২০১০ সালের ২৩ জানুয়ারী। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনদিনের হঠাৎ ছুটীর খবর শুনে বন্ধু জামিল আর রায়হানের সাথে গল্প করতে করতে ডিসিশন নিয়ে ফেলি খুলনা অঞ্চলে ট্যুর করতে যাবো। রুমমেট রাজনও রাজী হয়ে গেল। পাশের রুমে আরেক বন্ধু মিল্টন যোগ দিল আমাদের সাথে। হুট করে ছুটী আবার মাসের শেষ, টাকাপয়সার টানাটানি থাকলেও ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যে ম্যানেজ করতে পারলাম।
খুলনার পথেঃ
দুপুরে ডাইনিং-এ খেয়ে পাঁচজনে বেরিয়ে পড়ি। রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে খুলনাগামী একটা বাসের দেখা পাই, ঢাকা হতে আসছিল। বেলা ৩-৪৫ নাগাদ যাত্রা শুরু করি। লোকাল বাস, থ্রী স্টু টু সীট, জায়গায় জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেক সময় পার করলো খুলনা পৌঁছাতে। রাত প্রায় ৮ টার দিকে খুলনার সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নামি। এখানেই রাতের খাবার খেয়ে ইজিবাইকে করে ‘নিরালা আবাসিক এলাকা’য় চলে যাই। তাবলীগ মসজিদের পাশেই অবস্থিত। মিল্টনের এক স্কুল ফ্রেন্ড নাইমের বাসা এখানে, ও আগেই যোগাযোগ করে রেখেছিল। নাইম আর তপু নামে হাসিখুশি একটা ছেলে এখানে আমাদেরকে রিসিভ করে ওদের বাসায় নিয়ে যায়। এক বাসায় পাঁচজন থাকে- সবাই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। রাতে এলাকা ঘুরে দেখি। খুলনা বেশ সুন্দর আর গোছানো শহর মনে হল। অনেক অবকাঠামো আছে, সে অনুযায়ী লোকসংখ্যা কম। রাস্তাঘাট বিশাল বিশাল, অন্য বিভাগীয় শহরগুলোর মত ততটা জ্যাম নেই। রাতে নাইমরা আমাদেরকে বাসার একটা রুম ছেড়ে দেয়- ওখানেই রাতটুকু কাটিয়ে দিই।
পরদিন আমরা পাঁচজন সকাল ৮ টার দিকে বেরোই। খুলনা অঞ্চলে ভ্যানের খুব প্রচলন। ভ্যানে করেই মানুষ কাছে-দূরে আসা যাওয়া করে। একটা ভ্যান ভাড়া করে গল্লামারী নামক স্থানে পৌঁছি। মোটামুটি গল্লামারী থেকেই আশেপাশের সব স্থানে যাওয়া যায়। গল্লামারী মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে হাজার হাজার বাঙ্গালীকে হত্যা করে পাকিস্তানী এবং রাজাকার-আলবদর বাহিনী। খুলনা শহর মুক্ত হবার পর গল্লামারী খাল ও এর আশে পাশের স্থান থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড় গোড় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় ঐ স্থানে আনুমানিক ১৫০০০ মানুষ হত্যা করা হয়।
গল্লামারীতে সকালের নাস্তা করে বাগেরহাটের বাসে উঠে পড়ি। খুলনার রুপসা নদীর উপরে খান জাহান আলী সেতু পার হয়ে যেতে হয়। মাত্র এক ঘন্টা পরেই বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের সামনে বাস আমাদের নামিয়ে দেয়।
ইতিহাসের বাগেরহাটঃ
