গুন্টের গ্রাস ইসরায়েল নিয়ে কবিতা লিখে ইহুদীবাদীদের রোষে পড়েছেন। ইসরায়েল যে ১৯৪৮ সাল থেকেই একটা বিষফোঁড়া হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটা মহাবিপদ হয়ে বসে আছে, এ কথা পশ্চিমা দেশগুলো অস্বীকার করে, এমন কি জার্মানীকেও আগে থেকে এ ব্যাপারে বাধ্য করে রাখা হয়েছে। অবশ্য সরকারী সিদ্ধান্ত যা-ই হোক না কেন বহু ইহুদীও ইহুদীবাদ বিরোধী - যেমন চোমস্কি। চোমস্কির লেখায় অনুপ্রাণিত ইহুদী অধ্যাপক নর্মান ফিংকেলস্টাইন "The Holocaust Industry" নামে এক বই লেখেন, যাতে তিনি তাঁর মায়ের এক উদ্ধৃতি উল্লেখ করেন - " হলোকস্টে যদি হিটলার এত ইহুদীই মেরে ফেলে থাকেন, তাহলে এত লাখে লাখে ইহুদী আগে বা এখনো জার্মানদের কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণ পায় কিভাবে?" ক্ষুদে সংখ্যালঘু হলেও আমেরিকার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভুবনে বিপুল ক্ষমতাধর ইহুদীসমাজ নিজেদের জাতভাইকেই বর্জন করে। তাঁর চাকরী যায়।
ওবামা দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হওয়ার পরে কি করবেন দেখা যাক। আমেরিকান পররাষ্ট্র মন্ত্রী পদে হিলারীকেই রেখে দেবেন, যার জামাই ইহুদী, নাকি এবারের চাইতে আরেকটু ইহুদীবাদ বিরোধী অবস্থান নেবার ইচ্ছা গোপনে পোষণ করেন এবং সে জন্য মন্ত্রীসভা ঢেলে সাজাবেন, তা জানা যাবে জানুয়ারী মাসে।
গুন্টের গ্রাস বাংলাদেশেও এসেছিলেন এক সময়। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন কেন বাংলাদেশী সাহিত্যিকরা জেনেভা ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের নিয়ে কিছু লেখে না। সঙ্গে সঙ্গে টের পান তিনি ভীমরুলের চাকে হাত দিয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হক থেকে শুরু করে প্রায় সব সাহিত্যিক (যাঁদের কেউই আসলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের কোনো মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারেন নি) গ্রাসের মন্তব্য অনধিকার চর্চা বলে চেঁচামেচি শুরু করেন।
মেহেরজান ছবিটিতে একটি ব্যতিক্রমী পাকিস্তানী সৈনিক ও ঘটনা দেখানোতেই আমাদের স্বাধীনতার কপিরাইট পাওয়া বিদ্বানগণ এমন মারমুখী হয়ে উঠলেন যে সে ছবি নামিয়ে নিতে হলো। তার ডিভিডিও নেই, যে লোকে নিজের ঘরে বসে একটু তার বিচার করে দেখতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসবিদ নন, তিনি সৃষ্টিশীল সাহিত্যিক। ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বন করে শিল্পকর্ম তৈরী হলে তাকে নির্ভেজাল ডকুমেন্টারী হতে হবে যাঁরা এটা বিশ্বাস করেন তাঁরা "Inglourious Basterds" দেখেছেন কি? হুমায়ূন তাঁর নানা পাকিস্তানপন্থী হলেও ভালো মানুষ ছিলেন বলেছেন কোথাও, সেই প্রসঙ্গ অনেকে টেনে আনছেন। বর্ণ হিন্দুদের অত্যাচারের কথা এবং সেই কারণে মুসলিমদের জন্য স্বাধীন আবাসভূমির (যা মূল প্রস্তাবে একাধিক স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হওয়ারই কথা ছিল) জন্মকে যাঁরা স্বাগত জানিয়েছিল তাঁদের কথা তুললেই অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবী "সাম্প্রদায়িক" বা "রাজাকার" বলে মারতে আসেন।
১৯৭১ এর ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চের রাত্রি পর্যন্ত কি ঘটেছিল অবাঙালীদের ভাগ্যে? বা ১৬ ই ডিসেম্বরের পরে? শুধু একটা উদাহরণঃ এখন যেটা ইন্দিরা রোডে অবস্থিত তেজগাঁ কলেজ হোস্টেল, সেটা ছিল নেসার নামে এক অবাঙালী ভদ্রলোকের, যিনি পাকিস্তানপন্থী হলেও কোন দুষ্কৃতি করেছেন বলে প্রমাণ নেই। ১৬ই ডিসেম্বরের আগে তিনি দেশত্যাগ করেন নি, নিজেকে নিরপরাধ ভেবে। তাঁর এক মেয়েকে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেয়া এক তরুণ তুলে নিয়ে যায়, তাঁর বাড়ি সে ও তার বন্ধুরা দখল করে। পরে এটা তেজগাঁ কলেজ হোস্টেলে পরিনত হয়। নেসার সাহেব অনেক পয়সা ঘুষ দিয়ে প্রাণ ও বাকি পরিবার নিয়ে পাকিস্তানে পালান। সেই বাড়ির আঙিনার একাংশ পরে "কিনে নিয়ে" একদা বামপন্থী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, আমাদের আইন মন্ত্রী, তাঁর সুরম্য বাসভবন নির্মাণ করেছেন।
বহুজনের কাছেই শোনা যায় ৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অবাঙালীদের বাড়ি লুট, প্রাণ হরণ, মেয়ে ধর্ষণের ঘটনার কথা। জগন্নাথ হল নাকি অস্ত্র শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে উঠেছিল, যে কারণে এই হলের ওপরেই ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনীর সব চেয়ে মারাত্মক আক্রমণ হয়। অবশ্য এটা অনস্বীকার্য যে পাক বাহিনী ও তার দোসরদের বিভৎস কর্মকাণ্ডের কাছে এসব ছেলেখেলা। তবে কেউ যখন বলেন, এক ব্যক্তি লক্ষকে মিলিয়ন মনে করায় ৩০ লক্ষ শহীদের স্ট্যাটিস্টিক তৈরী হয়েছিল, যেহেতু তিনি অনেকের কাছে দেবতা, তাঁর ভুলটুকু ( ৩ লক্ষই বা কম কি, সেই সংখ্যাটিও পাক বাহিনীর জঘন্য অপরাধের মাপকাঠি হিসাবে উপস্থাপন করা যেত) সবাইকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে। এমনকি ২৯,৯৯,৯৯৯ বললেও "তুই রাজাকার" (হায় হুমায়ূন!)।
হাইকোর্ট হুমায়ূনকে ইতিহাস মেনে লিখতে বলেছেন। প্রকৃত ইতিহাসে কি শুধু শক্তিমানের, বিজয়ীর সত্যটুকু থাকে? স্বাধীনতা আমাদের সুবিশাল অর্জন, গৌরবের ধন। তার মধ্যে কি ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুদ্রার অপর পৃষ্ঠে কি আছে তা দেখার কৌতূহল প্রকাশের স্বাধীনতা, বা শিল্পীর স্বাধীনতা অন্তর্গত নয়?
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:১০