এলার্ম বেজে উঠেছে। তবুও ঘুম ভাঙছে না শুভ্রের। আজ তিথির সঙ্গে ওর দেখা করতে যাবার কথা। রাতে অনেক সময় ধরে মোবাইলে কথা হয়েছে। একারণে ঘুমাতেও লেট হয়ে গেছে। সকাল সাতটায় ট্রেন। কাউকে না জানিয়েই গতকাল বিকেলের দিকে খুলনার
"সুন্দরবন এক্সপ্রেসের" একটি শোভন চেয়ারের টিকিট কেটেছে। বাবা মায়ের অবাধ্য ছেলে শুভ্র। কোন কথায় শুনতে চাই না তাদের। সব সময় উল্টো দিকে চলার চেষ্টা করে। পড়াশোনার দিকে একেবারেই মন নেই!
গত তিন মাস আগে তিথি মেয়েটার সঙ্গে প্রথম কথা হয় শুভ্রর মোবাইল ফোনেই। একটা রং নম্বর ছিলো। হ্যালো, হাই, সরি এরপর শুভ্রর ফিরতি ফোন। এভাবেই কথা আদান প্রদান হতে হতে প্রনয়ের শুরু। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত কথা চলছেই দুজনার।
পকেট মানি শেষ হয়ে যায় শুভ্রর ফোন রিচার্জ করতে করতে। তবুও কুলায় না! এরপর বাবার পকেটে চুরিচুপি হাত যায়। কখনো বোনের পার্টস থেকে আবার কখনো বা মায়ের আলমারি থেকে। এভাবে চুরি করে করে মোবাইলে টাকা ভরতে থাকে শুভ্র। তিথিকেও মাঝে মধ্যে রিচার্জ দেয়।
আশ্চর্য এক প্রেম খেলায় মেতে উঠেছে দুজন।
কেউ কাউকে দেখেনি, অথচ দুজন দুজনার জন্য পাগলপ্রায়!
তৃতীয় এলার্ম বাজার পর ঘুম ভাংলো শুভ্রর।
ঘড়ির দিকে ঘুম চোখে তাকিয়ে লক্ষ্য করলো
ছয়টা বিশ " বেজে গেছে! হুটোপুটি খেয়ে বিছান ছেড়ে দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে কাউকে না বলেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো স্টেশনের দিকে।
জানালার পাশের ছিটে বসে আছে শুভ্র। ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে। বাহিরের মনোরম দৃশ্যে উপভোগ করছে শুভ্র। মনের মাঝে তিথিকে ঘিরে নানান রকম জল্পনা কল্পনা আঁকিবুঁকি করছে। মেয়েটা কেমন হতে পারে?
আমার স্বপ্নের রাজকন্যার মতো হবে নিশ্চয়ই।
মনের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইছে। অপেক্ষার প্রহর যেন কিছুতেই কাটছে না।
তিথিকে কালো রঙ্গের ড্রেস পরে আসতে বলেছে। কালো রং শুভ্রের খুব প্রিয়। ফোন অফ করে রেখেছে। কথা হবে এবার সরাসরি।
তবুও মন মানছে না। মাঝে মাঝে ভুলে ফোন অন করে ফেলছে। দুই একবার কলও করেছে।
বসুন্ধরা সিটির " সামনে দেখা করবে। উত্তেজনায় ঘুমও আসছে না। চিন্তার সাগরে ভাসতে ভাসতে হঠাৎ ঘুমিয়েও পড়েছে। ঠিক খেয়াল নেই ওর, কখন ঘুমিয়েছে।
হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। এই তো গন্তব্যের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে ও। ট্রেনের এ মাথা থেকে ও মাথা পায়চারী করছে। ঢাকা এই প্রথমবারের মতো একা একা এসেছে শুভ্র। তবুও কোন ভয় লাগছে না। প্রেম এমন এক অনুভূতির নাম যা সকল ভয় ভীতিকে তুচ্ছ করে দেয়।
ট্রেন থেকে নেমে সিএনজি করে সোজা বসুন্ধরা সিটির সামনে চলে গেলো শুভ্র।
তিথি আগের থেকে অপেক্ষামান ছিলো।
শুভ্র সিএনজি থেকে নেমেই ফোন দিলো তিথির নম্বরে। ওপাশ থেকে তিথির অতি আগ্রহের কন্ঠস্বর শোনা গেলো।
-হ্যালো! কোথায় তুমি? পৌঁছেছো?