দশ টাকা করে টিকেট। মসজিদ ঘুরে দেখি। হযরত খান জাহান (র) এই মসজিদটি তৈরী করেন। যদিও নাম ষাট গম্বুজ, এতে মোট ৮১ টি গম্বুজ আছে। মসজিদের সাথে একটা জাদুঘরও আছে, নাম বাগেরহাট জাদুঘর- তবে তা বন্ধ থাকায় দেখতে পারিনি। এ বিশাল মসজিদের চারদিকে প্রাচীর ৮ফুট চওড়া এবং এর চার কোনে চারটি মিনার আছে। দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম রোশনাই কুঠির এবং এ মিনারে উপরে উঠার সিড়ি আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ
অভ্যন্তরে পিলারগুলো সংরক্ষণের জন্য ইট দিয়ে ঢাকা- একটামাত্র খোলা দর্শনার্থীদের দেখার জন্য। বড় বড় পাথর বসিয়ে পিলারগুলো তৈরী। পরে রাস্তার অপর পাশে সিঙ্গাইর মসজিদটাও দেখে আসি। ষাটগম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে মধ্যযুগীয় এই মসজিদটি অবস্থিত। এটি একগম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ।
সিংগাইর মসজিদ
এরপর আবারো ভ্যানে করে খান জাহান আলীর মাজার চলে যাই। ষাট গম্বুজ মসজিদ হতে দেড় কি মি দূরে। খান জাহান আলী উলুঘ নামক কোন এক তুর্কী পরিবারের সন্তান । কোন কোন লেখকের মতে তিনি পারস্য মতান্তরে আরব দেশ থেকে এ দেশে আসেন । গৌড়ের সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের প্রতিনিধিরূপে তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে বাগেরহাট অঞ্চলে বিশাল জনপদ সৃষ্টি করেন এবং রাজ্য বিস্তার করে শাসন কাজ চালাতে থাকেন। সে জন্যই তিনি এ অঞ্চলের নামকরণ করেন “খলিফাত-ই-আবাদ”। তাঁর মাজারের চারপাশটা ঘুরে দেখি।
খান জাহান আলী (র) -র মাজার
পাশেই প্রায় ২০০ বিঘা এলাকা জুড়ে বিশাল একটা দিঘী, খাঞ্জেলী দীঘি নামে পরিচিত। দীঘির প্রধান ঘাটটি প্রশস্ত ও সুন্দর। মহিলাদের জন্য আলাদা ঘাট আছে। এ দীঘিতে কালা পাহাড় ও ধলা পাহাড় নামক কুমিরের বংশধররা আজও জীবিত। দীঘিটা ঘুরে ওপর পাশে যেয়ে কুমিরের দেখা পেয়ে যাই। মাজারের একজন খাদেম টাকা তুলছে আর এই টাকার বিনিময়ে লোকজন কুমিরের পিঠে ছোঁয়া দেবার সুযোগ পায়- কুমিরের দেহ ছুঁয়ে যা চাওয়া হয় তা-ই নাকি পাওয়া যায়। মাজারের প্রবেশস্থলেই মেলা বসেছে- কিছু কেনাকাটা করি।
রোদ পোহাচ্ছেন সাহেব
এখান থেকে বের হয়ে খুলনাগামী বাসে করে চলে যাই চন্দ্রমহল। চন্দ্রমহল পিকনিক স্পট- বেশ সুন্দর জায়গা। প্রতিষ্ঠা করেছেন মিসেস নাসিমা হুদা চন্দ্রা এবং সৈয়দ আমানুল হুদা সেলিম। এখানে তাজমহলের অনুকরণে একটি মিউজিয়াম, একটি মিনি চিড়িয়াখানা আর বড় লেক আছে। কিছুক্ষণ ঘুরে দেখে বিকাল ৫ টা নাগাদ খুলনা শহরে ফিরে আসি।
চন্দ্রমহলের তাজমহল
রাতে খুলনা শহর, নিউমার্কেট আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখি। খুলনা শহর ছিমছাম, মন বসে যায়। নিউমার্কেটে স্পেশালী তৈরী ঘন দুধ দেয়া চা খাই। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় গল্লামারী হতে কাছেই। সুবিশাল ক্যাম্পাস। মোটকথা খুলনা-র সবই আমার ভালো লেগেছে।
