অধ্যায় - চার
চোখ মেলার পর প্রথমে ফারহান বুঝতে পারছিল না যে সে এখন কোথায় আছে। ঘুমটার কারণে আগের দিনের ক্লান্তবোধটা এখন আর নেই তার। ঘুমটা উপকারেই এসেছে। কিন্তু এমন অদ্ভুত জায়গায় কেন সে? হুট করেই মনে পড়লো গত রাতে মিস্টার টাটার দেওয়া মিশনের কথা। ধীরে ধীরে মাথাটা উঁচু করলো। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। সে এখন মাঝনদীতে এক নৌকায় ভাসছে। নৌকাতে মাঝিও নেই। ভাগ্য ভাল তার – শুষ্ক মৌসুম বলে নদীর পানি কম, তাই ডুবে মরতে হয়নি। আর, যে নদীতে আছে সেটাকে নদী বলতেও কিছুটা দ্বিধা হচ্ছে। অনেকটা প্রশস্ত এক নালার মত। নদীটাকে চিনতে পারছে সে। ব্রহ্মপূত্র নদী। সে এখন ময়মনসিংহেই আছে।
রাতে চোখ বন্ধ অবস্থায় আন্দাজে ঠিকই বুঝেছিল সে। তবু একটা সংশয় ছিল। কিন্তু এখন একদম নিশ্চিত যে ময়মনসিংহেই আছে। মিস্টার টাটার প্রশংসা না করে পারছে না। নিজের অবস্থান লুকানো জন্য সব রকম প্রচেষ্টাই করেছে। কিন্তু শেষমেশ ফাঁস বোধহয় হয়েই গেল লোকটার গোপনীয়তা। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সময় দেখলো। সকাল আটটা। মাঝখানে পাঁচঘন্টা ঘুমিয়েই কাঁটিয়ে দিয়েছে? হাতে সময় আছে আর মাত্র ষোল ঘন্টা।
আল্টিমেটামের কথা মনে পড়তেই নিমমির কথা মনে পড়লো ফারহানের। মেয়েটা নিশ্চিত ভাবেই খুব দুঃশ্চিন্তায় আছে তার জন্য। দুঃশ্চিন্তার থেকে বড় কথা। মেয়েটা কি নিরাপদে আছে? মোবাইল দিয়ে ফোন করতে গিয়ে দেখে – তার সিমটা নেই মোবাইলে। সত্যি বলতে মোবাইলে কোন সিমই নেই। মোবাইলটা এখন শুধুই ঘড়িতে পরিণত হয়ে আছে। রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ফারহানের।
মিস্টার টাটার কাজের আগামাথার কিছুই বুঝতে পারছে না। মোবাইল থেকে সিম খুলে রাখলে তৈমুরকে পাওয়ার পর সেটা জানাবে কীভাবে? তৈমুরকে কোথায় পৌছে দিতে হবে সেটাও বলে দেয়নি তাকে। তারমানে ফারহানের গতিবিধির উপরও নজর রাখা হচ্ছে। কিন্তু এই মাঝনদীতে কীভাবে বুঝবে তার উপর কে নজর রাখছে? তীরে ভেড়ানো দরকার। উঠে গিয়ে বৈঠাটা হাতে নিল ফারহান। বৈঠার কাছেই একটা বড় খাম রাখা আছে। খামে কী আছে আন্দাজ করতে পারছে সে। তবে আগে তীরের দিকে নৌকাটা ভিড়িয়ে নিল। নৌকা থেকে নেমে প্রথমে আশে পাশের কেউ তার উপর নজর রাখছে কিনা দেখে নিচ্ছে। সন্দেহজনক কাউকে চোখে পড়ছে না। এই সকালে মানুষ কম। কেউ নজর রাখলে সহজেই তার চোখে পড়ার কথা। যেহেতু এমন কেউ নেই তারমানে তার উপর নজর রাখা হচ্ছে না। তবুও সে নিশ্চিত ভাবে কিছুই ভাবতে পারছে না।
রাতের পর থেকে ঘটনাগুলো এমনভাবে অদ্ভুতভাবে ঘটছে যে সে কোন কিছুই মিলাতে পারছে না। হুট করে তাকে ধরে নিয়ে আসা হল। এমন এক মিশন দিল যেটা তিন বছরে কেউ করতে পারেনি। সেটা তাকে করতে হবে একুশ ঘন্টার মাঝে। সেই একুশ ঘন্টার আবার পাঁচ ঘন্টা তারাই নষ্ট করে দিল। তার মাঝে তাকে ছেড়ে দিল মাঝ নদীতে। সেখান থেকে উঠে এসে এখন সে বসে আছে ময়মনসিংহ জয়নুল আবেদীন পার্কের বেঞ্চে। কোন কিছুর সাথে কোন কিছু মিলছে না। আবার সাথে সাথে যোগাযোগের সব পথও বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। সে জানেনা কোন ঠিকানাও। নদী দেখে প্রথমে ভেবেছিল মিস্টার টাটা ময়মনসিংহেই আছে। মাঝখানে পাঁচ ঘন্টা তো আর নিশ্চয় তাকে নদীতেই ফেলে রাখেনি। আসলেই কি রাতে সে ময়মনসিংহে এসেছিল, নাকি বেশি খেয়াল রাখতে গিয়ে উল্টোপাল্টা লাগিয়ে ফেলেছে? রাতের রাস্তায় পাঁচ ঘন্টায় অনেক দূরত্বই তো অতিক্রম করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তাকে এখানে এনেই ছেড়েছে কেন? এমন অদ্ভুত অবস্থায় সে আগে কখনো পড়েনি।
তার মনে হচ্ছে সে কোন স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু হাতের খামটা প্রমাণ দিচ্ছে যে এটা স্বপ্ন না। সে জানে খামের ভিতর তৈমুরের ছবিটা আছে। রাতে তাকে যতটুকু বলা হয়েছিল, মিস্টার টাটার লোক তৈমুরকে দেখে ছবি তুলে নিয়েছিল। ছবিটা খুলে দেখলো ফারহান। একটু দূর থেকে হলেও তৈমুরের চেহারাটা পরিষ্কার ভাবেই বুঝা যাচ্ছে। জায়গাটাকেও বুঝা যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে নালার মত নদীটাকেও বুঝা যাচ্ছে। তাকে এই জায়গায় ফেলে যাওয়ার কারণ এখন বুঝতে পারলো ফারহান। এই নদী তীরেই সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল তৈমুরকে। ছবিটা আবারো দেখা শুরু করলো ফারহান। এবার একটু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। একটা টেবিলের সামনে বসে আছে তৈমুর। টেবিলে তার সাথে আরো দুইজনকে দেখা যাচ্ছে। তাদের একজন মহিলা, অন্যজন পুরুষ। তবে তাদের চেহারা দেখতে পারছে না সে। ক্যামেরার লেন্সের উলটো পাশে ছিল তারা। তাদের সামনে খাবারের প্লেটও আছে। তারমানে কোন রেস্টুরেন্টের টেবিলে আছে তারা।
