খুব ভোরে যখন বৈদ্যুতিক তাঁর গুলিতে ফিঙ্গেদের রাজত্ব চলে তখন কাকেরা হয়তো ঘুম ভেঙ্গে নগরীর আকাশে গা ভাসিয়ে উড়ে চলে না। এমনই এক ভোরে ঘুম কাতুরে চোখে বিছান ছেড়েছে সৌরভ। ফিঙ্গের রাজ্যে বেরিয়ে পড়েছে। আজকাল ফিঙ্গে দেখতে পাওয়া যায় খুব কম। রাতভর খুব একটা ঘুম হয়নি। এটা অনেক দিনের পুরনো অভ্যেস। অভ্যাস মানুষের দাস। যে যেভাবে যে জিনিসে পরিশ্রম করবে ধীরে ধীরে সেটাই তাঁর অভ্যেসে পরিণত হবে। অভ্যেস থেকে বদ অভ্যেস।
মেচের শেষ দিন ছিলো আজ। সব গোছগাছ করেই বেরিয়েছে। চার তলা বাড়ির তিন নম্বর ফ্লোরের কোনার রুমটাতে দীর্ঘ চার বছর কাটিয়েছে। বাড়িটার গা ঘেষে আরেকটি বাড়ি। তিন তলার। সৌরভের জানালা খুললে পাশের বাড়ির একেবারে উপরের ফ্লোরটার ভেতরের কিছু দৃশ্যপট স্পষ্টই দেখা যায়। শিলা নামের একটি মেয়ে এই ফ্লাটে থাকে।
বিকেল বেলা জানালা খুলে পূব আকাশের দিকে চেয়ে গান ধরে। সৌরভের চোখাচোখি হয়েছিল প্রথম আসার দু একদিন পরই।
এক বিকেলে। গোধূলির শেষ লগনে সৌরভের কবিতা আবৃত্তির চর্চা কালে। কবিতা আবৃতি সৌরভের পুরনো অভ্যেস গুলির একটা। জানালার এপাশ থেকে ওপাশে দুটি প্রাণ যেন আবদ্ধ হয়েছিল সেদিন কোন অজানা এক প্রাপ্তির মিলন মেলায়। সৌরভের কবিতার পংক্তি গুলি যেন প্রাণ ফিরে পাচ্ছিলো। শিলার মিষ্টি গানের সুর আর এপারের ভাসমান কবিতার লাইন গুলি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। এক টুকরো মন ভোলানো হাসির ঝলকানি সৌরভের বুকে তীর ছুড়েছিল।
সৌরভ হাটছে। সব স্মৃতি পিছু ফেলে এগিয়ে চলেছে। শিলার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হয়নি।
ওকে বলা হয়নি এই শহরে আর বুঝি আসা হবে না। যাবার আগে জানালা খুলে একটা চিঠি রেখে এসেছে সেখানে। চিঠিটা শিলা পড়বে। নিশ্চয়ই পড়বে। এ পাশের ঘরে যে ওর আসা যাওয়া আছে। দুজনের দীর্ঘ স্মৃতি গুলি এভাবেই পিছু ফেলে এগিয়ে চলেছে সৌরভ। গ্রামে ফিরতে হবে। গ্রামের ছেলে গ্রামে ফিরে যাবে। হয়তো ছোটখাটো কোন চাকরী যোগাড় করে নেবে।
পড়াশুনা আর হবে বলে মনে হয় না। বিবিএ শেষ করেছে মামার খরচে।
বাবার সামর্থ্য কোথায়? একটা মুদি দোকান গ্রামে। অল্প কিছু যা রোজগার হয় সবই সংসারের পিছে চলে যায়।
মাথার উপর অনেক দেনা! অনেক ঋন। ঋনমুক্ত হতে চাই সৌরভ। মামার ঋন কিভাবে শোধ করবে?
শিলা মেয়েটা ধনী দুলালের মেয়ে। হয়তো ভালো কোন ঘরে বিয়ে হয়ে যাবে। কিংবা ওই রুমটাই নতুন কোন ছেলে আসবে। তাঁর সাথে নতুন করে ভাব হবে। কিছুদিন ধরে পাত্রপক্ষ আসছিলো বাসায়। সে কথা বেশ কয়েকবার জানিয়েছে সৌরভ কে। শিলা ভাবতে পারে আমি পালিয়েছি। যা ভাবে ভাবতে থাকুক কার কি? সৌরভ ভাবছে, কখনো আমার বাসার এড্রেস দেয়নি। আমার পাশের গ্রামের একটা ভুল ঠিকানা দিয়েছিলাম। ইশ! বাড়িওয়ালার কাছ থেকে সঠিক এড্রেস নিয়ে যদি চলে আসে মেয়েটা!
কি সব ভাবছি।
দিনের আলো পরিস্কার হতে চলেছে। একটি যুবক ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে। ফিঙ্গেদের রাজত্ব নেই। কাকের রাজত্ব চলছে শহর জুড়ে। স্টান্ডের খুব কাছাকাছি। বুকের বামপাশটাই চাপা ব্যাথা করছে!