আধুনিক শিল্প সমাজের পরিবারে পারিবারিক ভাঙন, দাম্পত্য কলহ, নির্যাতনসহ নানা ধরনের জটিল সমস্যা দেখা যায়। এই সকল সমস্যা দিনে দিনে জটিল হয়ে যাচ্ছে, কারণ মানুষ হয়ে যাচ্ছে অনেকটাই যান্ত্রিক এবং কমে যাচ্ছে আদর, বন্ধন, ভালোবাসা, সহানুভূতি। কিন্তু কতিপয় পদ্ধতি অবলম্বন করলে সহজেই সুখী হওয়া যায়।
মনোবিজ্ঞানের মতে, আমাদের দেহের শতকরা ৭০-৮০ ভাগ রোগই মনের জন্য হয়ে থাকে। আর মন ভালো বা খারাপ নির্ভর করে ২টি বিষয়ের ওপর-
(১) সংসার জীবন (২) পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। এই লেখায় সংসার জীবনে সুখী হওয়ার ট্রিপস দেয়া হলো। পরবর্তী প্রকাশনায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
বিশ্বস্ততা:
সুখী সংসার গঠনের পূর্বতম শর্ত হলো বিশ্বস্ততা। বিশ্বাসহীন সংসার টিকে থাকা দুরূহ। বছরের পর বছর একই ছাদের নিচে বসবাস করার পরও দেখা যায় দুজনার মধ্যে প্রচুর বিশ্বস্ততার অভাব রয়েছে। কিন্তু তারা সংসার করছে কেবল সমমানহানি হবে বলে এবং বিশৃঙ্খলার ভয়ে অথবা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।
সুখী দাম্পত্য জীবন চাইলে দুজনার মধ্যে বিশ্বস্ততা বাড়াতে হবে, অবিশ্বাসের মূল উঠিয়ে ফেলতে হবে, তথাপি অবিশ্বাসের বিষয়টি দুজনই আলোচনার মাধ্যমে নিরসন করতে হবে।
বয়স:
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বয়সের তারতম্য দেখা যায়, কারো ক্ষেত্রে তা কম আবার কারো কারো ক্ষেত্রে তা বেশি।
আমাদের দেশে সাধারণ স্বামীর বয়স স্ত্রীর বয়সের তুলনায় অনেক বেশি থাকে আর তাই স্ত্রীর আচরণে কিছু ছেলেমানুষি দেখা যায়, তা স্বামীকে বুঝতে হবে এবং তার পজিটিভ ছেলেমানুষিগুলো মেনে নিতে হবে এবং নেগেটিভগুলোকে বুঝিয়ে সংশোধন করতে হবে। অন্যদিকে স্বামীর বয়স যেহেতু একটু বেশি তাই সে একটু সিরিয়াস থাকে, এটা স্ত্রীকে বুঝতে হবে এবং ছেলেমানুষি যথাসম্ভব কম করতে হবে। সর্বোপরি দুজনের ভালো বিনিময়ই সুখী সংসার।
স্বাধীনতা:
স্বাধীনতা হলো মানুষের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার খর্ব হলে মানুষের প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা দেখা যায় এবং আচরণে অসঙ্গতি দেখা যায়, অবসান পায় শ্রদ্ধাবোধ এবং মানুষ ব্যাকুল হয় স্বাধীনতা লাভের জন্য। প্রয়োজনে সে হেয় কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না। আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে কিছু ভ্রান্ত ধারণা দেখা যায় আর তা হলো স্বাধীনতা পেলে মানুষ নাকি খারাপ পথে পরিচালিত হয়। কিন্তু এ ধারণা মিথ্যা। স্বাধীনতা পেলে মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে।
মূল্যায়ন:
সংসার জীবনে নিজের তুলনায় অন্যকে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে অর্থাৎ নিজেকে এখানে যথা সম্ভব কম তুলে ধরতে হবে হোক সে স্ত্রী বা স্বামী। সংসার জীবনে দেখা যায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই মূল্যায়নের আশাবাদী। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি আমার এক নিকট আত্মীয়ের স্ত্রীর সাথে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত এবং সামনে থাকতে স্ত্রী শ্রদ্ধা করত ও পেছনে সমালোচনা করত এবং নিন্দায় ভরে যেত তার মন। ব্যাপারটি আমি খতিয়ে দেখি স্বামী স্ত্রীর কাছে থেকে বেশি সমমানের আশা করত, সমাজে তার অবস্থান তুলে ধরত এবং বেশি বেশি বলত আমি এই-সেই-কত কী?