ফারহান নিজেও এখন একটা রেস্টুরেন্টের সামনে বসে আছে। তবে এটার অবস্থানের সাথে ছবির অবস্থানটা মিলছে। নদী তীরবর্তী আরেকটা রেস্টুরেন্ট এখান গড়ে উঠেছে বলে শুনেছে ফারহান। পার্কের একদম শুরুর মাথায়ই নাকি অবস্থিত ওটা। ফারহান ধারণা করলো তারা ওটাতেই ছিল।
কিন্তু এতেও তো আসলে কিছু বুঝা যাচ্ছে না। এখান থেকে তৈমুরকে খুঁজে বের করবে কীভাবে? তৈমুর এখানকার স্থানীয় না। কাউকে বললেও তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। শুধু মাত্র টেবিলে থাকা অন্য দুই মানুষই তা বলতে পারবে। কিন্তু তাদের চেহারাও তো দেখা যাচ্ছে না ছবিতে। সব মিলিয়ে শূণ্যতেই পড়ে আছে ফারহান।
ছবিটার দিকে তাকিয়েই আছে। কিন্তু কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই চোখে পড়ছে না। হতাশ হয়ে ছবিটা খামে ঢুকিয়ে রাখতে যাবে এমন সময়ই আরেকটা চেহারা নজরে পড়লো তার। তৈমুরের মত একটা এই মানুষটার চেহারাও একদম পরিষ্কার ভাবেই ফুঁটে আছে। চেহারাটা এক বাচ্চা মেয়ের বলেই আগে নজরে পড়েনি তার। ছবিটার অর্থ এখন পরিষ্কার বুঝতে পারছে ফারহান। এখানে একটা পরিবারের সাথে দেখা করতে এসেছিল তৈমুর। মেয়েটা ঐ দম্পতিরই। এই দম্পতিকে খুঁজে পেলেই তৈমুরকে খুঁজে পাওয়া যাবে। দম্পতিটাকে খুঁজে বের করতে হবে সাহায্য করবে বাচ্চা মেয়েটাই।
মোটামুটি সমাধান করে ফেলেছে। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটাকে খুঁজে পাবে কী করে? ছবিটার দিকে তাকাতেই উত্তরটা পেয়ে গেল ফারহান। বাচ্চাটা স্কুল ড্রেস পড়া। জামাটা কালচে সবুজ রঙের। ছবির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরো কিছু বাচ্চার গায়েও একই পোশাক। এটা যে আসলেই স্কুল ড্রেস তার প্রমাণ এটাই।
ছবিটা থেকে আরো কিছু সূত্র খুঁজে পেল ফারহান। বাচ্চাগুলোই তাকে খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। গাছগাছাড়ির ছায়া থাকায় দিনের অবস্থা ঠিকভাবে বুঝা না গেলেও পিছনের নদীর উপর রোদের উজ্জলতা দেখে বুঝতে পারছে যে সময়টা দুপুরের কাছাকাছি হবে। স্কুল ড্রেস পড়া বাচ্চাদের উপস্থিতিও তারই প্রমাণ দিচ্ছে। স্কুল ছুটির পরই তো তারা পার্কে এসেছে। আরো একটা ব্যাপার স্কুলটা পার্কের খুব কাছেই। সে জন্যেই স্কুল ছুটির পার্কে এসেছে তারা। নাহলে দুপুরের দিকে স্কুল ড্রেস পড়িয়ে কোন বাচ্চাকে তার বাবা-মা পার্কে নিয়ে আসবে না। কাছে দেখেই নিয়ে এসেছে।
অনেকটাই সমাধান হয়ে এসেছে। এখন শুধু স্কুলটা খুঁজে পাওয়ার পালা।
এই কাজটাই সবচেয়ে কঠিন। কারণ, পার্কের আশেপাশে স্কুলের সংখ্যাও খুব কম না। ড্রেসকোডও বেশ কয়েকটার একই রকম। তার মত একজন অপরিচিত মানুষের পক্ষে একদম ঠিকঠাক ভাবে খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। যথেষ্ট সময় সাধ্যও। তবুও একটা প্ল্যান ঠিক করে নিল। স্কুলের অন্যান্য বাচ্চাদের কাউকে এই মেয়েটার ছবি দেখিয়ে নাম ও শ্রেণীটা জেনে নিবে। তারপর জরুরী কোন কারণ দেখিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের থেকে মেয়েটার ঠিকানা নিয়ে নিবে।
পরিকল্পনা ঠিক করে উঠে দাঁড়ালো ফারহান। হাতে সময় খুব বেশি নেই। যতদ্রুত সম্ভব কাজ সারতে হবে। রাস্তা ধরে একটু এগুনোর পরই পিছন থেকে ডাক শুনতে পেল।
‘কই যাইবেন, ভাইজান?’
ঘুরে তাকিয়ে দেখে এক রিকশাওয়ালা ছেলে তাকে ডেকে থামিয়েছে। রিকশাটা দেখেই ফারহানের মনে পড়লো শহরের ভিতর যাতায়াত করার জন্য তার কোন ট্রান্সপোর্টেশন নেই। ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে যে এই দিকটা তার মাথায়ই ছিল না। সময় বাঁচাতে হলে কোন না কোন নির্দিষ্ট যানবাহন তার লাগবেই। সেক্ষেত্রে একটা রিকশাই ভাল হবে। কারো সন্দেহও হবে না এতে, যানজটের মাঝে পড়লেও অলিগলি দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারবে। যদিও সে ভেবে একটু অবাক হচ্ছে যে, মিস্টার টাটা কেন তার সাথে সবরকমের সাহায্য দেননি? অবশ্য কারণটা অজানা না তার। সব সাহায্য দিলে সে মিশন ত্যাগ করে পালাতে পারে বা এতে করে মিস্টার টাটার গুমরও ফাঁস হয়ে যেতে পারে। অবশ্যই বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ। তবুও, যেখানে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে তৈমুরকে খুঁজে বের উনার জন্যই বেশি জরুরী, সেখানে বারবার কেন তার গতি শ্লথ করে দেওয়া হচ্ছে?
