কোলকাতাভ্রমণ এর পর থেকে
১৯.০৭.১৪
ট্রেনের নাম যুবা(yuva) এক্সপ্রেস। ছাত্র এবং নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য বিশেষ ট্রেন- যার উভয় ক্যাটাগরিতেই আমরা সসম্মানে উত্তীর্ন। ট্রেনটার সবচেয়ে বড় ফিচার হল- ট্রেনটা সুপারফাস্ট, কোলকাতা থেকে দিল্লী মোট ১৪৫৯ রাস্তা পাড়ি দিতে সময় নেয় মাত্র ১৬ ঘন্টা। টিকেট আমরা দেশের একটা এজেন্সি থেকে করিয়ে রেখেছিলাম। তখন এজেন্সির লোকের কাছে স্লীপার টিকেট চাওয়ার পর সে যা বলেছিল তার সারমর্ম- “এটা যুবাদের ট্রেন।সত্যিকারের যুবারা ঘুমাবে কেন?!”। এই বাণীর পর আর কিছু বলার সুযোগ থাকেনা। অবশ্য ট্রেনে চড়ার পরপরই বুঝতে পারলাম যে এই ট্রেনে ঘুমানো এমনিতেই সম্ভব না! মুখোমুখি অল্প একটুখানি জায়গায় ছয় জনের বসার বন্দোবস্ত। ক্রিসক্রস করে কোনমতে পা রাখা যায়। এই অবস্থায় ১৬ ঘন্টা থাকতে হবে, সুপারফাস্ট ট্রেন ধুয়ে কি পানি খাবো নাকি!
ঘুম কপালে জুটবে না বুঝতে পেরে আড্ডার আসর বসানো হল। ট্যুরে গেলে সবাই বেশ দিলখোলা হয়ে যায়। যেসব সিক্রেট সারাজীবন চরম নিরাপত্তার সাথে আগলে রেখেছে সেসবও সামান্য উসকানিতেই ছিঁড়ে-ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকে। শুরু হল একের পর এক কনফেশান(যথারীতি আমি আর শফিক নিরব শ্রোতার ভূমিকায় চলে গেলাম)। এরপর কিছুক্ষণ ধর্ম নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা হল। এবং সবশেষে যা হয় তাই- কথার মোড় প্রাপ্তবয়স্কদের আলাপের দিকে ঘুরে গেল(not that I'm complaining...)। এমন নানা ফলপ্রসূ আলাপে রাতটা বেশ ভালোই কাটলো।
২০.০৭.১৪
প্রায় নির্ঘুম ভ্রমণ শেষে দুপুরের দিকে নিউ দিল্লী স্টেশনে ট্রেন থেকে নামলাম। বন্ধু জ্যোতির পরামর্শমাফিক হোটেল নিলাম পাহাড়গঞ্জ বাজারে; হোটেল সুইট হোমস। একদল বুরবক বিদেশী পেয়ে হোটেলের লোকজন আবেগে প্রায় কেঁদে ফেললো।আগের নোটটা পড়ে থাকলে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আমি ঘটি দাদাদের বিশেষ অনুরক্ত নই।তার কিছুটা কারণ এখনই পরিষ্কার করছি। হোটেলের রিসিপশনে এক কোলকাতার দাদা। আমাদের ট্যুরের র্যুট শুনে লোকটা বুক চাপড়ে উঠলো! ভাবখানা এমন যে এই সাধাসিধে যুবারা বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে তার দেখা না পেলেতো নির্ঘাত মারা পড়তো! থিতু হয়ে নিয়ে দাদা আমাদের একের পর এক ব্রেকিং নিউজ দিতে থাকলো। যা যা জানালো তার সারমর্ম, “আপনারা কি খবর-টবর দেখেন না নাকি! দুদিন ধরে তুমুল বৃষ্টির হচ্ছে সেদিকে। শীমলাই যাওয়া যাচ্ছে না, মানালী- লেহ যাওয়া তো ‘বহুত দূর কি