করমজল,সুন্দরবনঃ
পরদিন ২৫ শে জানুয়ারী সকাল ৮ টা নাগাদ বেরোই। গাইড হিসেবে তপু আসে। গল্লামারী হতে নাস্তা করে মংলাগামী বাসে চড়ে বসি। ১১ টা নাগাদ মংলা পৌঁছে যাই। এখান থেকে ৩০০ টাকায় একটি ট্রলার ভাড়া করে পশুর নদীর উপর দিয়ে করমজল রওনা হই।
রাজকীয় ট্রলারে সুন্দরবনের পথে
করমজল
করমজল সুন্দরবনের শুরুতে একটি পিকনিক স্পট। বনের মাঝে কিছু জায়গা পরিষ্কার করে কাঠের ব্রীজ দিয়ে পথ করা হয়েছে। রাস্তার পাশেই বানরের দেখা মেলে। কিছু হকার বাদাম নিয়ে ঘুরছে, পর্যটকরাও বাদাম কিনে বানরকে খেতে দিচ্ছে। সুন্দরবনের বিখ্যাত সুন্দরী আর গোলপাতা গাছ দেখি। গাছের শ্বাসমূলেরও দেখা পাই। বিকালে জোয়ারের সময় পুরো বন পানিতে ডুবে যায়, তখন এই শ্বাসমূলের মাধ্যমে গাছ শ্বসনের কাজ করে। পাশেই কুমীর প্রজনন কেন্দ্র আছে। একটি মিনি চিড়িয়াখানা আছে- এখানে হরিণের দেখা পাওয়া যায়। বেলা ২ টার দিকে ট্রলারে করে পশুর নদীর অন্য পাড়ে মংলা শহরে নামি।
মংলা শহর-দ্বীপদেশঃ
মংলা শহর খুলনার অন্তর্গত। ঠিক যেন একটা দ্বীপ। এখানে বিদ্যুৎ এবং আধুনিকতার সব থাকলেও ইঞ্জিনচালিত বড় গাড়ি নেই। মূল ভুখন্ড হতে পশুর নদীর মাধ্যমে আলাদা হয়ে আছে। মংলা শহরে ভাত খেয়ে স্থানীয় সেইন্ট পল ক্যাথলিক চার্চে ফাদার মারিনো রিগানের সাথে দেখা করতে যাই। কথা হল ওনার সাথে। ইতালিয়ান এই ভদ্রলোক বাংলাদেশে আছেন বহুদিন ধরে। শেলাবুনিয়াতে তাঁর বসবাস। তিনি রবীঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, লালন শাহের সাড়ে তিনশো গান, পল্লীকবির নকশী কাঁথার মাঠ ও সোজন বাদিয়ার ঘাট বইগুলোর ইতালিয়ান অনুবাদ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করেছে। (এসুযোগে আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখিঃ ফাদার রিগান ছাড়াও কাজী নজরুল ইসলাম, অর্মত্য সেন, ভ্যালোরি টেলর এবং গর্ডন গ্রিনীজ বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পেয়েছেন।)
ফাদার রিগানের সাথে আমরা
ফাদারের উপহার দেয়া বই
ফাদার অনর্গল বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারেন। উনি নিজের অনূদিত একটি বাংলা বই ‘পিনোকিও’ অটোগ্রাফসহ আমাদের উপহার দিলেন। পরে চার্চের আশেপাশে ঘুরে দেখি। ইতালীয়ান একজন মুভিমেকারের সাথেও দেখা হয়ে যায়, ফাদার ও চার্চের উপর একটি ডকুমেন্টারী ফিল্ম তৈরী করতে এসেছে। ঘোরা শেষে নৌকাতে নদী পার হয়ে মাইক্রোবাসে খুলনা ফিরি। খুলনা শহরে নেমে খুলনা মেডিকেল কলেজে যাই। একাডেমিক বিল্ডিং, হোস্টেল ঘুরে দেখে রাত ৯ টায় বাসায় ফিরি। শহরে খুলনার বিখ্যাত ঘোষ ডেয়ারীর মিষ্টি, সন্দেশ, রসমালাই খাই।
