লেখাটির সূচনা বিষাদ সময়ের সাম্প্রতিক পোস্ট "ব্লগের সাতকাহন" এ অপ্রকাশিত একটি মন্তব্যের সূত্র ধরে। বিষাদ সময়ের লেখাটি ব্লগের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে যুক্তিপূর্ণ ও সুলিখিত ছিল। কিন্তু কিছু কারণে সেখানে আর মন্তব্যটি প্রকাশ করিনি। মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে আমার কৌতূহল আর চিন্তাকে কিছু বর্ধিত আকারে প্রকাশ করার চেষ্টা এই লেখাটি।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভারতীয় মনস্তত্ত্ববিদ সুধীর কাকর একটি ভিন্ন ধরনের জীবনী গ্রন্থ লিখেছেন। বইয়ের নাম "তরুণ রবীন্দ্রনাথ: এক মহান প্রতিভার নির্মাণ (Young Tagore: The Makings of a Genius)"। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা অন্য জীবনীগ্রন্থ থেকে এই বইয়ের পার্থক্য হলো এই জীবনীটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করে। আমরা যখন কারো জীবন সম্পর্কে জানি, তখন সচরাচর এই প্রশ্ন করি না যে কেন তিনি মানুষ হিসেবে এমনটি হয়ে উঠলেন।
জাফর ইকবালের একটা গল্পের কাহিনি এমন ছিল যে আইনস্টাইনকে ক্লোন করে যে নতুন আইনস্টাইন বানানো হলো, তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কে কোনো আগ্রহই দেখালেন না। তিনি হয়ে উঠলেন একজন বেহালাবাদক। আমাদের মনের আবেগ-অনুভূতি, একাকীত্ব, আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু, সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং প্রতি মুহূর্তে মনের ভিতরে জন্ম নেওয়া ভাবনা-চিন্তা-সিদ্ধান্তগুলো আমাদের জীবনটাকে ঠিক কীভাবে পাল্টে দেয় এবং আমাদের এক বিশেষ মানুষ হিসেবে তৈরি করে - এই বইটি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে সেই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজে।
মজার বিষয় হলো, বইটি কিছুদূর পড়ে মনে হলো যে মনস্তত্ত্বের বিষয় হিসেবে রবীন্দ্রনাথের চরিত্র কৌতূহলোদ্দীপক নয়। রবীন্দ্রনাথের অসামান্য প্রতিভা সমুদ্রের মতো বিস্ময় জাগায় সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে ঠিক রহস্য নেই। পুরোটাই যেন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সেখানে একাকীত্ব আছে, নৈরাশ্য নেই। সেখানে সংসারের বহু দুঃখ-কষ্ট-বেদনা আছে, বিদ্রোহ নেই। সেখানে এত প্রবল অধ্যাবসায়, নিয়মানুবর্তিতা আর শৃঙ্খলা যে মনে হয় এ যেন মহাপুরুষের জীবন। তাই মনে হলো, সুধীর কাকর যদি বাংলা চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে এমন মনস্তাত্ত্বিক জীবনী লিখতেন তাহলে সেটা বেশি আগ্রহোদ্দীপক হতো। প্রতিভার সাথে ঋত্বিকের চরিত্রে নিরাশা, ক্ষোভ, বিপ্লব ও ব্যর্থতা এবং দেশভাগের কারণে শিকড় থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার যে এক বেদনাদায়ক জটিল মানসিক পরিস্থইতি তৈরি করেছিল, সেটা তার মনস্তত্ত্বকে কালবৈশাখীর মত বিধ্বস্ত আর রহস্যময় করে তুলেছিল।
আমাদের অনেকের চরিত্রে ঋত্বিকের প্রতিভা না থাকলেও রহস্যময়তা হয়তো আছে। ব্লগার রাজীব নূর সম্ভবত তেমনি একজন। এই যে রাজীব বিভিন্ন সময়ে অন্যের লেখা কপি করতেন, এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কি আমরা খুঁজে দেখেছি? উন্নত দেশগুলোতে দেখা যায় অপরাধীদের মনে কোন অসুখ আছে কিনা তা নির্ণয়ের জন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ থাকেন। কিন্তু আমাদের সমাজে "আগে মাইর দিয়ে নেই, পরে দেখা যাবে" এই ধরণের মানসিক বিকলতা দেখা যায়। আমরা কি লেখা কপি করার জন্য প্রাচীন পণ্ডিতদের মতো বেত নিয়ে তেড়ে আসবো, নাকি তাকে ভর্ৎসনা করে আত্মোপলব্ধির সুযোগ করে দেব?
রাজীব প্রায় সময় হুমায়ূন আহমেদের মতো করে লিখতেন। মাঝেমাঝে হুমায়ূন আহমেদের কোনো গল্প তার লেখার মধ্যে যুক্ত করে দিতেন। একবার তাকে বলেছিলাম যে তিনি কেন হুমায়ূন আহমেদকে নকল করেন, তার নিজের মতো করে লেখেন না। তার উত্তর শুনে মর্মাহত হয়েছিলাম। তিনি নাকি চেষ্টা করেন হুমায়ূন আহমেদের মতো করে লিখতে। শুধু লেখা নয়, তিনি কখনো কখনো মন্তব্য পর্যন্ত কপি করতেন। তাকে বহুবার বহুভাবে বলেও কপি করার স্বভাবের পরিবর্তন করা যায়নি। বিষয়টি তিনি কখনও স্বীকারও করেননি।
একথা সত্য যে রাজীবের মধ্যে নাগরিক জীবনের গল্পকার একটি চরিত্র ছিল। আমাদের সময়ে যারা মুক্তচিন্তা নিয়ে বেড়ে উঠেছে, তাদের মনের গভীরে ঋত্বিক ঘটকের মতো নিরাশা, ক্ষোভ, বিপ্লব ও ব্যর্থতার অনেকগুলো স্তর আছে। আমাদের এই প্রজন্মের পিতারা জন্মেছিলেন গ্রামে, কিন্তু আমাদের বেড়ে ওঠা শহরে। স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় "যুক্তি তক্কো আর গপ্পো"র অনেক ভালো উপকরণ ছিল, কিন্তু সেগুলো ফলবান বৃক্ষের মতো বড় করে তার বীজ ছড়িয়ে দেবার আগেই সেগুলো ছাগলে খেয়ে ফেলেছে।
যুক্তি এবং চিন্তার স্বাধীনতার সময়টা দ্রুত নিঃশেষ হয়ে গেছে আর আমরা দুঃশাসন ও নৈরাজ্যের ক্রস-ফায়ারে আটকা পড়ে গেছি। আমাদের চারপাশে অর্থ, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির এক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষের মূল্য আর মানবিক মূল্যবোধকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলেছে এই বিশৃঙ্খলতা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং এর অন্তর্নিহিত দর্শন সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায়, প্রবল হতাশার সুযোগে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠী দিনের পর দিন শক্তিশালী হয়েছে। আর এই বাস্তবতাকে আমরা নানা ভাবে ভুলে থাকতে চেয়েছি, আড়াল করতে গিয়ে আত্ম-প্রবঞ্চনার আশ্রয় নিয়েছি। রাজীবও কি লেখা কপি করার ভিতর দিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের গল্পকে নিজের গল্প মনে করে কোনো এক আত্ম-প্রবঞ্চনামন ছদ্মবেশ তৈরি করতে চেয়েছিলেন?
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০২৪ ভোর ৬:১৩