেবার হঠাৎ বাড়ির পাশের কাওসার ভাই ঢাকা থেকে বন্ধু বান্ধব নিয়ে এসেছেন। পিচ্চি এক রেডিও নিয়ে এসেছেন সাথে। সেই রেডিও তিনি কানের কাছ থেকে সরান না। সবসময় কানে চেপে ধরেন। তার বন্ধুরাও। তারা রেডিওতে কিসব শোনেন খোদা মালুম! কিন্তু কাওসার ভাইকে প্রায়ই দেখি রেডিও কানে চেপে ধরে হাটতে হাটতে রাস্তা ছেড়ে খালে নেমে যেতে থাকেন তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। কিছুদিনের মধ্যে দেখি কাওসার ভাই একা হাঁটেন না, তার পিছে পিছে দল বেঁধে ছেলে ছোকড়ারাও হাটে। সেই দল ক্রমশই লম্বা হতে থাকে। গ্রামের মাঠে ফুটবল বাদ দিয়ে প্যাচপ্যাচে কাদার মধ্যেই সেই বড় ভাইয়েরা কিসব খেলা শুরু করেন। সেই খেলায় লাল কসটেপ পেচানো ছোট্ট টেনিস বল, কাঠের তক্তা আর তিনটুকরা গাছের ডাল দরকার। এই খেলার নাম ‘কিরিকেট’। কাওসার ভাই তার দলবল নিয়ে মাঝে মাঝে রেডিও কানে চেপে ধরেই বিকট চিৎকারে বান্দর নাচ নাচতে থাকেন। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করলেই লাল চোখে তাকিয়ে গর্জে ওঠেন, তুম বাচ্চালোগ, দূর হো!!
আমরা বাচ্চা কাচ্চারা বড় বড় চোখে এই বদ্ধ পাগলগুলাকে দেখি। আর মনে মনে ভাবি, 'এইজন্যইতো কয়, পাগলের সুখ মনে মনে'।
কিন্তু আমরা জাম্বুরা ফুটবল রেখে মাঠের পাশে বসে যাই। মাঠে কি এক অদ্ভুত এক খেলা হচ্ছে। সেই খেলার নামও অদ্ভুত- ‘কিরিকেট’।
এই খেলায় নাকি ‘গোল’ নাই, ‘ম্যারাডোনাও’ নাই। বলে কি পাগলগুলা! বললেই হলো নাকি। গোল ছাড়া আবার খেলা হয়!!
সেই অদ্ভুত ‘কিরিকেট’ আমরা বুঝি না। তারপরও মাঠের পাশে ঝিম মেরে বসে থাকি। যখন কাউকে আউট করে তারা লাফালাফি করে, আমরাও তখন তাদের সাথে তাল মিলিয়ে লাফাই, আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করি, ‘গোল হইছে গোল, গোওওওল! গোওওওল!!’ কেউ চার ছক্কা মারলেও আমরা গোওওল, গোওওওল বলে চেচাই। আর বলি, ‘দেখছত, পোলাডা এক্কেলে ম্যরাডোনার লাহান খেলায়!”
সেবার আব্বা ঢাকা থেকে আসার সময় ইয়া বড় এক সনি টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসলেন। সেই টেপ রেকর্ডার চালাতে হলে ছয়-ছয়টা ব্যাটারি দরকার। গাবদা গাবদা এককেটা অলেম্পিক ব্যাটারির দাম তখন ১০ টাকা। ষাট টাকার ব্যাটারি কিনে সেই টেপ রেকর্ডার আর চালানো হয় না। আম্মা নিজের হাতে সেলাই করে টেপরেকর্ডারের জন্য ফুলতোলা কভার বানান। আমরা টেপরেকর্ডারে গান শোনার বদলে নিয়ম করে দুবেলা সেই ফুলতোলা কভার সরিয়ে টেপরেকর্ডার দেখি। কখনো কখনো আম্মার চোখ এড়িয়ে টেপ রেকর্ডারে কান চেপে ধরে বসে থাকি, যদি গান-বাদ্য কিছু শোনা যায় মন্দ কি!