বাত’! আমি বরং আপনাদের একটা প্যাকেজ দিচ্ছি। কষ্ট করে লাদাখ যাওয়ার দরকার নেই, এবেলা শ্রীনগর আর চণ্ডীগড় ঘুরে মানব-জনমটা সার্থক করে আসুন”। ঘটি দাদার হারামীপনায় অবাক না হয়ে পারলাম না। মানালী-লেহ, লেহ-শ্রীনগরের রাস্তার আপডেট আমরা নিয়মিতই ইন্টারনেটে রেখেছিলাম, সব নিউজ পজিটিভ ছিল। রাগ চেপে রেখে কোনরকমে বললাম যে, চণ্ডীগড় যাবোনা। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রুমের দিকে পা বাড়ানোর সময় ঘটির দীর্ঘশ্বাস শুনলাম, “চণ্ডীগড় নেহি দেখা তো ক্যায়া দেখা...!”।
রুমে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হওয়ার ধার না ধেরেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। একটা মাত্র বেলা থাকবো দিল্লীতে। জিরোবার সময় কই? হোটেলের পাশের একটা রেস্টুরেন্টে খাসির কোরমা দিয়ে কোনমতে(!) দুপুরের খাবার সেরেই ছুটলাম কাছে নিউ দিল্লী মেট্রো স্টেশনে; নামলাম কুতুব মিনার স্টেশনে।এরপর ট্যাক্সি নিয়ে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের মিনারে। জাতীয়তা তো সেই কোলকাতাতেই বিকিয়ে দিয়ে এসেছিলুম- তাই এখানে টিকেট কাউন্টারে ‘ইন্ডিয়ান’লাইনে ভীড়ে যেতে আর চক্ষুলজ্জাটাও অনুভব করলাম না। টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম। এমনিতে পুরান বাড়িঘরে আমার বিশেষ আগ্রহ নেই, কিন্তু মানতেই হলো মিনারটা রাজকীয়ই বটে! আকার ও উচ্চতায় জিনিসটা প্রকাণ্ড! দেয়ালে দেয়ালে কুরান শরিফের আয়াত খোদাই করা। কুতুব মিনারের ইতিহাস বলতে জানতাম শুধু সমাজবিজ্ঞান বইতে পড়া দুটো লাইন। ভাগ্যিস আয়াজ ইন্ডিয়া আসার আগে উইকিপিডিয়া গুলে খেয়ে এসেছিল! মিনার ও তার আশপাশ নিয়ে নানা জ্ঞান দিয়ে সবাইকে মজিয়ে রাখলো সে।
কুতুব মিনার। ছবি রাবার তোলা।
কুতুব মিনার থেকে বের হয়ে রওনা দিলাম ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদ দিল্লী জামে মসজিদের উদ্দেশ্যে। যেতে হবে পুরান দিল্লী। ফের মেট্রোতে চড়লাম, উদ্দেশ্য চাওরি বাজার। শম্বুক নোয়েল চিল করতে করতে ট্রেন মিস করলো। পরের ট্রেনে সে আসা পর্যন্ত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। মেট্রো স্টেশনে একদল পাঞ্জাবী পরা লোকের সাথে পরিচয় হল। আমাদের গন্তব্য জানতে পেরে উনারা পারলে আমাদের টিকেটের টাকাটাই দিয়ে দেন! রাস্তা চিনে কিভাবে যেতে হবে তা উনারাই বুঝিয়ে দিলেন। লোকগুলার আন্তরিকতা খুবই ভালো লাগলো।