‘হ্যাঁ, এদিকে একটা স্কুলে যাবো।’ ভেবে সময় নষ্ট না করে রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল ফারহান।
‘কুন ইস্কুলে যাইবেন? এইনে তো অনেকগুলা ইস্কুল আছে।’ রিকশাওয়ালার কন্ঠে ময়মনসিংহের টান একদম স্পষ্ট।
ফারহান রিকশাওয়ালাকে পরখ করে দেখছে। একে বিশ্বাস করা যায় কিনা বুঝার চেষ্টা করছে। সরল চেহারার ছেলেটাকে ছবিটা দেখালে হয়তো স্কুলটা সহজেই চিহ্নিত করতে পারবে। এতে সময়টাও কিছুটা বাঁচবে তার।
‘নাম তো জানিনা। তবে দাঁড়াও,’ বলে ছবিটা বের করে দেখালো। ‘এই ইউনিফর্মের স্কুলটায় যাবো। চেনো এটা?’
রিকশাওয়ালা চোখ কুঁচকে একবার দেখলো ছবিটা। ‘ও, এইডা? কাছেই আছে এইডা। উডুইন।’
যাক, স্বল্প সময়ের অনেকটাই বেঁচে গেছে তার।
‘নাম কি তোমার?’ রিকশায় উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করলো ফারহান।
‘জয়নাল।’ ফারহান উঠতেই রিকশায় প্যাডেল দেওয়া শুরু করলো সে।
‘রিকশা কি শুধু এই এরিয়াতেই চালাও?’
‘না, পুরা শহরেই ঘুরি। সহালে এইদিকে থাহি। অইন্য রিশকা তহন কম থাহে, ক্ষেপ মারুন যায় ভালা।’
‘শহর তো তাহলে ভাল করেই চিনো মনে হচ্ছে।’
‘এক্কেরে হাতের উল্ডা তালুর লাহান। ক্যারে ঘুরবাইন নাহি শহরের পুরাডা?’
‘এখনো জানিনা। তবে লাগতে পারে হয়তো। তোমাকে সারাদিনের জন্য ভাড়া করলাম আমি। আমার হয়ে কাজ করতে হবে। একটু রিস্ক হয়তো আছে। তবে মোটা টাকা পাবে কাজ শেষে।’ কন্ঠে আভিজাত্য ভাব এনে বলার চেষ্টা করলো ফারহান। মিনমিনে সুরে বললে হয়তো রাজি হবে না রিকশাওয়ালা। আর আশেপাশে অন্য রিকশাও নেই যে ওটাকে ঠিক করবে। ব্যস্ত রাস্তার অন্যান্য রিকশাওয়ালারা হয়তো তার প্রস্তাবে রাজিও হবে না।
প্রস্তাবটা শুনে ভ্রু-কুঁচকে পিছনে তাকালো জয়নাল। বুঝতে চেষ্টা করছে লোকটা কি আসলেই সত্যটা বলছে নাকি মজা নিচ্ছে! ফারহানের চেহারার দৃঢ়তা দেখে বুঝলো যে না লোকটা মজা নিচ্ছে না।
‘ভাইজান কি ডিবির লুক?’
‘হাহাহা। এই প্রশ্ন কেন?’ শুনে একটু চমকে গেলেও, জয়নালের সরলতাকে ধন্যবাদ দিল মনে মনে। এই একটা ছদ্মবেশে থাকলে তার কাজ আসলেই অনেকটা সহজ হয়ে যাবে। তার মাথায় আগে বুদ্ধিটা আসেনি বলে নিজেকেই গাল দিচ্ছে মনে মনে।
‘কতা বার্তা হুইন্না মনে অইলো। ছবি দেহাইলাইন ইস্কুল চিনুনের লাইগা। হারাদিনের লাইজ্ঞা ভাড়া করলাইন আমারে। এইরাম তো ডিবির লুকরাই করে।’
‘হাহাহা! ওরকমই কিছু ধরে নাও। তবে, আসল পরিচয়টা তোমাকে বলতে পারছিনা। আন্ডারকভার হিসেবে আছি।’
‘আফনেগো গাড়ি নাই? রিশকা দিয়া গুয়েন্দা ঘুরলে কিরাম দেহায় না?’
‘গাড়ি নিয়ে ঘুরলে মানুষ বুঝে ফেলবে। খুবই গোপন এক মিশনে আছি। তাই সাধারণের মত করে রিকশায় ঘুরছি। যাতে কেউ না বুঝে। এটাই তো আন্ডারকভার।’
‘আইচ্ছা!’
জয়নাল তার প্রস্তাবে জবাব না দিলেও বুঝতে পারছে যে সে রাজী আছে। সাধারণ মানুষের মাঝে কৌতুহলটা অনেক বেশি কাজ করে। সরাসরি না বললেও কৌতুহলের কারণে সারাদিন তার সাথেই লেগে থাকবে। আর টাকার লোভটাও তো আছে।
‘আইয়া পড়ছি ভাইজান।’
রিকশা থেকে নামতেই স্তব্ধ হয়ে গেল ফারহান। স্কুলের মেইন গেইটে তালা ঝুলানো। গার্ডরুমটা শুধু খোলা। স্কুল পুরোপুরি নিশ্চুপ হয়ে আছে। কোন কোলাহল নেই। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলো না ফারহান।
তারপর হুট করে মনে পড়লো। আজ তো শুক্রবার।
এখন কোন পথে এগুবে?