ততদিনে আমরা একটু আধটু ‘কিরিকেট’ খেলা শিখে গেছি। আইসিসি ট্রফির গুরুত্বপূর্ণ খেলা শুরু হয়েছে। চায়ের দোকানে, স্কুলের বারান্দায়, খেলার মাঠে টুকটাক আলোচনা কানে আসে। এই খেলায় জিতলে নাকি বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলতে পারবে। আমাদের তখন ‘বাপরে বাপ বিশ্বকাপ’ অবস্থা!!
বাজারে নিখিল হালদার নামে এক হিন্দু দর্জি ছিলেন। তার দোকানে বড় একটা রেডিও ছিলো, সেই রেডিওতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকজন খেলার ধারাবিবরণী শুনতো। লোকের যখন ভীড় জমে যেত তখন টুক করে রেডিওটা বন্ধ করে দিত নিখিল। গ্রামের থুত্থুরে বুড়ো, স্কুলের মাস্টার, করাতকলের শ্রমিক, আমাদের খেয়া নৌকার মাঝি মন্টু ভাইও খেয়া পারাপার বাদ দিয়ে কান খাড়া করে বসে থাকে নিখিলের দোকানে। এরা যে খুব কিরিকেট বোঝে, মোটেই তা না। এরা যেটা বোঝে সেটা হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশ বিশ্বকাপ খেলবে! বাপরে বাপ! কি সব্বনেশে কথা!!
সমস্যাটা হলো আসল দিন। আইসিসি ট্রফির কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হয়েছে। হল্যান্ডের সাথে সেই স্নায়ুক্ষয়ি মহাকাব্যিক ম্যাচ। কিন্তু নিখিলের দোকান বন্ধ। কোন খোঁজ খবর নাই তার। নিখিলের দোকানের সামনে ভীর ক্রমশ বেড়েই চলছে। আমাদের গোল্লি ম্যারাডোনা ছালেকের পা ভেঙেছে গত পরশু। খেলতে গিয়ে পা ভাঙার শাস্তি ভয়াবহ। কাজ কাম যাদের নাই, তারাই বসে বসে আকাম করে। খেলাধূলা আকাম ছাড়া কিছুই না। সুতরাং আকাম করে যে পা ভেঙেছে, তার আর সেই পায়ের দরকার কি? ছালেকের বাবা কাদের মিস্ত্রী কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। তিনি পা ভাঙা গোল্লি ম্যারাডোনাকে আচ্ছা মতো পিটিয়েছেন। আমি নিখিলের দোকানে আসার সময় দেখে এসেছি, ছালেকের ব্যান্ডেজ করা পা উঁচু করে বাঁধা। সে সেই পায়ের ব্যাথায় কো কো করে আমার দিকে করুণ চোখে তাকাচ্ছে। আমি তার দু:খ আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিলাম, ‘ওই গোল্লি, খেলা দেখতে যাবি না? বাজারেতো টেলিভিশন আনছে। আইজ বড় খেলা হের লাইগ্যা টেলিভিশনে দেখাইবো।’ গোল্লি ম্যারাডোনা কাতর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি তিড়িং বিড়িং বাজারের দিকে ছুটি।
কিন্তু ঘটনাতো খারাপ। টেলিভিশন দূরে থাক, নিখিল না থাকলেতো রেডিও-ই চলবে না। উপায়? লোকজন বাড়তে বাড়তে বাজারে উত্তরপাশটা টই টম্বুর। ছোটনের চায়ের দোকানের সামনে দেখি বাপের কাঁধে চড়ে ভাঙা পায়ের গোল্লি ম্যারাডোনা চলে এসেছে। আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছি! ঘটনা কি!।
আমাকে দেখে সুযোগ বুঝে চোখ টিপে দিল সে। কিন্তু কিরিকেট? গ্রামেতো আর কারো বড় রেডিও নাই যে উচ্চ ভলিউমে সবাই একসাথে খেলা শুনতে পারবে! তরতর করে সময় বয়ে যাচ্ছে। কাওসার ভাই তার পিচ্চি রেডিও নিয়ে স্কুলের ছাদে উঠে গেছেন। তিনি কানে চেপে ধরে খেলা শোনেন আর কিছুক্ষণ পর ভ্যা ভ্যা করে আকাশ বাতাস ফটিয়ে চিৎকার করেন। সবাই সমস্বরে জানতে চায়, ও কায়সার, কি হইছে? বাংলাদেশ বিশ্বকাপ পাইছে? কাওসার ভাই জবাব দেন না। রেডিও কানে চেপে দাঁড়িয়ে থাকেন। আর খানিক পরপর তিড়িং বিড়িং নাচেন।