চাওরি বাজার নেমে হাঁটা ধরলাম মসজিদের দিকে। পুরান দিল্লী দেখতে এক্কেবারে পুরান ঢাকার মত- আমি কোন পার্থক্যই পেলাম না। সরু সরু গলি, রাস্তা ভরা রিকশা আর অটো, আর রাস্তার দুপাশে নানা লোভনীয় খাবার আর মিষ্টির দোকান। পার্থক্য বলতে শুধু সেখানকার রিকশাগুলা চার সিটের। মিষ্টির দোকানগুলা দেখে শফিককে বেঁধে রাখাই কষ্ট হয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরেই দূর থেকে মসজিদ দেখতে পেলাম। রাস্তার পাশে লেখা আছে Delhi-6. আদিব মাসাক্কালিকে মনে করে ইমোশনাল হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে বসলো।Delhi-6
মাগরেবের আধা-ঘন্টা আগে পৌঁছুলাম মসজিদে। মসজিদের বাইরের রাস্তার দৃশ্য পুরান ঢাকার চক বাজারের মত। দু-পাশে ইফতারের দোকানের সারি। মানুষ ঠেলে হাঁটাই কষ্ট। কোনমতে ভীড় ঠেলে মসজিদের আঙিনায় ঢুকলাম। ঢুকে যে দৃশ্য দেখলাম তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। সকল বয়সের সকল শ্রেনীর হাজার হাজার মানুষ এসেছে সপরিবারে ইফতার করতে। অভাবনীয় এক দৃশ্য! আমরা নিজেরাও এক কোনে জায়গা নিয়ে বসে পড়লাম। মুসাফির হওয়ার অজুহাত দিয়ে পুরা ট্যুরে কেউ রোজা রাখিনি(এ নিয়ে একজন আরেকজনকে অপরাধবোধেও কম ভুগাইনি)। তবু সবার সাথে ইফতার করতে দোষ কোথায়? এক বাক্স খেজুর দিয়েই ইফতার সারা হল(ধর্ম-উদাসীন বন্ধুগণ তখন মসজিদের বাইরেই জম্পেশ ইফতার করছিল।)। ইফতার শেষে মাগরেবের নামাজ পড়তে মসজিদের ভেতরে গেলাম। মসজিদটা সম্রাট শাহ জাহানের বানানো। কিন্তু ভেতরে তেমন কোন আড়ম্বর নেই। মসজিদের ভেতর-বাইরে পুরোটায় একটা চক্কর দিলাম।দিল্লী জামে মসজিদ
নামাজ শেষে হাজার মুসল্লির ভীড়ে ঠেলে আবার পুরান দিল্লীর রাস্তায় নামলাম।
আবারো মেট্রো। এবার গন্তব্য শিখ ধর্মালম্বীদের প্রার্থনালয় ‘গুরুদওয়ারা বাংলা সাহিব’। এই জায়গাটা আমাদের গ্রুপের দুজনের জীবনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রথমজন রাবা। বেচারা তার দামি মোবাইলটা পকেটমারের কাছে হারালো। মন খারাপ করে সে ঘোষনা দিয়ে বসলো যে সে আজ রাতেই দেশে ফিরে যাবে। বেচারাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঠান্ডা করতে বেশ বেগ পেতে হল।
দ্বিতীয়জন আদিত্য। হ্যাঁ, এখন নাফিজ আমিন আদিত্যের ‘আদিত্য সিং’ হওয়ার কাহিনীটাই বলবো।
আমাদের বন্ধু আদিত্য সকল ধর্মকে অস্বীকার করেছে বহু আগেই। কিন্তু ‘গুরুদওয়ারা বাংলা সাহিব’ তাকে নতুন পথের দিশা দিল। আমাদের সকলকে নির্বাক দর্শক বানিয়ে সে শিখ ধর্মালম্বীদের সকল রিচ্যুয়াল পূর্ণ ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করতে থাকলো। কিভাবে যে কি হয়ে গেল তা আজো আমাদের বোধগম্য নয়! তবে এই দিনটিকে আরো স্মরণীয় করতে সর্বসম্মতিক্রমে এই worst atheist in the history of mankind কে আনুষ্ঠানিকভাবে “আদিত্য সিং” উপাধিতে ভূষিত করা হল।