পূর্বাধ্যায় – এক
বেড়ে উঠাটা খুব সুখকর ছিল না ফারহানের। অবশ্য দুঃখ-কষ্টে বেড়ে উঠা অন্যদের মানুষগুলোর থেকে খুব একটা আলাদাও ছিল না তা। বয়স তখন তিন কি চার, তখনই তার বাবাকে হারানোর কষ্টের সাথে পরিচিত হতে হয়। বাবার আদরটা আসলে কেমন সেটাও তখন ঠিকমত জানতো না। তার বাবা খুব ধনী ছিলেন না। সামান্য এক কর্মচারী ছিলেন। পরিবার চালাতেই কষ্ট হত অনেক। সেই কষ্টটা আরো কয়েকগুন বেড়ে যায় তার বাবার মৃত্যুর পর। আর সেটা সহ্য করতে হয় তার মাকে। কষ্টসৃষ্ট করেই ফারহানকে নিয়ে জীবন কাঁটিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পেলেন না তিনিও। ফারহানের বয়স তখন দশ। দশ বছর বয়সেই পৃথিবীতে তার সবচেয়ে আপন জন মানুষকেই হারাতে হয়েছিল।
বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া কিছুই ছিল না যে তা দিয়ে চলতে পারবে। মনে করেছিল পড়ালেখা হয়তো আর করাই হবে না। কাজ কর্মে নেমে যেতে হবে মুখে অন্ন যোগানোর জন্য। তবে তার মায়ের দু-সম্পর্কের এক ভাইয়ের কল্যাণে বেঁচে গিয়েছিল সে যাত্রায়। ঐ মানুষটিই ছিল তার একমাত্র আপন মানুষ। ফারহানের মায়ের বাবা নাকি ঐ লোকটাকে বড় করতে সাহায্য করেছিল। সেটারই প্রতিদান দেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল। ফারহানকে সেই প্রতিদানটা ফিরিয়ে দিতে পেরে নিজেই শান্তি খুঁজে নিয়েছিল।
কিন্তু সবকিছুই তো মসৃণভাবে চলে না। জহির মামা মানে ফারহানের মায়ের ঐ দু-সম্পর্কের ভাইয়ের স্ত্রী ছিল সাক্ষাৎ হারামি। জহির মামার সামনে তিনি ফারহানকে ঠিকই অনেক আদর করতেন – কিন্তু আড়াল হলেও অত্যাচার শুরু। ফারহান যেন তার একটা বোঝা হয়েছিল। জহির মামা এটা জানতেন, বেশ কয়েকবার এ নিয়ে তার মামা-মামীর ঝগড়াও হয়েছে। তবুও আচরণে কোন পরিবর্তন আসেনি। অবশ্য জহির মামা ফারহানকে প্রচন্ড আদর করতেন। নিজের স্ত্রীর ফারহানের সাথে করা আচরণের জন্য মাঝে মাঝেই কিশোর বয়সী ফারহানের কাছে ক্ষমাও চাইতেন।
সত্যি বলতে জহির মামার জন্য ফারহান বেঁচে থাকতে পেরেছিল। একটা স্বাভাবিক শান্তিময় জীবন গড়ে তোলার স্বপ্নের দেখা মিলেছিল। কিন্তু ঐ যে – কপাল যার খারাপ – তার তো সুখ বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনা। জহির মামাও মারা গেল একটা সময়। তার আগে দীর্ঘদিন লড়াই করে গেছেন মরণঘাতী ক্যান্সারের বিরুদ্ধে। চিকিৎসার অভাব হয়নি – কিন্তু ক্যান্সার থেকে কি আর কাউকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা যায়?
ঐ একটা সময়ই ফারহান খুব চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। জহির মামাই ছিল তার আশ্রয়, তার বন্ধু, তার বাবা-মা সব। এই মানুষটা না থাকলে সে সামনে এগিয়ে যাবে কীভাবে? কয়টা দিন পরেই তার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। মামার মৃত্যুর পর যে তার মামী তার সাথে দুর্ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই করবে না তা সে ভাল করেই জানে। তখনই বুঝতে পেরেছিল – অল্প করে হলেও প্রতিবাদ করতে হবে। না হলে এই একাকী ভুবনে সে চলতে পারবে না। এভাবেই কাঁটিয়ে দিল আরো একটা বছর।
তার স্বপ্নগুলো সত্যি হতে শুরু করছিল একটু একটু করে। ভাল ছাত্র হবার সুবাদের দেশের নাম করা এক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে কোন সমস্যাই হয়নি। এখান থেকে সে নিজেই নিজের গতি বের করে নিতে পারবে। সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় খরচ কম, ভাল ছাত্র হওয়ায় প্রাইভেট টিউশন করে নিজের খরচ চালিয়ে নিতে পারবে, হলে থাকার সুবিধা পাওয়া আলাদা বাসস্থান খোঁজার চিন্তাও নেই। জহির মামার বাসায় থেকে বের হয়ে আসতে এখন আর কোন সমস্যাই নেই তার।
বেরিয়ে আসলো জহির মামার বাসা থেকে। শুরু করলো নতুন জীবন। প্রথম কয়টা মাস ঠিকমতই চললো। কিন্তু এরপরই শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি করা বড় ভাইদের অত্যাচার। রাজনীতির প্রতি তার কোন আগ্রহ না থাকলেও তাকে রাজনীতিতে জড়ানোর জন্য জোর করা হচ্ছিল। সোহেল ভাই নামের এক নেতাই বেশি চাপাচাপি করছিল। কিন্তু তাকে টানতে না পেরে ক্ষীপ্ত হয়ে উঠে সোহেল। তার ধারণা ছিল, ফারহান হয়তো তার বিপক্ষ দলটায় যোগ দিয়ে ঘাপটি মেরে আছে। এজন্যই তার কর্তৃত্ব মানতে নারাজ।
একদিন তার রুমে ফারহানকে ডেকে এনে ইচ্ছেমত গালাগাল করলো। শাসালো যে তার দলে যোগ না দিলে ফারহানের কপালে খারাবি আছে। বলতে বলতে একটু সীমা ছাড়িয়েই বলে ফেলেছিল সেদিন সোহেল। ফারহানের মামার বাড়িতে বেড়ে উঠা নিয়েও কথা তুলেছিল। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় থাকায় বলে ফেলেছিল। ‘তোর মা আর মামা তো আপন ভাই বোন না। তোরে তোর মামায় পালছে নিশ্চয় এই কারণেই। হয়তো তোর মামাই তোর আসল বাপ। নাইলে তোরে পালবো ক্যান?’