মজিদ ফকির নামে আমাদের এক চাচা আছেন। দু:সম্পর্কের চাচা। আমুদ-ফূর্তির মানুষ। হাটবাজারে গান গেয়ে ওষুধ বিক্রি করেন। প্রতি হাটবারে আমাদের বাড়ি আসেন, তার গানের যন্ত্রপাতি আমাদের বাড়িতে রেখে যান। সেই ভীড়ের মধ্যে আমাকে দেখে মজিদ চাচা হঠাৎ রে রে করে তেড়ে আসেন, ‘ওই ছেমড়া, তোর বাহে (বাপে) না একটা বড় টেনডেষ্টার (ট্রানজিষ্টার-রেডিও) আনছে, হেইডা কই?’
-হেইডাতো ঘরে কাকা।
-কস কি ছেমড়া!!
মুহুর্তেই বাতাসে ছড়িয়ে গেল সংবাদ। মজিদ কাকা তার বৃদ্ধ শরীর নিয়ে বাতাসের বেগে ছুটলেন। আম্মা কাদা মাটি দিয়ে ঘর লেপছিলেন। মজিদ কাকা গিয়ে আম্মার হাতে পায়ে ধরা শুরু করলেন। আম্মা রাজিও হলেন, কিন্তু তার কিছু শর্ত আছে, প্রথমত, ব্যাটারী কিনে দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, টেপরেকর্ডার ঘর থেকে বের করা যাবে না। উচ্চ ভলিউমে টেপরেকর্ডার ঘরেই থাকবে। বাইরে কাঠালতলায় বসে সবাই খেলা শুনবে। মুহুর্তেই কাঠাল তলায় পাটি বিছানো হলো, চটের বস্তা। সবাই চাঁদা তুলে বাজার থেকে ব্যাটারী নিয়ে এলো।
রেডিওর ভেতর থেকে ইথারে গমগম শব্দে ভেসে উঠলো চৌধুরি জাফরুল্লাহ শারাফতের গলা, ‘মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠ থেকে আমি চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফত আপনাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।’
মুহুর্তে নি:শব্দ হয়ে গেলো প্রতিটি মানুষ। বাঁশের বেড়ার ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছে সেই গমগমে শব্দ। সেই গমগমে শব্দের, ভাষার প্রায় কিছুই বোঝেন না বাইরে বসে থাকা এই মানুষগুলো, তারপরও তারা কান খাড়া করে বসে আছেন। তারা লং অন বোঝেন না, লং অফ বোঝেন না, এলবিডব্লিউ বোঝেন না, রান আউট বোঝেন না কিন্তু বাংলাদেশ বোঝেন। আকরাম, নান্নু, বুলবুল, শান্ত, রফিক বোঝেন। এই নামগুলো তাদের ঘরের নাম, সন্তানের নাম, ভাইয়ের নাম, বন্ধুর নাম। অতি আপন চেনা নাম। কাওসার ভাই বাড়ি থেকে চেয়ার এনে সবার মাঝখানে বসে পড়েছেন। তিনি চিৎকার করলে সবাই একযোগে চিৎকার করে ওঠেন। তিনি হঠাৎ চুপ করে গেলে সবাই তার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। সত্তরোর্ধ আলিম বেপারীর চোখের কোণায় জল উঁকি মারে।
জাফরুল্লাহ শারাফত বলেন, বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য মহাবিপদ।
কাওসার ভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ান, আবার বসেন, চেয়ারের উপর ওঠেন। মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠের বাঙালীরা নিজেদের গায়ের জামা খুলে মাঠের পানিতে চুবিয়ে সেই পানি চুপচুপে জামা মাঠের বাইরে নিয়ে পানি চিপে ফেলে আবার দৌড়ে মাঠে চলে আসেন। মাঠ যে করেই হোক শুকাতে হবে। বাংলাদেশকে জিততে হবে। জিততেই হবে। কাঠালতলায় বসে থাকা লোকগুলোর মুখ বিড়বিড় করতে থাকে। সেই বিড়বিড় করা মুখের ফাঁক দিয়ে ফিস ফিস শব্দ আসে, ‘আল্লাহ, রহম করোগো আল্লাহ। ওগো দয়াময়।’
তারপর উৎকণ্ঠা, তারপর সময়, তারপর আকরাম খান, তারপর ছক্কা, তারপর চার। তারপর জয়।
তারপর ইতিহাস। তারপর বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!! বাংলাদেশ!!!