ও হ্যাঁ, আজিম, তুই ঠিকই অনুমান করিছিলি। সুন্দরী দেখতে হলে গুরুদওয়ারার চেয়ে ভালো জায়গা আসলেই হয় না!গুরুদওয়ারা বাংলা সাহিব
রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। এখনো ইন্ডিয়া গেটটাই দেখা বাকি। গাড়ি না পেয়ে কিছুক্ষণ দোনামনা করে সবাই শেষমেষ হেঁটেই রওনা দিয়ে দিলাম সেদিকে। ভাগ্য খুবই ভালো যে কিছুক্ষণ পর অটো পেয়ে গেলাম। নইলে গুগল ম্যাপে দেখানো দূরত্ব পায়ে হাঁটতে গেলে হোটেলে আর আস্ত ফেরা লাগত না! ইন্ডিয়া গেটের চারপাশে ব্লক করা। এত রাতেও প্রচুর পর্যটকের ভীড়। ‘রাং দে বাসান্তি’ আমার দেখা সেরা হিন্দি মুভি। মুভিটা দেখার পর থেকে ইন্ডিয়া গেট দেখার খায়েশ ছিল; মিটলো।
রাত বারোটায় আমাদের এতিম করে দিয়ে মেট্রো বন্ধ হয়ে গেল। মেট্রো আর গুগল ম্যাপের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। এই দুইটা জিনিস থাকলে দিল্লী ঘুরতে আর কোন গাইডলাইন লাগে না।
দিল্লী এসেছি অথচ মুঘলাই কোন খাবার খাবো না! অতএব মাঝরাতেই পুনরায় পুরান দিল্লী গমন। সেখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট সম্ভবত কারিম’স। ইফতারের পর সেখানে জায়গাই পাইনি, রাস্তা পর্যন্ত বিশাল লম্বা তিনটা লাইন ছিল। এই মাঝরাতে জায়গা পেলাম। জায়গাটা ঠাঠারীবাজার স্টারের মতই, তবে দাম অতো কম নয়। কারিম’স এর ভেতর এমন একটা প্ল্যাকার্ড দেখলাম যেখানে লেখা- কারিম'স এর পূর্বসুরিরা মুঘল বাদশাহদের জন্য রান্না করতো। এই জিনিস পড়ার পর দাম নিয়ে আর আপত্তি করার সুযোগ থাকেনা। এই এক জায়গায় আমরা কোন কিপ্টেমী করলাম না। খাসি-মুরগির হরেক রকম কাবাব-কোরমা-রেজালা ভাগাভাগি করে উদরপূর্তি হল। শেষে তৃপ্ত ভূঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে মহা-ব্যাস্ত একটা দিনের সফল সমাপ্তি টানলাম।
দেশে ফেরার পর অনেক বন্ধুই এই প্রশ্নটা করেছে- “আগ্রার এত কাছ থেকে চলে এসেও কেন তাজমহল দেখলি না?”। তাদের জন্য গুরু মুজতবা আলীর বাণীটাই তুলে দেইঃ " আপনারা তাজমহল দেখে ' আহা আহা ' করেন, আমি করি না । কারন তাজমহল চিবিয়ে খাওয়া যায় না । আর খাস মোগলাই রান্না পেলেই আমি খাই এবং খেয়ে 'জিন্দাবাদ বাবুর - আকবর ' বলি -----
যদিও তারা বহুকাল হল এ জিন্দেগীর খাওয়া দাওয়া শেষ করে চলে গিয়েছেন ।"
........পঞ্চতন্ত্র ( আহারাদি )
অতএব বন্ধুগণ, কারিম’স বিটস তাজমহল......
এরপরের লেখাঃ ভারতভ্রমণঃ শীমলা
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:০৯