জলিল সাহেব গাড়ি কিনেছেন। গাড়ির দাম পড়েছে দশ লাখ টাকা। বারো হাজার টাকা বেতন দিয়ে ড্রাইভার রেখেছেন। অসৎ টাকায় গাড়ি কেনা হয়নি। জলিল সাহেব একজন সৎ মানুষ। তের বছর টাকা জমিয়ে গাড়ি কিনেছেন। তার ছেলে-মেয়েদের গাড়ির খুব শখ। গাড়িটি ব্যাবহার করেন তার ছেলে-মেয়েরা। তিনি রিকশা এবং বাসে'ই যাতায়াত করেন। সেদিন ছুটির দিনে তিনি কি মনে করে যেন গাড়ি নিয়ে বের হলেন। যাবেন মিরপুর তার ছোট বোনের বাসায়। তার গাড়ি কাওরান বাজার এসে জ্যামে পড়লো। ড্রাইভার এসি ছেড়ে দিয়েছে- আরামে তার ঘুম এসে যাচ্ছিল। গাড়িতে রেডিও চলছিল।
হঠাত জলিল সাহেব জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন- তার গাড়ির পাশে একটা লোকাল বাসে অনেক মানুষজন বানরের মতো ঝুলে আছে। বাসের দিকে তাকিয়ে জলিল সাহেবের লজ্জা করতে লাগল। তিনি সারা জীবন এরকম বাসে ঝুলে ঝুলে গন্তব্যে গিয়েছেন। '৬' নম্বর বাস গুলোতে খুব ভীড় হয়, ঠিকভাবে পা'ও রাখা যায় না। গরমে সারা শরীর ভিজে যায়। একটুও নড়া-চড়া করা যায় না। জলিল সাহেবের মনে হচ্ছে যেন, বাসের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলো এক আকাশ ঘৃণা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। জলিল সাহেব বিবেকের তাড়নায় গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা শুরু করলেন মিরপুরের দিকে। এবং তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন- আর কোনো দিন গাড়িতে উঠবেন না।
মোবারক সাহেব নতুন একটি গাড়ি কিনেছেন। দাম পড়েছে বাইশ লাখ টাকা। তার আরও দু'টি গাড়ি আছে। দু'টি গাড়ির মধ্যে একটি তার স্ত্রীর এবং একটি তার ছেলের। প্রত্যেকটা ড্রাইভারকে বেতন দেওয়া হয় বারো হাজার টাকা করে। মোবারক সাহেব মিরপুরে একটি গার্মেন্টস দিয়েছেন। সপ্তাহে একদিন সেখানে বসেন। মোবারক সাহেব তার বাপ-দাদার ব্যবসা নিজ বুদ্ধি দিয়ে সাত গুন বাড়িয়েছেন।
তার গাড়ি সিগ্যানালে পড়েছে। তিনি সব সময় জানালা বন্ধ করে রাখেন। জানালা খোলা থাকলেই ভিক্ষুক এবং নানান ধরনের হকার'রা হাত ঢুকিয়ে দেয়। এটা তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। তখন তার ইচ্ছা করে এদের হাত গুলো ভেঙ্গে দিতে।
মোবারক সাহেব তার গাড়ির কালো কাঁচের জানালা দিয়ে দেখতে পেলেন একটা বাসে অনেক গুলো লোক যাতাযাতি করে বানরের মত ঝুলে আছে। মোবারক সাহেবের হঠাত খুব রাগ হলো। তার ইচ্ছা করলো- প্রেট্রোল দিয়ে বাসে আগুন ধরিয়ে দিতে। সব গুলো ঝুলে থাকা বানর আগুনে পুড়ে মরুক। তিনি গরীব মানুষদের একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। এই জন্য তিনি আজকাল জানালার দিকে তাকান না। গাড়িতে সব সময় ম্যাগাজিন এবং একটা ইংরেজী পত্রিকা রাখেন। পত্রিকা নড়াচড়া করেন অথবা মোবাইলে গেমস খেলেন।
আজমল সাহেব একজন সরকারী কর্মকর্তা। তিনি একটি নতুন গাড়ি কিনেছেন। গাড়ির দাম পড়েছে বিয়াল্লিশ লাখ টাকা। তার আরও তিনটা গাড়ি আছে। সেগুলো তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যবহার করে। আজমল সাহেব তার ড্রাইভারকে বেশী টাকা বেতন দিতে কখনও কার্পণ্য করেন না। আজ আজমল সাহেব যাচ্ছেন মিরপুর। তিন সপ্তাহে একদিন মিস চাঁদনী নামে একটি মেয়ের কাছে যান যৌনসুখ ভোগ করতে। মেয়েটিকে তিনি প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা দেন। চাঁদনীর একটি চার বছরের ছেলে আছে। স্বামী থাকে বিদেশে। চাঁদনী ছাড়াও আজমল সাহেব আরও তিনজন নারীর কাছে নিয়মিত যান।
আজমল সাহেবের গাড়ি কাওরান বাজার এসে সিগ্যানালে পরেছে। তিনি জানালা দিয়ে দেখলেন- একটা বাসে অনেক গুলো লোক ঝুলে আছে। ঝুলে থাকা মানুষ গুলোকে দেখে আজমল সাহেব অনেক আনন্দ পেলেন। দরিদ্র মানুষদের দেখে তিনি অনেক আনন্দ পান। বাসে যাতাযাতি করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর দিকে তাকিয়ে আজমল সাহেব মিটমিট করে হাসেন এবং মনে মনে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। এবং বাসের লোকজনদের দিকে তাকিয়ে কখনো কখনো ভিক্ষুক এবং হকারদের ধমক দেন, এই গাড়িতে হাত দিবি না। দাগ পড়ে যাবে।
আজমল সাহেব দুর্নীতি করে অনেক টাকার মালিক হয়েছেন। সরকারী দলের অনেক নেতা তাকে তোষামদ করেন। আজমল সাহেবের অনেক দিনের ইচ্ছা ধনী এবং গরীবদের জন্য আলাদা রাস্তা করা হোক। যেন এসি গাড়িতে বসে ঝুলে থাকা বানরদের না দেখতে হয়।
(গল্পটি পাঁচ বছর আগের লেখা। আমার গল্প গ্রন্থ ''টুকরো টুকরো সাদা মিথ্যা'' বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য বইয়ে ছাপানোর আগে বেশ কাটাছেড়া করা হয়েছে। কিছু যোগ করেছি, কিছু বাদ দিয়েছি।)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৩১