চৌধুরী জাফরুল্লাহ শারাফত কথা বলতে পারেন না। মাইক্রোফোনের সামনে তার ভরাট গমগমে গলা হঠাৎ ভেঙে পড়ে। তিনি ভ্যাভ্যা করে পাশের বাড়ির তালেবের মায়ের মতো আকাশ ফাটিয়ে কেঁদে ফেলেন। তার কোন কথা শোনা যায় না। কেবল তার ভ্যাভ্যা কান্নার ভেতর থেকে শোনা যায় বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!! বাংলাদেশ!!!
বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে তার সেই ভ্যা ভ্যা কান্নার শব্দ তখন ঝর্ণার গান, সুমধুর তান, উন্মাতাল প্রাণ।
কাওসার ভাই বসা থেকে দাঁড়ান, চেয়ারের ওপর ওঠেন, তিনি বাদরের মতো লাফাতে থাকেন, তার লুঙ্গি খুলে পড়ে যায়, তিনি লাফাতেই থাকেন, তার ফ্যাসফেসে গলা ফ্যাসফ্যাস করতে থাকে, ‘বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। মজিদ ফকির দাঁড়িয়ে অসময়ে আজান দিয়ে ফেলেন, আল্লাহু আকবার! আল্লাহু আকবার!!
আলিম বেপারীর খনখনে গলা, কাদের মিস্ত্রির বাঁজখাই চিৎকার, পা ভাঙা গোল্লু ম্যারাডোনার পা নাচিয়ে নর্তন, কাদা মাখা শরীরে আমার মায়ের গগন বিদারী চিৎকার, কান্না সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সেই কান্নার জল ভর্তি আনন্দ। মহা আনন্দ।
সেই কান্নার ফোটাফোটা জলে ভাসা, জলের ভাষা বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!!
