সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী হয়ে যাওয়া নারীরা এখানে নানা ধরনের শোষণের শিকার হন। তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নারী গৃহকর্মীদের করুণ পরিণতির কারণসমূহ
১. কাফালা ব্যবস্থা:
সৌদি আরবে প্রচলিত কাফালা (স্পন্সরশিপ) ব্যবস্থা গৃহকর্মীদের নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয়। এই ব্যবস্থায় নিয়োগকর্তা তাদের পাসপোর্ট জব্দ করে রাখতে পারেন, ফলে তারা পালিয়ে যাওয়ার বা অন্যত্র কাজ খোঁজার সুযোগ পান না। এটা একরকম বন্দিত্বের জীবন যাপন করতে বাধ্য করে বিদেশী কর্মীদের। মালিকের মর্জির উপরে নির্ভর করে তাদের বাঁচা-মরা। অনেক মালিক গৃহকর্মীদের প্রতি নির্মম আচরণ করেন, এমনকি যৌন হয়রানিও করেন। অনেক ক্ষেত্রে, এসব নির্যাতনের শিকার নারীদের হত্যা করা হয় বা আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয়। মালিক এমনই ক্ষমতাধর বনে যান যে, বিদেশী নারী গৃহকর্মীকে ধর্ষন করা তাদের জন্য ডালভাতের মত। কারণ, তারা জানেন, এদেরকে মেরে ফেললে সৌদি আইনে বিচার তেমন কিছুই হবে না। কিছু অর্থ খরচ করলেই স্বাভাবিক মৃত্যু দেখিয়ে পার পাওয়া রীতিমত রেওয়াজে পরিণত হয়েছে সৌদি সমাজে।
২. আইনের দুর্বল প্রয়োগ:
যদিও সৌদি সরকার শ্রম আইন সংস্কার করেছে, তবে বাস্তবে অনেক গৃহকর্মী এখনও শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকেন। সৌদি আইনের দুর্বল প্রয়োগের কারণে অনেক গৃহকর্মী সুবিচার পান না। অভিযোগ করলে অনেক সময় উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলা হয়। স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও প্রবাসী নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, সৌদির আইন সৌদিদের রক্ষার জন্যই। বিদেশী যারা গৃহকর্মী হিসেবে দেশটিতে যান, এদেরকে সৌদি আরবের সমাজে যেমন স্রেফ ফকির মিসকিন হিসেবে ট্রিট করা হয়, দুঃখজনকভাবে আইন প্রয়োগকারী অধিকাংশ লোকের কাছেও অনেকটা তেমনই। উপেক্ষা, অবহেলা, অবজ্ঞা, লাঞ্চনা, বঞ্চনা ছাড়া ফকির মিসকিনরা আর কীইবা পেতে পারে? নিয়োগকর্তাদের অধিকাংশের নিকটেই এসব ফকির মিসকিনদের জীবনের দাম দুই পয়সাও থাকে না। এগুলো বাস্তব অভিজ্ঞতারই বয়ান।
৩. শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন:
নারী গৃহকর্মীরা প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। কিছু ক্ষেত্রে, তাদের দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়, অমানবিক কাজ করানো হয়, খাবার কম দেওয়া হয় এবং পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ দেওয়া হয় না। নির্যাতনের চরম পর্যায়ে অনেক গৃহকর্মী গুরুতর আহত হন বা মৃত্যুবরণ করেন।
৪. প্রতারণামূলক চাকরির প্রস্তাব:
অনেক নারী কাজের প্রলোভনে মধ্যপ্রাচ্যে যান, কিন্তু বাস্তবে তাদের প্রতারণার শিকার হতে হয়। চাকরির বিজ্ঞাপনে উচ্চ বেতনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে তারা নামমাত্র বেতন পান এবং প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হন। দালাল চক্রের মাধ্যমে অনেক নারীকে সৌদি আরবে পাঠানো হয়, যারা পরে ভয়াবহ শোষণের শিকার হন।
৫. ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য:
অনেক নারী গৃহকর্মী স্থানীয় ভাষা না জানার কারণে নিজেদের সমস্যাগুলো কাউকে বোঝাতে পারেন না। ফলে তারা একরকম নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে বাধ্য হন এবং তাদের কষ্টের কথা প্রকাশ করতে পারেন না। এ কারণে নির্যাতনের শিকার হলেও তারা আইনগত সাহায্য নিতে পারেন না।
কীভাবে এই পরিস্থিতির উন্নতি করা সম্ভব?
১. কাফালা ব্যবস্থার সংস্কার বা বিলোপ:
শ্রমিকদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নিকৃষ্ট কাফালা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করা প্রয়োজন। শ্রমিকদের চাকরি পরিবর্তনের স্বাধীনতা দিতে হবে এবং তাদের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সৌদি সরকারকে এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যা গৃহকর্মীদের ওপর নিয়োগকর্তার অতিরিক্ত ক্ষমতা কমিয়ে আনবে। নিয়োগকর্তার নিকট থেকে গৃহকর্মীদের জীবন মৃত্যুর মালিকানার তথাকথিত ক্ষমতা কেড়ে নিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশী গৃহকর্মী, যারা অর্থোপার্জনের জন্য সৌদি আরবে গমন করে থাকেন, নিয়োগকর্তাদেরকে এটা বুঝতে দিতে হবে যে, তারাও মানুষ। এই ভাব ও ভাবনা তাদেরকে শেখানোর দায়িত্ব সৌদি সরকারকে অবশ্যই নিতে হবে।
২. সৌদি সরকারের আরও কঠোর আইন প্রণয়ন:
গৃহকর্মীদের সুরক্ষা দিতে আরও কঠোর শ্রম আইন এবং তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। যাতে গৃহকর্মীগণ নির্যাতিত হওয়ার সাথেসাথেই অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেন।
৩. উৎস দেশগুলোর ভূমিকা:
বাংলাদেশ, ফিলিপাইন, কেনিয়া, ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোর উচিত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত নীতিমালা গ্রহণ করা এবং বিদেশে কাজ নেওয়ার আগে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও তথ্য প্রদান করা প্রয়োজন, যাতে তারা প্রতারণার ফাঁদে পা না দেন।
৪. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভূমিকা:
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো সৌদি আরবের প্রতি চাপ প্রয়োগ করতে পারে, যাতে তারা গৃহকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। আন্তর্জাতিক মহলকে এই ইস্যুতে আরও সক্রিয় হতে হবে এবং সৌদি আরবের ওপর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।
৫. ভুক্তভোগীদের জন্য সহায়তা কেন্দ্র:
সৌদি আরবে বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের দূতাবাসগুলোকে আরও কার্যকরভাবে গৃহকর্মীদের জন্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। নির্যাতিত নারীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে, যেখানে তারা নিরাপদ আশ্রয় ও আইনি সহায়তা পাবেন।
৬. গণসচেতনতা বৃদ্ধি:
সৌদি আরবে কর্মরত নারী গৃহকর্মীদের অধিকার সম্পর্কে স্থানীয় জনগণ ও বিশ্ববাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে এই বিষয়টি তুলে ধরতে হবে, যাতে বিশ্ব সম্প্রদায় এ বিষয়ে সোচ্চার হয়।
উপসংহার
নারী গৃহকর্মীদের প্রতি সৌদি আরবে যে নির্যাতন চলছে, তা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এটি বন্ধ করতে হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, শ্রম আইন সংস্কার এবং সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য। সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও এ বিষয়ে সোচ্চার হতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:১৯