কথাটা শুনে রাগে গা জ্বলে উঠেছিল ফারহানের। তার ইচ্ছা করছিল ওখানেই সোহেলকে শেষ করে দিতে। কিন্তু মাথা শান্ত রেখে চুপচাপ অশ্রাব্য গালিগুলো শুনে যাচ্ছিল। মাথা নুইয়ে কথাগুলো শুনে সোহেলের রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। কোন প্রতিবাদই করেনি। তবে এর মানে এই না যে এরর জবাব সে দিবে না। দিবে ঠিকই, তবে এখন এই মুহুর্তে না। সোহেলকে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাটাই দিবে।
সুযোগটা ঐদিন রাতেই পেল। আগের রাতে অতিরিক্ত নেশা করায় অসুস্থ হয়ে পড়ে সোহেল। তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা তাকে ছাড়াই তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড এগিয়ে নিচ্ছে। বেশি অসুস্থ থাকায় একাই রুমে পড়েছিল সোহেল। ফারহান দেখলো এটাই শ্রেষ্ঠ সুযোগ সোহেলকে শিক্ষা দেওয়ার। নেশা করতে বেশি পছন্দ করে সোহেল। ঐ নেশাদ্রব্য দিয়েই তাকে শায়েস্তা করবে। এর জন্য অবশ্য সুযোগটা সোহেলই সৃষ্টি করে দিয়েছিল। সোহেল তাকে রুমে ডেকে নিয়ে শাসানোর পর পরই বিপক্ষ দলের আনুগত্য বেড়ে যায় তার প্রতি। তাদের থেকে অ্যালকোহলের কয়েকটা বোতল আর গাঁজার পোঁটলা চাইতেই পেয়ে গেল। সে জানে যে এই মুহুর্তে তাকে কদর করবেই বিপক্ষ দল। এই সুযোগে নিজের কাজ সেরে ফেললেই হয়।
রাত গভীর হওয়ার পর সোহেলের রুমের দিকে যাত্রা করলো ফারহান। হলের পরিবেশটা এখন নীরব। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। কেউ কেউ পড়ছে। কেউ কেউ আবার নিজেদের মাঝে গল্প করছে, তাস খেলছে। একটু হতাশগ্রস্তরা আবার নেশার আড্ডা নিয়ে মেতেছে। সাধারণত, নেশার আড্ডাটা সোহেলের রুমেই হয়। কিন্তু সে অসুস্থ থাকায় আজ অন্য জায়গায় হচ্ছে। যেহেতু নেশা ছাড়া তাদের কারোরই চলবে না, তাই সোহেল ছাড়া সবাই ই ঐ আড্ডাতেই আছে।
সোহেলের রুমে ঢুকে দেখে সোহেল ঝিমুচ্ছে। দরজার শব্দ শুনে তার দিকে মাথা তুলে তাকালো।
‘তুই এত রাইতে এইনে কী করস?’ ফারহানকে দেখে কিছুটা অবাক সে। আরও অবাক হয়েছে ফারহানের হাতের দিকে তাকিয়ে। ‘তোর হাতে কি ঐগুলা?’
‘তেমন কিছু না ভাই। আপনার জন্য আনলাম। সকালের কথাগুলো আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। একটা সিদ্ধ্বান্ত নিয়েই এসেছি। হাতের জিনিসগুলো সিদ্ধান্তের প্রতীক।’ হাসতে হাসতে জবাব দিল ফারহান।
সোহেল বুঝতে পেরে হাসলো। যাক, শেষ পর্যন্ত ছেলেটাকে হাত করতে পেরেছে সে। বিপক্ষে যায়নি। সকালে অনেক বাজে বাজে কথা বলেছিল ফারহানকে। ভেবেছিল ফারহান হয়তো তার সাথে আসবেই না, তাই এক নাগাড়ে বলে গেছে। এখন নিজেই কিছুটা অনুতপ্ত। ভাবছে ছেলেটার কাছে সকালের কথাগুলোর জন্য মাফ চাইবে কিনা।
‘এখন তো অসুস্থ রে। ঐসব খামু না। রাইক্ষা যা টেবিলে।’
‘ভাই, এত কষ্ট করে যোগাড় করলাম – আর আপনি এখন এই কথা বলেন? একটু তো স্বাদটা নেন! শান্তি পাব তাহলে।’ গদগদ ভঙ্গিতে বলল ফারহান।
ফারহানের কন্ঠ শুনে সোহেলেরও নেশার চাপ পেয়ে গেছে। ভেবেছিল, আজকে ওসবের দিকে ঝুঁকবে না। কিন্তু, নেশাখোর কি আর নেশার নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে পারে?
‘আচ্ছা, কইতাছস যখন। বানা তাইলে। বানাইবার পারবি?’
‘জ্বি ভাই। পারব। আপনি একটু বিশ্রাম নেন। আমি সব রেডি করে ডাকব।’
তার কথা শুনে খুশি হল সোহেল। চোখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে শুয়ে রইলো। ঐদিক দিয়ে ফারহান তার জন্য নেশা তৈরি করছে।
বড় বড় চারটা পোটলা এনেছে ফারহান। সবগুলো কাগজ থেকে খুলে একত্র করলো। সকালে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ই সে রুমের পুরোটা দেখে গেছে। সবই আছে এই রুমে। নিজেদের রান্না করে খাওয়ার জন্যও ব্যবস্থা আছে। এমনিতে হলে ইলেক্ট্রিক হিটার ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু নেতাদের তো আর কোন কিছুতে নিষেধাজ্ঞা নেই। তার রুমের কোনায়ই শোভা পাচ্ছে একটা হিটার। এটার পাশেই অন্যান্য কিছু প্রয়োজনীয় তৈজসপত্রও পড়ে আছে। সেখান থেকে একটা ছোট স্টিলের বাটি তুলে নিয়ে তাতে গাজার পাতাগুলো রাখলো ফারহান। একটা ছোট পাত্রে বোতলের অ্যালকোহলটা ঢেলে রাখলো। তারপর পাত্রটা হিটারে চড়িয়ে গরম করা শুরু করলো। অ্যালকোহল গরম করায় বিপদের সৃষ্টি হতে পারে – কিন্তু তাতে অতটা পাত্তা দিচ্ছে না ফারহান। হালকা গরম হলেই চলবে তার। ঐদিকে বাটিতে রাখা গাজার পাতাগুলোও উত্তপ্ত করে নিচ্ছে।
‘ঐ তুই করতাছসটা কী? গন্ধে তো দম আঁটকার দশা,’ হাঁসফাঁস করতে করতে বলে উঠলো সোহেল।
সোহেলের কথাটা অবশ্য ভুল না। আসলেই গন্ধ ছড়ানো শুরু করেছে। ফেস মাস্ক পড়ে থাকায় পড়ে থাকায় তাকে কোন অসুবিধার মুখে পড়তে হচ্ছে না। ইতিমধ্যেই রুমের সব জানালা আঁটকে দিয়েছে। দরজারও খিল লাগানো। বিষাক্ত ধোঁয়া দিয়ে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে সোহেলকে।
অসুস্থ হওয়ায় এমনিতেই দুর্বল ছিল, তারপর হুট করে বাতাসের তীব্র কটু গন্ধ তাকে আরো দুর্বল করে দিল। চেঁচিয়ে যে কিছু বলবে সেটার শক্তিও পাচ্ছে না। ফারহান এসব কেন করছে তা কোনভাবেই মাথায় ধরছে না তার। কিছু বুঝে উঠার আগেই টের পেল তার হাতদুটো পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। বাঁধা দেওয়ার কোন শক্তিও সে পাচ্ছে না। এতক্ষণে বুঝতে পারছে ফারহানের হুট করে রাতে আগমনের কারণটা। সে তার সাথে যোগ দিতে আসেনি, এসেছে তার শাসানোর প্রতিশোধ নিতে। বুঝলো ঠিকই তবে ততক্ষণে নিজেকে বাঁচানোর কোন উপায়ই নেই।