প্রিয় ক্রিকেট বোর্ড,
আমরা কেবল একটু বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে চিৎকার করতে চাই, আমরা শুধু বলতে চাই, ভালোবাসি, ভালোবাসি বাংলাদেশ! ভালোবাসি! ভালোবাসি!! আমাদের আর কোন চাওয়া নেই। একটু কাঁদতে চাই। ছয় মাসে-নয় মাসে সবাই মিলে একটু গলায় গলা জড়িয়ে কাঁদতে চাই। যেই কান্না এদেশের ষোল কোটি মানুষ একসাথে কাঁদবার সুযোগ কেবল এই একবারই পায়। যেই কান্নায় কেবল সুখ, কেবল অনন্দ, কেবল শান্তি, কেবল ঝকঝকে নীলাকাশে পাখিদের মতো ডানা মেলে বাধ ভাঙ্গা উড়ে যাওয়া। যেই কান্নায় আমাদের আর সকল কান্নার কষ্ট, সকল না পাওয়া, সব যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ডুবে যায়। আমাদের এই কান্নাটা কেড়ে নিবেন না। কাউকে কেড়ে নিতে দিবেন না। না ইন্ডিয়া, না অস্ট্রেলিয়া, না ইংল্যান্ড, কাউকে না। আপনারা মাথা নোয়াবেন না। এই ষোল কোটি মানুষের হাড় জিরজিরে শরীরে যে বিশাল হৃদয় আছে, সেই হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা, সবটুকু সাহস, সবটুকু সম্বল নিয়ে আমরা আপনাদের পাশে থাকব! ষোল কোটি মানুষ! আমরা প্রয়োজনে আবার রাজপথে নামবো, প্রয়োজনে একবেলা কম খাব, প্রয়োজনে প্রিয়জনের মোবাইল ফোনে একবার কম ফোন দিব, তবু টাকার ব্যাবসায়, লোভের বানিজ্যে ক্রিকেটকে বিকিয়ে দিবেন না প্লিজ, উই নো, উই হ্যাভ দ্যাট গাটস টু সেভ আওয়ার ক্রিকেট, মেক অ্যা বিগার মার্কেট ফর ক্রিকেট হিয়ার! উই নো, বাট ইউ উইল হ্যাভ টু নো। মাথা নোয়াবেন না। মাথা নোয়াবেন না। মাথা উঁচু করুন! এদেশের অজস্র আলিম বেপারীর মতো, মজিদ ফকির, কাদের মিস্ত্রীর মতো, খেয়া নৌকার মাঝি মণ্টু ভাইয়ের মতো মানুষেরা বুকের গভীরে এই দেশটাকে যত্ন করে পুষে রেখেছে, পুষে রেখেছে ক্রিকেটকেও। আপনিও রাখুন।
এই ক্রিকেটকে কেড়ে নেবেন না, এই বাংলাদেশকে কেড়ে নেবেন না। কাউকে কেড়ে নিতে দেবেন না। আপনারা দিলেও আমরা দিব না। ওই অসংখ্য আলিম বেপারীর, মজিদ ফকির, কাদের মিস্ত্রী, খেয়া নৌকার মাঝি মণ্টু ভাইয়ের মতো মানুষেরাও দেবে না। দেবে না।
মনে রাখবেন, ক্রিকেট মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই ক্রিকেট।
এই ক্রিকেটকেটকে বেঁচে দেবেন না, বাংলাদেশকে বেঁচে দেবেন না!
প্রিয় ক্রিকেট বোর্ড যে সংবাদ টা আজ আমরা দেখলাম, আমরা জানি না কি হয়েছে। আপনারা কি ভাবছেন আমরা জানি না, কেন ভাবছেন তাও জানি না,, কে ভাবতে বাধ্য করিয়েছে তাও না! আমরা কিছুই জানতে চাই না। আমরা বিশ্বাসও করতে চাই না। আমাদের কিচ্ছু বলারও নেই, কিচ্ছু না। আমরা রাজনীতি বুঝি না, অর্থনীতি বুঝি না, কূটনীতি বুঝি না, এইসব কঠিন কঠিন জিনিস আমরা বুঝতেও চাই না। আমরা শুধু এইটুকু বুঝি, আমাদের এই ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নাই, কিচ্ছু না, কিচ্ছু না! আমরা এম্নিতেই সব হারিয়ে নিঃস্ব, শুধু এই খেলাটাকে আঁকড়ে ধরে আমরা একটু হাসি, চোখ ভরে ইচ্ছে মতো জল ফেলি, সেই জলভর্তি আনন্দ, সেই জলভর্তি উচ্ছ্বাস, আমরা ছেড়া জামা গায়ে, ভুখা উদরে, হাড় জিরজিরে শরীরে, এই ক্রিকেটের জন্যই আকাশ বাতাস কাপিয়ে আওয়াজ তুলি, বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!! বাংলাদেশ!!!'
এই বাংলাদেশকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না, খোদার কসম, কেউ না, কেউ না...
------------------
সাদাত হোসাইন/ ২৪,০১,২০১৪