বিশ্ব রাজনীতিতে "ডিপ স্টেট" শব্দটা যেন এক অদৃশ্য ভূতের মতো। সবাই এর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ করে, কিন্তু কেউই প্রমাণ হাতে পায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ট্রাম্পের সময় থেকে এই শব্দটা আলোচনার কেন্দ্রে এলেও, সত্য হলো—ডিপ স্টেট শুধু আমেরিকার বিষয় নয়। ডিপ স্টেট হলো এমন একটি শক্তি, যা সরকারি কাঠামোর ভেতরেই কাজ করে কিন্তু জনগণের সামনে কখনোই আসে না। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, কর্পোরেট লবি, আমলাতন্ত্র এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থ জড়িত শক্তিগুলো মিলে একটি ছায়া সরকার তৈরি করে। নির্বাচিত সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পরিচালনা করা, এমনকি প্রয়োজন হলে সরকার বদলানো—এসবই তাদের এজেন্ডার অংশ।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে ক্ষমতার কাঠামো বদলেছে। কিন্তু এটা কি নিছকই জনগণের জয়, নাকি বৈশ্বিক স্বার্থ জড়িত ছিল? বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় প্রায়ই আন্তর্জাতিক চাপ বা সংযোগ থাকে:
@ ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক শাসন কায়েম হয়, যেখানে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভূমিকা ছিল বলে বহু গবেষক মনে করেন।
@ ১৯৯০: স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটে এক গণআন্দোলনের মাধ্যমে, কিন্তু পর্দার আড়ালে আন্তর্জাতিক নীতিগত সমর্থনও ছিল।
@ ২০০৭: জরুরি অবস্থা, যেখানে সামরিক নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসে, আন্তর্জাতিক চাপের কথা সেই সময় বারবার আলোচিত হয়েছে।
@ ২০২৪: আবারো এক বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন। কিন্তু এটি কি সম্পূর্ণ দেশীয় আন্দোলনের ফল, নাকি আরও গভীর কিছু?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সবসময় বৈশ্বিক শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে। ভারত, চীন, আমেরিকা—সবাই এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে চায়। আর এজন্য কখনো সরকারকে সমর্থন দেয়, কখনো অস্থিরতা তৈরি করে, কখনো গণআন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে।
বিশ্ব রাজনীতিতে চীন তার "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)" নীতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশকে নিজেদের অর্থনৈতিক বলয়ে নিয়ে আসছে। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, আফ্রিকার বহু দেশ চীনের বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে।
ভারত, তবে, চীনের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার পথে হাঁটেনি। বরং বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চেয়েছে। ভারতের নীতিতে কী পাওয়া যায় ? দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে বাংলাদেশকে একটি নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মধ্যে রাখা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চললে ভারত তার আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখতে সুবিধা পায়। সীমান্ত নিরাপত্তা, নদীর পানিবণ্টন, ট্রানজিট সুবিধা—এসব ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা অনেক সময় বাংলাদেশবিরোধী মনে হয়েছে। এটি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ১৬ ডিসেম্বরকে শুধুমাত্র পাকিস্তানের পরাজয়ের দিন হিসেবে ব্যাখ্যা করেন, বাংলাদেশের বিজয়ের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেন। এটা কি শুধুই কূটনৈতিক ব্যাখ্যার সমস্যা, নাকি ডিপ স্টেটের পরিকল্পনার অংশ?
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে নতুন শাসন কাঠামো তৈরি হয়েছে। কিন্তু ছয় মাস পরও রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা পুরোপুরি ফিরে আসেনি। বিনিয়োগ কমে গেছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে। এখনও বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপ রয়েছে, নীতিগত পরিবর্তন স্পষ্ট নয়। সাধারণ মানুষ আশা করেছিল দ্রুত পরিবর্তন আসবে, কিন্তু বাস্তবে বড় সংস্কার এখনও চোখে পড়ছে না। এখন প্রশ্ন, এই পরিবর্তন কি সত্যিই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন, নাকি এটি ছিল আরও বড় কিছুর অংশ?
সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের রাজনৈতিক নাটক যতই অভ্যন্তরীণ মনে হোক, এর পেছনে আন্তর্জাতিক স্বার্থ জড়িত। আমরা কি নিজের ভবিষ্যৎ নিজের হাতে নিয়েছি, নাকি অন্য কারও পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এগিয়ে চলছি ? ডিপ স্টেট কি কেবল একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, নাকি বাস্তবতা ? যদি সত্যিই এটি থাকে, তাহলে বাংলাদেশ কি এর বাইরে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে এখনই। অন্যথায়, হয়তো আমরা নিজের দেশে পুতুল হয়ে থাকব—পরিবর্তন ঘটবে, কিন্তু আমাদের নিয়ন্ত্রণে কিছুই থাকবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:২৩