আমাদের এই ধরনের মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ‘একজন রাজা তার স্ত্রীর কাছে একজন সাধারণ স্বামী।’
দূরত্ব:
সংসার জীবনে দুজনের মধ্যে থাকবে ছোট একটু ফাঁক, এর মানে বিচ্ছন্নতা নয়। শুধু একটু শ্বাস ফেলার স্থান। এর মানে সে যা করতে চাচ্ছে না তা থেকে তাকে অব্যাহতি দেয়া।
থাকুক না বাবা একটু দূরত্ব। সংসার জীবনে একটু ছাড় দিতেই হয়। সংসার জীবন তো আর মিলিটারি রোল নয়। সংসার হলো ভালোবাসা, সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধাবোধ।
কিছু কিছু সত্য বলা থেকে বিরত থাকা:
অনেককে বাংলা ছবির সংলাপ বলতে দেখা যায় ‘এই সত্য কথা তাকে না বললে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না’ কিন্তু এই সত্য স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে বলে তখন ক্ষণিক সময়ে তা মেনে নেয় কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটা সত্যবাদীর জন্য দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ জন্য এমন কোনো সত্য কথা কথা বলা যাবে না যা ভবিষ্যতে অস্ত্র হিসেবে কাজ করবে।
ক্ষমার মন-মানসিকতা ও শ্রদ্ধাবোধ:
কঠোর হলে হবে না দুজনের মধ্যে প্রচুর ক্ষমার মানসিকতা যেমন থাকবে, তেমনি পারসপরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। এই শ্রদ্ধাবোধ সংসারের বন্ধন দৃঢ় করে। তেমনি মানসিকতা থাকবে প্রচুর প্রফুল্ল এবং দুজন দুজনের প্রতি সমান দায়িত্ব পালন করবে।
পারসপরিক সম্প্রীতি:
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমন্ড ফ্রয়েড মনে করেন পিতা-মাতার কলহ শিশুর যৌন ও সংসার জীবনের প্রতি অনীহা দেখা যায় এবং বিকাশে বাধা প্রদান করে। তাই দুজনকে শিশুর স্বার্থেই সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর মূল কথা হলো কম্প্রোমাইজ। দুজনের বোঝাপড়ার মাধ্যমেই সুখী সংসার গঠন করা সম্ভব হয়। অন্যথায় দুজনকেই তুষের আগুনে চিরকাল জ্বলতে হয়।
সম্পর্ক স্থায়ী ও সুখী করতে উদ্যোগী হতে হয় দুজনকেই:
পারস্পারিক ভালোলাগা থেকে জন্ম নেয় ভালোবাসা। আর ভালোবাসার শুভ পরিণতি বিয়ে। বিয়ে সামাজিক রীতি হলেও এই সম্পর্ক স্থায়ী ও সুখী করতে উদ্যোগী হতে হয় দুজনকেই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, যদি একজনও সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলো মেনে চলেন, তবে অন্যদের চেয়ে নিজের সম্পর্ককে আলাদা করতে পারবেন। বিবাহিত জীবনকে আরও সুন্দর এবং সুখী হতে যে বিষয়গুলোর চর্চা করতে হবে:
সততা:
সম্পর্কের ক্ষেত্রে মূল স্তম্ভ হচ্ছে সততা। প্রতিটি সম্পর্কের বিষয়ে সততা দেখাতে হবে। একজনকে অন্যজনের অনেক কাছে নিয়ে আসবে যখন সে বলতে পারবে,‘যাই হোক তুমি আমার সম্পর্কে সত্যটাই জানবে’।
ক্ষমা:
একদিনে কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। কোনো ভুল হলে প্রথমেই সম্পর্ক ভেঙ্গে দেওয়ার চিন্তা না করে সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে।
বোঝাপড়া:
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া থাকাটা খুব জরুরি।
বিশ্বাস:
এমন কিছু কখনো করা যাবে না যাতে করে দুজের মধ্যে বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। শুধুমাত্র অবিশ্বাসই একটি সম্পর্ক ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
সময় কাটানো:
একসঙ্গে সময় কাটাতে আগ্রহী হতে হবে। দুজনের একান্ত সময়টুকু আনন্দময় করে তুলতে নতুন নতুন পরিকল্পনা করতে হবে।
বন্ধুত্ব:
‘বিয়ের আগে আমরা খুব ভালো বন্ধু ছিলাম’। তো, বিয়ের পরে কী হলো? বিয়ের পর সম্পর্কটাকে আরও মজবুত করতে চাই দুজনের নিবিড় বন্ধুত্ব।
ধৈর্য:
দাম্পত্য জীবনের পুরো সময়টাই হানিমুন মুডে থাকতে পারবো…এটা ভাবলে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে হতে পারে। দুঃসময় আসতে পারে, এমন অবস্থায় ভেঙ্গে না পড়ে ধৈর্য ধরতে হবে।
এক বিয়েতে বিশ্বাস:
এক সঙ্গীর সঙ্গেই সারাজীবন কাটানোর জন্য মনস্থির করতে হবে।
ভালোবাসা:
সব সম্পর্কের মূলে থাকে ভালোবাসা। সঙ্গীর জন্য ভালোবাসা থাকতে হবে এবং সেই ভালোবাসার প্রকাশও করতে হবে।