ঈদের পরের দিন বাড়ী থেকে বের হলাম। খালা বাড়ী নানা বাড়ী ঘুরে ২২ তারিখ এক ছোট ভাই কাম বন্ধুকে নিয়ে রওয়ানা হলাম খুলনার উদ্দেশ্যে। বরিশাল থেকে ঝালকাঠি , পিরোজপুর , বাগেরহাট হয়ে খুলনা। মাত্র ৩ বা সাড়ে তিন ঘন্টার পথ।
নথুল্লাবাদ বাস স্ট্যান্ড থেকে প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে গাড়ীতে চেপে বসলাম দুজনে। সরকারী বাসের করুন দশা দেখলাম আবারো । বাসের ছাদ চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রায় সব সিটই ভিজে একাকার। কি আর করা ভিজা সিটই ভাগ্যে ছিলো মনে নিয়ে বসে পড়লাম । বন্ধু কাম ছোট ভাই লজ্জার মাথায় শার্ট পড়িয়ে ভিজা শার্ট খুলে গাড়ীতেই গেঞ্জি পড়ে নিলো।
মাত্র ১.৩০ ঘন্টায় পিরোজপুর বেকুটিয়া ফেরী ঘাটে চলে আসলাম কিন্তু কপাল মন্দ থাকলে যা হয় তাই হলো......... ফেরী ঘাটে বসে থাকলাম আড়াই ঘন্টা। একটি মাত্র ফেরী গাড়ী পারাপারে নিয়োজিত । কিন্তু এপারে ওপারে গাড়ীর লম্বা সিরিয়াল এর মাঝে আবার এমপির প্রোটেকলের গ্যারাকলে পড়ে এক ঘন্টা লস।
অবশেষে ফেরী পার হয়ে পিরোজপুর, বাগেরহাট অতিক্রম করে আমাদের বাস যখন খুলনা রূপসা ব্রীজে নামিয়ে দিলো তখন রাত ৮.৩০। বাস থেকে নেমে খুব ভালো লাগলো । অত্যন্ত চমৎকার পরিবেশ। মেহমান হলাম রূপসার তীরে বাড়ীওয়ালা বন্ধুর।
ওর বাসায় ব্যাগ রেখে আর হালকা রেষ্ট নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রূপসা ব্রীজের চমৎকার পরিবেশের খোঁজে। রাত ১০.০০ থেকে ঘন্টাখানেক ব্রীজের কাটিয়ে মনটা ফ্রেস লাগছিলো। দেশের অন্যান্য ব্রীজগুলো থেকে রূপসা ব্রীজের পার্থক্যটা হলো ...... ব্রীজের দুই প্রান্তেই নদীর তীরে রয়েছে পায়ের হেটে ব্রীজে উঠার আলাদা ২ টি করে ৪ টি সিঁড়ি এবং দুইপ্রান্তেই বিশাল বিশাল ল্যান্ডিং স্পেস। অনেক উঁচু ব্রীজের এই চমৎকার নির্মাণ ব্রীজের আশেপাশে পরিবেশকে অনেক সুন্দর ও মনরোম করেছে। অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে ব্রীজের লাইটিং এ অসংখ্য মানুষের আনাগোনাই এর আকর্ষন প্রমান করে।

নোকিয়ার সবচেয়ে কমদামী মোবাইলে তোলা ব্রীজের এক পাশের সিড়ি...
ব্রীজ থেকে একটা অটো নিয়ে ঘুরে আসলাম শহরটা। রয়েল, ময়লাপোতা মোড় , আলিয়া মাদ্রাসা আরো কি কি যেন। বন্ধুর বাসায় ফিরে আসছিলাম তখন প্রায় রাত ১২ টা। পথে ধরলো পুলিশ চেক পোস্ট । পরিচয় দিয়ে ঘুরতে আসছি বলার পর তেমন ছাড়া পেয়ে বাসায় আসলাম । রাতে বড় বড় চিংড়ী মাছের স্বাদটা এখনো জিহবায় লেগে আছে মনে হচ্ছে।
পরদিন সকালে মোংলা আর ষাট গম্বুজ মাজারের উদ্দেশ্যে সিডিউল করলেও যাত্রার পূর্বেই মোংলা বাদ দিতে হলো কারণ , পরিচিত যার মাধ্যমে যাবো তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। গন্তব্য ঠিক করে বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
আগে খান জাহান আলীর(রহঃ) এর মাজারে গেলাম। তেমন ভীড় নেই। খুব সকাল হওয়ায় অল্প কিছু দর্শনার্থী আর মাজার জিয়ারতের লোক চোখে পড়লো। কয়েক পোজ দিয়ে ছবি তোলা কার্যক্রম অব্যাহত রাখলাম।
খান জাহান আলী(রহ) এর মাজার
ওজু গোছলে ব্যস্ত দর্শনার্থী ও জিয়ারতে আসা মানুষেরা
কয়েক পোজে মাজার সহ ছবি তোলো মাজার সংলগ্ন বিশাল দীঘির ঘাটলায় চলে গিয়ে নির্মল হাওয়া খেলাম । কিছু মানুষ মাজার জিয়ারত করতে এসে ওজু গোছল সেড়ে নিচ্ছিল । আর পবিত্রতা অর্জন করে জিয়ারত করার জন্য বারবার মাইকিং করছিলো নিয়োজিত খাদেমরা । মাজারের অভ্যন্তরে গিয়ে খান জাহান আলী(রহ) এর রুহের মাগফিরাত কামনা করে বের হয়ে আসলাম।
খান জাহান আলী (রহ) এর কবর
মাজারের গেটে দেখা মিললো কিছু দেওয়ানা নাকি অন্য কোন নাম দিবো বুঝতেছি না ......