নৌকাতে পশুর নদী পাড়ি
সাতক্ষীরাঃ
পরদিন সকালে আবারো গল্লামারী। এখান থেকে বাসে করে সাতক্ষীরা সদর চলে যাই। সদর হতে ভ্যান নিয়ে প্রায় ৬ কি ৭ কি. মি. পাড়ি দিয়ে মন্টুসাহেবের বাগানবাড়ী চলে আসি। বেশ সুন্দর স্পট। বিশাল এলাকা জুড়ে স্থাপন করা হয়েছে। বেশ জনপ্রিয় বোঝা গেল, ভালোই জনসমাগম হয়েছে। এখানে ঘন্টাখানেক থেকে আবার সাতক্ষীরা সদরে ফেরত আসি।
মন্টুসাহেবের বাগানবাড়ি-লেকের ধারে সারিবদ্ধ গাছের ছবি
মধুকবির যশোরঃ
সাতক্ষীরাতে লাঞ্চ করে নিয়ে বাসে করে চলে যাই পাটকেলঘাটা। সেখান থেকে আবার ভ্যানে কপোতাক্ষ নদের তীরে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদ আজ খাল- পানি খুবই কম, পানির নিচে ইট বিছানো পায়ে চলা রাস্তাও চোখে পড়লো, মনে হয় শুকনো মৌসুমে ব্যবহৃত হয়। এখন পানি থাকায় উপরের বাঁশের সাঁকো দিয়ে পার হয়ে যাই। অন্য পাড়ে যেয়ে স্থানীয় নছিমনে করে দুই কি. মি. পথ পাড়ি দিয়ে সাগরদাঁড়ি পৌঁছাই।
কপোতাক্ষ নদ
মধুকবির বাড়ির ছাদে
সাগরদাঁড়ি- কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ী ঘুরে দেখি। এখানে মধুসূদন একাডেমী আছে, একটা মিউজিয়াম আছে। ভালো সময়েই এসেছি, গতকালকেই(২৫ জানুয়ারী) কবির জন্মদিন ছিলো। তাই এখানে মধুমেলা হচ্ছে। প্রচুর লোকসমাগম, উৎসবমুখর পরিবেশ।
মধুকবির বাড়িতে
দেখে শেষে বের হয়ে তিনটি মোটরসাইকেলে দুইজন করে আমরা ছয়জন যশোরের কেশবপুর ফিরি। কেশবপুরে নাকি রাস্তাঘাটে, বাসা-বাড়িতে বানরের দেখা পাওয়া যায়- কিন্তু আমরা পেলাম না। মোটরসাইকেলে প্রায় ১৪ কি. মি. পথ পাড়ি দিই। তারপর আবারও বাসে করে যশোর শহর। শহর হতে ভ্যানে করে মণিহার সিনেমা হল, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সিনেমা হল। আজকে আবার বন্ধু রায়হানের জন্মদিন- একটা দোকানে কেক কিনে ওখানেই কাটার ব্যবস্থা করি।
মণিহার সিনেমা হল,যশোর
মাইক্রোবাসে করে ফরিদপুর রওনা হই। মাইক্রোবাসগুলো সকালে সংবাদপত্র নিয়ে আসে, রাতে আবার যাত্রী নিয়ে ঢাকা ফেরে। রাত ১১ টায় ফিরে আসি পরিচিত শহরে।
শেষকথাঃ
খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-যশোর ট্যুরে সবচেয়ে উপভোগ করেছি জার্নিগুলো। ভ্রমণে মোটামুটি সব ধরনের স্থল যানবাহনে উঠা হয়েছে- বাস, ভ্যান, ট্রলার, নৌকা, নছিমন, মোটরসাইকেল ইত্যাদি। খুলনা শহরটাকে খুব-খুব ভালো লেগেছে। ওখানে কেন থাকার সুযোগ এখনো হল না এই ভেবে আফসোসও হয়েছে। তাই গোপন পরিকল্পনা আছে খুলনা-র মেয়ে বিয়ে করে হলেও ওখানে যাবার ততদিন স্মৃতি রোমন্থন করেই না-হয় কেটে যাক!
তথ্যসূত্রঃ
১ http://www.khulna.gov.bd/
২ http://www.bagerhat.gov.bd/
৩ http://www.satkhira.gov.bd/
৪ http://www.jessore.gov.bd/
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৪৫