‘ভাই, আপনি তো সব সময়ই বলেন গাজা খান। কিন্তু কখনো তো খান না। শুধু টানেনই। আজকে আমি আপনাকে গরম গরম গাজা খাওয়াব।’ বলেই উত্তপ্ত গাজার পাতাগুলো কাগজের সাহায্যে উঠিয়ে এনে সোহেলের মুখে ঢুকিয়ে দিল। তারপর হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখলো কিছুক্ষণ – যাতে সোহেল মুখ থেকে পাতাগুলো ফেলে দিতে না পারে।
গরম পাতার তাপে মুখের ভিতরটা সাথে সাথেই পুড়ে গেল সোহেলের। জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেছে যেন। কটু গন্ধ সহ্য করতে পারে ছটফট করছে শুধু। হাত দুটো বাঁধা থাকায় ফারহানকে কোন বাঁধাই দিতে পারছে না। শেষমেশ মুখের উপর থেকে হাত সরালো ফারহান। তবে ততক্ষণে সোহেল প্রায় অর্ধমৃতই বলা যায়। শ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে তার।
‘আপনি অ্যালকোহল গিলে গরম হয়ে উঠেন। কিন্তু গরম অ্যালকোহল যদি আপনাকে গিলে তাহলে তা কেমন লাগবে?’ শান্ত গলায় কথাটা বলল ফারহান।
সোহেলের চোখে করুণ আর্তি ফুঁটে উঠেছে। সে বুঝতে পারছে সে ফারহানের সাথে অনেক অন্যায় আচরণ করেছে। শাস্তিও সে পেয়েছে। গুঙিয়ে গুঙিয়ে তাকে যেন মেরে না ফেলে তার অনুরোধ করলো। জবাবে ফারহান মৃদু হেসে জবাব দিল। ‘আমি তো কিছুই করব না আপনাকে। শুধু পরীক্ষা করে দেখব যে গরম অ্যালকোহলে কী প্রভাবের সৃষ্টি হয়।’
বলেই গ্লাস ভর্তি গরম অ্যালকোহল ঢেলে দিল সোহেলের মুখে। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো চিৎকার করে উঠলো সোহেল। তার রুমের বাইরে ভিড় জমে গেছে। দরজা ভেঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করছে তার সাথীরা। কাঁচের জানালার ফাঁক দিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনেকেই। ঐদিকে ফারহানের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে গরম অ্যালকোহলের পুরোটাই ঢেলে যাচ্ছে সোহেলের মুখে। মুখের ভেতর বাহির পুরোটাই পুড়ে গলতে শুরু করে দিয়েছে এতক্ষণে। গলা দিয়ে অ্যালকোহল নেমে যাওয়ায় গলার ভিতরটাও পুড়ে গেছে। কন্ঠশক্তি পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে সোহেল। ছটফটানিটা আছে এখনও, তবে আর বেশিক্ষণ থাকবে না। সোহেলকে বাঁচানোর আর কোন সম্ভাবনাই নেই দেখে উঠে দাঁড়ালো ফারহান। সোহেলের পুড়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে শুধু ভাবলো, কী দরকার ছিল কারো আপন মানুষ নিয়ে কটুক্তি করার? নিজের মা কে নিয়ে অশ্লীল কথা কেউ সহ্য করতে পারে?
দরজা পুরোপুরি ভাঙতে পারেনি তখনও, এর আগেই ফারহান দরজা খুলে দিল। সে দরজা খুলতেই সবাই ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল। সোহেলের মত ভয়ানক নেতাকে একটুআগে যেরকম বিভৎসভাবে হত্যা করতে দেখেছে তারা – এরপর প্রতিবাদ করার সাহসও নেই কারো। এমনকী সোহেলের বিপক্ষ দলের কেউও তাকে বাহবা দিতে এগিয়ে আসছে না। নিরাপদেই করিডোরটা হেঁটে পার হয়ে গেল ফারহান। সে জানে ক্যাম্পাসে এখন কেউই তার বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস পাবে না।
তবে ভোর হওয়ার আগেই পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে রটে গেল ফারহানের খুন করার ঘটনাটা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সাথে সাথেই ছাত্রত্ব বাতিল করে দিল। মামলাও ঠুকে দিল। হত্যার কারণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হোক অথবা আর যাই ই হোক – তার খুন করার ধরণটা পুরোপুরি একজন অপ্রকৃতিস্থ পশুর মত। অবশ্য খুন করার পর পালানোর চেষ্টাও করেনি ফারহান। সে জানে এই খুনের অপরাধে সে কোন ছাড়া পাবে না। তার কেউ নেইও যে তাকে ছাড়িয়ে আনবে। পড়ালেখা করে স্বাভাবিক জীবন গড়ার স্বপ্নটা পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে দেখে আক্ষেপ করছে শুধু।
পরদিন দেশের সবগুলো পত্রিকার প্রধান খবর হিসেবে স্থান পেল তার ঘটনাটাই। ‘মা কে নিয়ে অশ্লীল কথা বলায় কটূক্তিকারীকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো এক যুবক’ এই শিরোনামটা ছাড়া বাকি সবগুলোই ব্যাপারটাকে রাজনৈতিক দিকে টেনে নিয়েছে। ফারহানের অবশ্য তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা। অন্যায়ের প্রতিবাদ সে করেছে। হয়তো তা মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু সোহেলের কটুক্তিগুলোর জবাব এরকমই হওয়া উচিৎ ছিল।
দুইদিনের মত থানার সেলে আঁটকে রাখার পর, হুট করে তাকে মুক্তি দিয়ে দেয় থানার কর্মরত অফিসার। ফারহানের চোখে মুখে অবাক অভিব্যক্তি দেখে অফিসার বললো, ‘তোমার জামিন হয়ে গেছে। যে জামিন করিয়েছে সে বাইরেই আছে।’ কঠিন এক মামলা থেকে এত সহজে জামিন হয়ে যাবে ফারহান তার সবচেয়ে কাল্পনিক স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।
থানার বাইরে বের হয়েই দেখে এক গাট্টাগোট্টা খর্বাকৃতির লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশেই কালো আলখেল্লা পড়া লম্বা এক লোক ফাইল হাতে দাঁড়ানো। লোকটা সম্ভবত উকিল হবে। সে তাদের পাশে দাঁড়াতেই উকিল তার হাতে একটা মোবাইল দিয়ে বলল, তাকে যে ছাড়িয়েছে সে কিছুক্ষণের মাঝেই তাকে ফোন করবে। বলে উকিল সহ লোকটা চলে যায়।
ফারহান তখনও অবাক হয়েই আছে। কিছুই বুঝতে পারছে না যে কী হচ্ছে। কে তাকে ফোন করবে? সবচেয়ে বড় কথা তাকে কেন ছাড়াবে এমন মামলা থেকে? কারণটা কী?
