দেশপ্রেম দেখানোর জিনিস না, দেখানো যায়ও না। ব্যাপারটা অনুভবের। কে কীভাবে দেশপ্রেম অনুভব করে, সেটা সে'ই ভালো বুঝে। একেকজনের অনুভূতি প্রকাশের ভঙ্গিটাও একেকরকম। তেমনি আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠার প্রকাশও জনে জনে ভিন্ন। বিশ্বকাপের সময়টা একজন ফুটবলপ্রেমীর কাছে কেমন সেটা আমি নিজে ফুটবলপ্রেমী না হয়েও কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। যারা রাতের পর রাত শুকনো লাল চোখ উপেক্ষা করে এই খেলার মাঝে ডুবে থাকে, এই ক্ষণে তাদের উৎসব কিছু নিয়ম হয়তো মানবে না, কিছু প্রতিক্রিয়া এই উৎসবের সাথে চলে আসা দীর্ঘদিনের রীতি মতো এগিয়ে যাবে... ... কেউ উৎসবের আদল হিসেবে পছন্দের জার্সিতে নিজেকে জড়াবে কেউ পছন্দের দলের পতাকা ওড়াবে। এর মাঝে ভিন্ন কেউ যদি তার মনগড়া কিংবা ব্যক্তিগত মতাদর্শ অন্যের উৎসব উদযাপনের উপর চাপায় দেয়ার চেষ্টা করে তো ব্যাপারটা খারাপ। বেশ খারাপ।
দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটা কী? একটা অনুভূতিকে কীভাবে বাঁধাধরা নিয়মে সংজ্ঞায়িত করা যায় আমার জানা নাই। কেউ বাসার ছাদে প্রিয় দলের পতাকা দোলানোর সময় নিজের দেশের পতাকার চাইতে ভিনদেশী প্রতাকার প্রতি বেশি সম্মান বা ভালোবাসা অনুভব করে নাকি পরীক্ষা করে দেখা হোক। রেজাল্ট কী হবে আমি জানি। এরা নিতান্তই নিজ দলকে সাপোর্ট করে ফুটবল বিশ্বকাপের উৎসবে নিজেকে শামিল করতে চায়। পতাকা ওড়ানোটা সাপোর্ট করার প্রচলিত প্রকাশভঙ্গি মাত্র। এর সাথে দেশপ্রেম, ঘৃণা, মান অপমান ইত্যাদি তত্ত্ব গোলানো নিতান্তই মূর্খতা।
দেশপ্রেমিক সব মনে হয় ফেসবুকেই বসবাস করে, বাংলাদেশের পতাকার ছবি দেয়, দেশপ্রেম নিয়ে চেতনার কথা বয়ান করে। রাস্তাঘাটে এদেরকেই আবার দেখা যায় দুই টাকা বেশি চাওয়ার কারণে রিকশাওয়ালা কিংবা খেটে খাওয়া মানুষদের সাথে গলার রগ ফুলায় চেঁচামেচি করে। অথচ এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোই তো দেশ। দেশ তো মানুষ, পতাকাটাও মানুষের রক্তের ফসল। দেশের মানুষের প্রতি সম্মান নাই, মানুষে মানুষে ভালোবাসা নাই অথচ দেশের প্রতীক পতাকার প্রতি সম্মানই তারা দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ প্রকাশ মনে করে। সবাই এমন না হয়তো। তবে এরা যে সমাজের একটা বড় অংশ হয়ে আমাদের চারপাশে ঘুরে ফেরে এই কথা কে অস্বীকার করতে পারবে। প্রথমে একারণেই বলেছিলাম, দেশপ্রেম একটা অনুভূতি আর এই অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন জন ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অনুভব করে।
আমি নিজে এখনো কোন দলের পতাকা টাঙাই নাই। না, দেশপ্রেমের আধিক্যের কারণে না। আলস্য মূল কারণ। ছোটবোন অনেকদিন বলেও আমাকে দিয়ে ব্রাজিলের পতাকা কিনাইতে পারে নাই। আমি কোন পতাকা না কেনার পিছনেও আলস্য একটা কারণ। দেশপ্রেম তত্ত্বের প্রভাব এখানে নাই। শেষমেশ সে নিজেই একটা পতাকা কিনে আনলো। এখন প্রত্যেকদিন আমাকে নিয়ে টানাটানি করে ছাদে পতাকার স্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য। কার না কার আর্জেটিনার পতাকা নাকি ছাদে উড়তেছে, তার সহ্য হচ্ছে না। এই যে সহ্য হওয়া না হওয়া, পছন্দের দলের পতাকা কিনে আনা, লাগানোর জন্য বড় ভাইকে জ্বালানো এসবের মাঝে যদি কেউ দেশপ্রেম-অপ্রেমের থিওরি নাজিল করতে চায় তো বলার কিছু থাকে না। মাঝেমধ্যে খুব ক্লান্ত লাগে।
ফেসবুকে আমরা সবকিছু নিয়েই উগ্রপন্থীদের মতো আচরণ করি। মানুষের আবেগ অনুভূতি বুঝতে না চেয়ে নিজের মতো করে সবাইকে বিচার করি। আমাদের চিন্তাধারায় একটু পরিমিতিবোধ দরকার।
একটা বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপ কেবল এক বলের পিছনে দুই দল মানুষের পরিশ্রমের আসর না। এই আয়োজন একটা উৎসব। এক দেশের সাথে অন্য দেশের পরিচয়, ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে পরিচয়, ভাব অভাবের আদান প্রদান আর অন্য দেশকে সম্মান করে অন্য দেশের একটা মানুষকে এমনকি “অন্য দেশের একটা নির্দোষ পতাকাকে ভালোবেসেও” নিজের দেশকে ভালোবাসার স্বদেশপ্রেমের যে সার্বজনীন সংজ্ঞা তাকে সমুন্নত রাখা যায় যদি হৃদয়ে নিজ দেশের জন্য আসলেই ভালোবাসা থাকে। আপনারা যারা জ্ঞানী গুণী এবং দেশবরণ্য (ফেবু-বরেণ্য হবে) দেশপ্রেমিক আছেন আসুন বিনা কারণে ঘৃণা করতে না শিখিয়ে ভালোবাসতে শেখাই অন্য দেশ, দেশের মানুষ, অন্য দেশের পতাকাকে। আর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসাটা জমা করে রাখি নিজের দেশের জন্য। ক্ষতি কী...!?