-হ্যাঁ, আমি মলের সামনে। তুমি কোথায়?
-দক্ষিণ পাশে এসো।
শুভ্র হাটছে আর খুজছে তিথিকে। কালো ড্রেস পরা কোন মেয়েকে দেখলেই তাঁর সামনে গিয়ে পথ রোধ করে শুনছে সে তিথি কিনা।
এভাবে চলতে চলতে একটা কালো রঙ্গের পোষাক পরিহিত মেয়ে শুভ্রর সামনে এসে পড়লো। তবে এই মেয়েকে কেন জানি শুভ্রর জিজ্ঞাসা করা হয় না সে তিথি কিনা?
মেয়েটাই হাসি মুখে শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-
শুভ্র! রাইট?
শুভ্র মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাল্কা মাথা নেড়ে জবাব দেয়,
-হ্যাঁ, আমি শুভ্র।
শুভ্রর মনের মধ্যে এক উথাল পাথাল কাল বৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না, এই মেয়েটিই কেন তিথি হলো? যার কন্ঠ এতো সুন্দর তাঁর অন্য কিছুই তো ম্যাচিং খাচ্ছে না কন্ঠের সাথে। মেয়েটিই কিনা একবার বলেছিল ও দেখতে কোন এক নায়িকার মতো। অথচ, কোন দিক থেকে কোন মিলই নেই। সব অমিল। হিসেব গড়মিল।
-কি হলো? চুপচাপ দাড়িয়ে কেন? চলো উপরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।
শুভ্র মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে জবাব দিলো যাবো না!
-কি? যাবে না মানে কি?
-ভালো লাগছে না, তাই যাবো না। তিথি তুমি বাসায় চলে যাও। পরে কথা হবে তোমার সাথে।
-সত্যি করে বলো তো? তোমার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?
-জানি না!
-এতো কষ্ট করে এতদূর থেকে এসেছো, কিছুক্ষণ থেকে যাও। মানলাম তোমার আমাকে পছন্দ হয়নি। তবু কিছু সময় আমাকে দাও!
তিথির চোখ থেকে কষ্টের অশ্রু অঝরে ঝরে পড়ছে। কথা বলতে পারছে না ঠিকমতো। একটু থেমে আবার বলা শুরু করলো,
-এই রাতে কোথায় যাবে? তুমি চাইলে আজ রাতটা আমার সঙ্গে কাটাতে পারো। যাকে এতটা ভালবাসলাম তাকে সারাজীবনের জন্য না পাই অন্তত একটা রাত কাছে পেতে চাই!
শুভ্র মাথা নিচু করেই জবাব দিলো,
-আমার আত্মীয়ের বাসা আছে সেখানে চলে যাবো। তুমি চলে যাও বাসায়!
একটা রিক্সা ডাকতে যাচ্ছিলো শুভ্র। শুভ্রকে থামিয়ে দিয়ে তিথি বলে উঠলো,
-থাক! রিক্সা আমি ডেকে নিবো। তুমি তোমার প্রতি খেয়াল রেখো। সুন্দর একটা মেয়ে দেখে প্রেম কইরো। তাকেই বিয়ে করো। তবে এভাবে এতটা প্রেমে জড়িয়ে কোন মেয়েকে কষ্ট দিওনা। ভালো থেকো।
মেয়েটা চলে যাচ্ছে। শুভ্র মাথা নিচু করেই দাড়িয়ে আছে আগের অবস্থানে। পৃথিবী ঠিকঠাক মতোই আছে। সবাই ছুটোছুটি করছে।
শুধু দুটি সম্পর্কের ছিন্ন হয়েছে।