উহারা আছে ধান্ধায়...... আমার বন্ধু এদের একজনের সাথে ছবি তুলতে চাইলে ৫০ টাকা চেয়ে বসলো .....
অল্প সময়েই মাজার দর্শন শেষ করে পরবর্তী গন্তব্য ষাট গম্বুজ মসজিদে যাত্রা করলাম। প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের টিকেট মূল্য মাত্র ১০ টাকা।

টিকেট মাত্র ১০ টাকা
মসজিদ এলাকায় প্রবেশ করেই হাতের ডান পাশে বাগেরহাট যাদুঘর । দর্শনার্থী প্রবেশের জন্য উম্মুক্ত হওয়ার সময়ের পূর্বেই চলে যাওয়ায় যাদুঘরে শুরুতে প্রবেশ করতে না পেরে চলে গেলাম মসজিদ এলাকায়।
প্রায় ৫৫০ বছর পূর্বে তৈরীকৃত এই মসজিদ এখনো তার শক্তি ও সৌন্দর্য্য অটুট রেখেছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
মসজিদের প্রবেশ পথ
মসজিদের মূল গেট
অনেক দর্শনার্থী । ঘুরে ঘুরে পুরো মসজিদ দেখলাম। মসজিদের মিম্বার , পিলার, গম্বুজ ইত্যাদি সবকিছুই কয়েকশত বছরের সাক্ষী হিসেবে দাড়িয়ে আছে এখনো। বিরাট মসজিদ সে তুলনায় মাত্র এক দুই কাতার মুসুল্লী হয় সম্ভবত নামাজের সময়, তা কার্পেট বিছানো দেখেই বুঝা যায়। মসজিদের অভ্যন্তরে শক্ত ইটের মেঝ কালের সাক্ষী হিসেবে বিদ্যমান।
ঘুরে ঘুরে গুনলাম গম্বুজ , পিলার , দরজা সংখ্যা। একটি মাত্র পিলার যা দর্শনার্থীদের দেখার জন্য সংরক্ষিত রয়েছে।
থামের উপরে দাড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী
মসজিদের মিম্বারটিও ঐতিহ্য বহন করছে..
এই সব মজবুত থামের উপরে দাড়িয়ে আছে ....

যে থামটি দর্শনার্থীদের দেখার জণ্য উম্মুক্ত রাখা হয়েছে

মসজিদের পিছনের প্রাচীর
পিছনের গেট...... যেখান দিয়ে দীঘির পাড়ে যাওয়া যায়
এখানেও রয়েছে বিশাল দীঘি ...... রয়েছে ভালো লাগার মতো একটি সুন্দর পরিবেশ
মসজিদের বহিরাঙ্গনের সৌন্দর্য্য
বাগেরহাট যাদুঘর
ষাট গম্বুজ মসজিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখানে........
যা বলা আছে ..............
ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ , বাগেরহাট
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
বাংলাদেশের বৃহত্তর আয়তকার (১৬০'*১০৮') অপূর্ব কারুকার্য খচিত ১৫শ শতাব্দীর ও অধিক কালের প্রাচীন এই মসজিদ।
স্থাপত্য কৌশলে ও লাল পোড়া মাটির উপর লাতা পাতার অলংকারণে মধ্যযুগীয় স্থাপত্যে শিল্পে নির্মিত এই মসজিদ এক বিশেষ স্থান অধিকার করিয়া আছে।যদিও ইহা ষাট গম্বুজ নামে বর্তমানে পরিচিত চতুস্কোন বুরুজের উপর ৪টি গম্বুজ সহ ইহাতে মোট ৮১টি গম্বুজ আছে এবং পূর্ব পশ্চিমে মধ্যের সারিতে বাংলা চালের অনুরূপ ৭ টি চৌকোনা গম্বুজ রহিয়াছে। বিশেষ ভাবে লক্ষ্যনীয় যে, ভিতরের অংশের নকশাকৃত চৌচালা ছাদ ও গম্বুজ গুলির অধিকাংশ পাথরের নকশাকৃত ষাটটি স্তম্ভ/থাম্বার দ্বারা সমর্থিত খিলানের উপরে নির্মিত। ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে পঞ্চদশ শতাব্দীর এদেশীয় ও তুর্কি স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ইটের বিরাট বিরাট দেওয়াল , পোড়ামাটির ফলকে কেবলা দেওয়ালে অপূর্ব নকশাকৃত দশটি মিহরাব, বক্র কার্নিশ ও পশ্চিম দেওয়ালের পৃথক একটি প্রবেশ পথ ষাট গম্বুজ মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত ইহা ছিল প্রাচীর রাজধানী শহরের (খলিফাতাবাদ) প্রশাসনিক কেন্দ্র তথা দরবার হল , জামে মসজিদ। আনুমানিক ১৪৫৯ খ্রীস্টাব্দের কিছু পূর্বে খানুল আজম উলুঘ খাঁন জাহান (আলাইহির রাহমাতুল্লা ওয়াল গুফরান) ইসলামের সাধক ও এক মহাপুরুষ এই মসজিদটি নির্মান করেছিলেন। বৃটিশ আমলের লর্ড কার্জনের সময় হইতে ২০০২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এই মসজিদটি সংস্কার হয়। বর্তমানে ইহা একটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত অন্যতম ঐতিহাসিক সংরক্ষিত প্রত্মতত্ত্ব নিদর্শণ।
................................................. প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তর।
ষাট গম্বুজ মসজিদের খেদমতে নিয়োজিতদের কাছে শুনলাম এর নামকরণের কিছু কথা..............
ষাট গম্বুজ মূলত ষাটটি পিলারের উপরে নির্মিত । ফার্সিতে গম্বুজ মানে পিলার বুঝানো হয়। যেহেতু ষাটটি পিলারের উপরে নির্মিত তাই নাম হয়েছে। ষাট গম্বুজ ।
আরেকটি বিষয় হলো ............ মসজিদটি অন্যান্য মসজিদের মতো কোন ভীমের উপরে ছাদ দিয়ে নির্মিত নয়। কোন প্রকার বড় ব্যবহার করা হয়নি ছাদ নির্মানে। বিশেষ পদ্ধতিতে ছাদের উপরে নির্মিত হয়েছে মসজিদ। গম্বুজের আকৃতিতে ছাদ নির্মিত বলে ছাদ গম্বুজ নামকরা হয় কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ছাদ গম্বুজটি ষাট গম্বুজে রূপান্তরিত হয়।
উপরের দুটি বিষয়ই মসজিদের নিয়োজিত খাদেমের কাছে শুনেছি।
সেখানে দেখা হলো ঢাকা থেকে আরো কিছু বন্ধুদের সাথে । ষাট গম্বুজ মসজিদে তাদের সাথে কিছু ছবি তুলে আর আড্ডা মেরে আমরা যাদুঘর দেখার জন্য গেলাম। ওরা মাত্র মসজিদে আসলো আর বাগেরহাটে লাঞ্চ করে খুলনা হয়ে যশোর যাবে কিন্তু আমরা সেদিই ঢাকা ফিরবো বলে আর ওদের সাথে বেশীক্ষন থাকা হলো না ।
যাদুঘরে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে বের হয়ে খুলনার পথ ধরলাম। বাগেরহাটের ছায়া ঘেরা সুন্দর মনোরোম পরিবেশ সবচেয়ে বেশী আকর্ষিত করেছে আমদের। একপাশে চিঙড়ীর ঘেড় আর সবজির ক্ষেত দেখলে সত্যিই চোখ জুড়িয়ে যায়। অল্প কিছুক্ষন বাগেরহাট জেলায় থাকলেও স্মৃতির পাতায় সংযুক্ত হলো বাগেরহাটের সুন্দর ভ্রমনটি।
সামনে খুবি আর কুয়েটের ভ্রমন নিয়ে থাকবে পোস্ট । অগ্রীম নিমন্ত্রন রইল।