"মানুষের, জাতির, দেশের যখন চরম অবনতি হয়, তখনই এইরূপ নরপিশাচ জালিমের আবির্ভাব অত্যাবশ্যক হইয়া পড়ে। মানুষ যখন নিজের প্রকৃতিদত্ত অধিকারের কথা ভুলিয়া যায়, তখন তাহার আর মান-অপমান জ্ঞান থাকে না। তাহার মন এত ছোটো হইয়া যায়, তাহার আশা এত হেয় ও হীন হইয়া পড়ে যে, সে ভাবিতেও পারে না।"একশ বছর আগে কথাগুলো লিখেছিলেন কাজী নজরুল।
গত কয়েকদিনে নতুন ইতিহাস রচিত হল। ট্যাক্সের টাকায় পালিত শাসক এবং তার আজ্ঞাবাহী বাহিনীর হাতে উদ্দীপিত তরুণের রক্তমাখা লাশের ইতিহাস। জনগণের টাকায় কেনা গোলাবারুদ দিয়ে তাদেরই সন্তানের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং তাকে অন্ধকারে মাটি চাপা দেওয়ার ইতিহাস। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হওয়া কালো রাতের ইতিহাস। বোনের বিলাপ, মায়ের আর্তনাদ, পিতার নির্বাক ও বধির হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। মানুষের জীবন নিয়ে শাসকের ব্যঙ্গোক্তি ও শয়তানের পরিভাষা তৈরির ইতিহাস। যে কূট-কৌশলে তারা সকল অপকর্মের অজুহাত হিসেবে কতগুলো নাম ব্যবহার করে, তার ইতিহাস।
একজন আন্দোলনকারী ছাত্র এমন এক হত্যাকাণ্ডের বিবরণ লিখেছেন এভাবে:
"গুলি খাওয়ার আগে তিনি আমার পাশে ছিলেন। আমি, আমার ডান পাশে তিনি। জাস্ট ১/২ মিনিট আগে আমাকে বললেন 'আমরা ৩ জন কিন্তু একসাথে থাকবো।' তার মৃত্যুতে শোক নাই আমার, আছে শুধু ট্রমা। ঘুমাতে গেলে উল্টাপাল্টা দেখি। দু:খ পাবো তার মৃত্যুতে, নাকি স্বস্তি পাবো যে কয়েক ইঞ্চি এদিক ওদিক হওয়াতে আমি বেঁচে গেলাম, জানি না। গুলিটা তার মাথায় লেগেছিলো। গ্রিন রোডে ছিলাম আমরা, ল্যাব এইডের পিছে। দাঁড়ায়েই ছিলাম, নো স্লোগান, নো চিল্লাচিল্লি, নাথিং। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেডের পরপর একশনের পরেও ছিলাম। এক সময় দেখি গ্রিন রোডের একপাশে অনেক পুলিশ একদম রেডি। আমরা ৩ জন সবার সামনে পড়ে যাই, আমরা সেন্ট্রাল রোডের মুখে, মানে গ্রিন রোডে। কানের পাশে প্রচন্ড আওয়াজ শুনি হঠাৎ। ভেবেছিলাম সাউন্ড গ্রেনেড, একটু দৌড় দিয়ে সেন্ট্রাল রোডে ঢুকে পিছে তাকাই, দেখি গ্রিন রোডে ল্যাব এইডের ঠিক পিছে একপাশ থেকে পুলিশের ঘেরাও করা রাস্তায় একজন একটা বডি টেনে সেন্ট্রাল রোডে আনার চেষ্টা করছে আর হাত দিয়ে ডাকছে তাকে সাহায্য করতে। সাহস করে উনাকে হেল্প করতে একটু কাছে যেতেই দেখি মানুষটার মাথার পিছনে রক্ত, নিথর দেহ। মানুষটা তিনি, ২ মিনিট আগে আমাকে যে একসাথে থাকতে বললো। ভাইয়ার কাছাকাছি যেতেই আবার ফায়ারিং হলো, আর আমি এবার সত্যিকারের দৌড় দিলাম। দৌড়ানোর সময় তাকালাম পিছে, রাস্তায় তিনি পড়ে আছেন একলা, কিন্তু আনতে পারলাম না।
তার একটা ছোট্ট মা আছে। ওর জন্য দোয়া করবেন।"
এই রক্তপাতে নিথর হয়ে যায় খেলতে যাওয়া পাঁচ বছরের শিশু, জানালার পাশে দাঁড়ানো দশ বছরের বালক, খেলার মাঠে, স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, রাজপথে, মিছিলে, ময়দানে পনেরো, ষোল, আঠারো, কুড়ি, বাইশ বছরের কিশোর, তরুন থেকে সব বয়সের মানুষ।
কুড়ি বছরের শিক্ষার্থীকে দিবালোকে হত্যা করে ট্যাংকের উপর থেকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে তার উলঙ্গ মৃতদেহ। আমাদেরই ট্যাক্সের টাকায় পালিত পুলিশ! হায় হতভাগ্য জনতা! বাড়ি বাড়ি গিয়ে গেস্টাপো বাহিনীর লোকেরা পিতা-মাতার সামনে গুলি করে হত্যা করে তিলে তিলে বড় করা আদরের সন্তান। নিরস্ত্র ছাত্রকে ছেঁচড়িয়ে টেনে টেনে ড্রেনে ফেলে দেয় লাশ। মানুষের ভিড় লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে জনতার সেবা করার শপথ বাক্য পড়েছিল যে পেশার মানুষেরা। প্রাণঘাতী ভারী অস্ত্র তাক করে অবলীলায় মিছিলে গুলি চালায় খুনীরা।
বুকের রক্তে লেখা এই ইতিহাসের অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ যুগে যুগে করবে এদেশের মানুষ। যেমন করে আমরা নিজের অন্তরের দিকে তাকিয়ে আমাদের কাজের, সিদ্ধান্তের, ভালো-মন্দের বিচার করি। সেরকম জাতির আত্মোপলব্ধির জন্য বহুবার, বহুভাবে আমরা এই ইতিহাসের মুখোমুখি হবো।
যেমন করে সিপাহি বিপ্লবের ইতিহাস আমরা মনে ধারণ করি। যেভাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশের শোষণ আর জেনারেল ডায়ারের প্রতি তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি করে। যেভাবে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনে আমাদের সংস্কৃতির মূল ধরে নাড়া দিয়ে আত্মপরিচয়ের সন্ধান করে। যেভাবে ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচনা করে। যেভাবে ৯০-এর আন্দোলন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জনতার বিজয়গাথা রচনা করে। সেভাবে ইতিহাসের পাতায় ২০২৪ সাল আমাদের আত্মোপলব্ধির নতুন বধ্যভূমি হয়ে আমাদের চেতনাকে তাড়া করে বেড়াবে।
নোট: উপরে উল্লেখিত উদ্ধৃতি নজরুলের "ডায়ারের স্মৃতিস্তম্ভ" প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। পাঞ্জাবের অমৃতসরে ১৯১৯ সালে ঘটে যাওয়া জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কাজী নজরুল এই প্রবন্ধ লেখেন। এটি তার প্রথম নিষিদ্ধ বই ‘যুগবাণী’তে প্রকাশিত হয়। জেনারেল ডায়ার ছিলেন সেই হত্যাকাণ্ডের আদেশদাতা। যদিও এই জেনারেল ছিলেন ব্রিটিশ প্রভুত্বের প্রতীক, প্রবন্ধটি এই একশ বছর পরে আবারও আমাদের পাঠের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ১০:১৭