এসব ভাবতে ভাবতেই হাঁটতে শুরু করলো ফারহান। মিনিট দশেক পরেই বেজে উঠলো ফোনটা। রিসিভ করে কানে লাগাতেই ওপাশের গমগমে কন্ঠস্বরটা শুনতে পেল। ‘ফারহান, বেশ ভাল কাজ দেখিয়েছো তুমি। অভিনন্দন।’
পুরোপুরি হা হয়ে গেছে ফারহান। চমৎকার কাজ দেখিয়েছে মানে? তার মনোভাব বুঝতে পেরেই হয়তো ঐ পাশ থেকে লোকটা বলে উঠলো, ‘আমি জানি তুমি এই মুহুর্তে অনেক অবাক হয়ে আছো। কিন্তু তোমাকে সব বলা যাচ্ছে না। তবে, তোমাকে ছাড়ানোর পিছনে আমার স্বার্থও আছে। তোমার মস্তিষ্ক অনেক ক্ষুরধার। কোন অস্ত্র না পেয়ে সাধারণ জিনিসকেই তুমি অস্ত্রে পরিণত করতে পারো। চিন্তাশক্তি খুব শক্তিশালী তোমার। আমার এই চিন্তাশক্তিটাই লাগবে। তোমার এই ক্ষুরধার মস্তিষ্ককে কাজে লাগাতে হবে আমার হয়ে।’
‘কী… কী ধরণের কাজ?’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ফারহান।
‘সোহেলের সাথে যা করেছো সেটাই।’ গমগমে গলায় একটু হেসে উত্তরটা পেল ঐ পাশ থেকে। ফারহান অন্য কিছু বলার আগেই আবার বলে উঠলো, ‘তোমার উপর থাকা মামলাটার মিমাংসাও হয়ে যাবে কয়েকদিনের মাঝে। তোমার পড়ালেখার খরচও আমিই দেব। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই তোমাকে ভর্তি করানো হয়ে গেছে। এসবই পাবে যদি তুমি আমার প্রস্তাবে রাজি থাকো। রাজি তুমি?’
কিছুটা ইতস্তত বোধ করছে ফারহান। কী বলবে বুঝতে পারছে না। একদিকে তার এসব খুনখারাবির পথে যাওয়ার কোন শখ নেই। এতে তার স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্নটা আর পূরণ হবে না। আবার, অন্যদিকে রাজী না হলেও তার স্বপ্নটা পূরণ হবেনা। বরং ফাঁসিতে ঝুলে মরতেই হবে।
‘ফারহান, আমার মনে হয় না ভাবাভাবির কিছু আছে এতে। তোমার স্বপ্ন সম্পর্কে আমি জানি। তোমারই একটা কাজের কারণে স্বপ্নের অর্ধেকটা অংশ পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু, বাকি অর্ধেকটা তো করতে পারছো।’ আবারো ফারহানের মাথায় ঘুরতে থাকা কথাগুলো ধরে ফেলল ঐ পাশের লোকটা।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ফারহান। লোকটার কথা একদিক দিয়ে ভুল না। স্বপ্ন তো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, কিছুটা এখনও বেঁচে আছে। আর, স্বাভাবিক জীবন তো সে হারিয়েছে সেই দশ বছর বয়সেই। এই স্বপ্নটা কখনোই পূরণ হবার মতও না। লোকটার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল সে।
‘হ্যাঁ, রাজি আছি আমি।’
‘বেশ। যেখানে আছো, ওখানেই থাকো। দশ মিনিটের মাঝেই দরকারী সবকিছু তোমাকে দিয়ে যাবে আমার এক লোক। আর, আমার সাথে কাজ করতে হলে – তোমাকে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, তোমাকে কখনও ধরা পড়া চলবে না। এমনকী ধরা পড়ার মত সূত্রও ফেলে রাখা যাবে না। ক্ষুরধার মস্তিষ্ককে শীতল ক্ষুরধার হিসেবে তৈরি করো। যদি কখনো কোন কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ো বা ধরা পড়ার মত অবস্থার সম্মুখীনও হও – তাহলে মনে রেখ আমার কাছে তোমার কোন মূল্যই থাকবে না আর। সো, এইদিকে খুব সাবধান।’
শুনে পিলে চমকে গেল ফারহানের। সিদ্ধান্ত পালটে ফেলবে কিনা ভাবছে। তবে, পাল্টালো না। বিপদ তো দুইদিকেই। স্বাভাবিক জীবন যখন হারিয়েই ফেলেছে – তখন আর অত কিছু ভেবে কী লাভ!
‘তোমার নিশ্চয় এখন জানতে ইচ্ছে করছে তুমি কার সাথে কথা বলছো, তাই না?’
আসলেই তো। লোকটার নামই তো সে জানেনা। আর তার সব কথা এতক্ষণ ধরে সে অন্ধের মত বিশ্বাস করে গেল। নামটা জানার কথা তার নিজেরও মনে হয়নি। প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল… তবে তার আগেই উত্তরটা পেয়ে গেল।
‘খুব বেশি কিছু তোমাকে জানতে হচ্ছে। কখনো জানতে হবেও না। ফোন রেখে কল লিস্টে নামটা দেখে নিও।’ বলে ফোনটা কেঁটে দিল।
দ্রুত মোবাইলটা সামনে নামটা দেখলো। কলটা আসার সময়ও নামটা ছিল, কিন্তু তখন নজরে পড়েনি। এখন দেখছে, ‘Mr. TATA’
মিস্টার টাটা!!!
এমন কোন গডফাদারের নাম তো সে জীবনেও শুনেনি। অবশ্য এমনিতেও যে অন্য কারো নাম শুনেছে সেটাও না।
কিন্তু মিস্টার টাটা তাকেই বেছে নিলেন কেন? তাকে এত সু্যোগও করে দিচ্ছেন কেন?
কোন না কোন কারণ তো এর পিছনে আছে অবশ্যই।
কী সেটা?
অধ্যায় - পাঁচ
ফারহানের অপেক্ষা করতে করতে কখন যে পড়েছিল তা মনেই করতে পারছে না নিমমি। ফারহানকে ফোনে ট্রাই করতে করতে ফোনের চার্জও ফুরিয়ে গেছে অনেক আগেই।
বন্ধ ফোনটাই আরেকবার হাতে নিয়ে কল করার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল। ফারহান রাত থেকে বাসায় ফিরেনি। চোখের সামনে অনেকগুলো দৃশ্য ভাসছে তার। তার মন বলছে ফারহান কোন বিপদে পড়েছে। তবে ভাবতে চাইছে – হয়তো অফিসের কাজে আবার ফিরে গেছে রাতেই। তাড়াহুড়োয় তাকে ভেঙ্গে বলতে পারেনি।
মোবাইলে চার্জ দিবে আরেকবার ফোন দিবে ফারহানকে, এই ভেবে উঠে মোবাইল চার্জে বসাতে গেল নিমমি। কিন্তু কারেন্ট নেই বাসায়। রাতে সে ঘুমিয়ে পড়ার আগেও কারেন্ট ছিল না। ঘড়িতে দেখলো সকাল প্রায় নয়টার কাছাকাছি। রাত থেকে সকাল প্রায় সাত ঘন্টা বা তার বেশি সময় ধরে কারেন্ট নেই বাসায়।
একটু অবাক লাগলো তার। নোটিশ ছাড়া তো এত লম্বা সময় লোডশেডিং থাকার কথা। নাকি শুধু তার বাসায়ই সমস্যা! মোবাইলটা সাথে নিয়েই অন্য অ্যাপার্টমেন্ট গুলোয় খোঁজ নেওয়ার জন্য পা বাড়ালো নিমমি। দরজাটা খুলতেই কোলাহলের শব্দ শুনতে পেল। কৌতুহল বশত নিচে নেমে দেখে বিল্ডিং-এর সামনে তিনটা গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। লাশের দৃশ্য দেখেই দৌড়ে নিজের ঘরে ফিরে এল নিমমি।
থরথর কাঁপছে সে। ফারহান রাত থেকে নেই। বিল্ডিং-এর সামনে গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। এখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত যে ফারহান বিপদেই পড়েছে। এজন্যই রাত থেকে নিখোঁজ সে। ফারহানকে যতটা চিনে সে তাতে তাকে চমকে দেওয়া চরিত্র মনে হলেও বেশ শান্তই লেগেছে তার কাছে। তার তো বিপদে পড়ার কথা না। ‘স্বাভাবিক ভাবে ভাবো, গর্ধভ মেয়ে,’ নিজেকেই ধমক লাগালো উল্টোপাল্টা চিন্তা করার কারণে।
কিন্তু পুরোনো একটা কথা মনে পড়ায় স্বাভাবিক চিন্তাও করতে পারছে না সে। ফারহান কী কাজ করতো – দীর্ঘদিন ধরে সেটা তার অজানাই ছিল। এই বাসায় আসার পরও জানতো না সে।
একদিন এক অন্তুরঙ্গ মুহুর্তে আহ্লাদী কন্ঠে ফারহানকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কী করো গো? তোমার সম্পর্কে কেউ জানতে চাইলে তো কিছুই বলতে পারিনা।’
‘তাদের জানার কী দরকার? যাই করি না কেন, করি কিছু একটা।’
‘তারা না জানুক, আমিও কি জানতে পারব না?’
‘জেনে কী হবে শুনি?’
‘এভাবে লুকানো দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি কোন ক্রিমিনাল। আত্নগোপন করে আছো। যে কোন মুহুর্তেই বিপদে পড়তে হতে পারে আমাকে।’
‘যদি ক্রিমিনাল হয়েই থাকি – তাহলে তো পালানোর পথও আমি তৈরিই রেখেছি। চিন্তা করছো কেন?’
‘তাই না? মশা মারার ক্ষমতাও নেই – আবার সে কিনা ক্রিমিনাল!’
‘বিশ্বাস না হলে……’
এরপর গম্ভীরমুখে ফারহান কিছু কথা বলেছিল – যা শুনে বেশ চমকেই গিয়েছিল নিমমি। আহ্লাদী দৃষ্টিটা সম্পূর্ণ ভয়ার্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য পরমুহুর্তেই ফারহান হো হো করে হেসে উঠায় বুঝতে পেরেছিল যে সে তাকে ভয় দেখিয়ে মজা নিচ্ছে।
কিন্তু, এই মুহুর্তে নিমমির ঐদিনের কথাগুলোকে ঠিক মজার মত মনে হচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে – ঐদিন তাকে ভড়কে দেওয়ার সাথে সাথে এমন বিপদে পড়লে সেটা পরিত্রাণের উপায়ও বলে দিয়েছিল।
কথাগুলো আসলেই সত্য ছিল নাকি মিথ্যা ছিল – তা যাচাই না করে বুঝার উপায় নেই।
ধীরে ধীরে কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ফারহানের ক্লজেটটার দিকে। এটায় সে এখন পর্যন্ত হাত দেয়নি। ফারহানের উপর কোনরূপ সন্দেহ ছিল না বলেই হয়তো এতদিন এটাতে হাত দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। টান দিয়ে ঢালাটা খুললো।
ঢালাটা খুলতেই হাঁ হয়ে গেল নিমমি। চোখ বিস্ফোরিত হয়ে আছে তার।
(চলবে...)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:০৬