১
National Center for Supercomputing Applications (NCSA) বা মার্কিন জাতীয় সুপারকম্পিউটার কেন্দ্রের নামটা শুনেছিলাম অনেকদিন আগেই। না শোনার অবশ্য কারণ নেই, ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের হেল্প মেনুটি খুললেই অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্তও দেখা যেতো, তারা ওখানে ব্যবহার করেছে NCSA এর প্রযুক্তি।
ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইনের সাথে সুপারকম্পিউটিং এর যোগাযোগ অনেকদিনের। সেই ১৯৫২ সাল থেকে, অর্থাৎ কম্পিউটারের প্রাথমিক যুগ থেকেই এখানে সুপারকম্পিউটার বানানোর কাজ চলছে, ILLIAC -1 থেকে শুরু করে ILLIAC-4 পর্যন্ত সবগুলো কম্পিউটার একসময় এখানেই তৈরী হয়েছিলো। যারা 2001 - A Space Odyssey দেখেছেন, তারা হয়তো মনে করতে পারবেন, HAL নামের সেই খুনে কম্পিউটারটির কথা, ওর জন্ম হয়েছিলো কিন্তু এই আরবানা নামের শহরেই। (মানে, উপন্যাস ও সিনেমাতে এর জন্মস্থান দেখানো হয়েছিলো এখানে)।
২
(ছবির কম্পিউটার HAL 9000, যার জন্ম আরবানাতে)
HAL এর কথা পড়েছিলাম 2001 উপন্যাসটিতে, সে ৯০র দশকের প্রথম দিকের কথা ... তখন কি আর জানতাম, এক যুগ পরে এই ভুট্টাক্ষেতের পাঠশালাতে পড়বো এক সময়? তাই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর প্রথম দিনেই হানা দেই কম্পিউটার বিজ্ঞান ভবনটিতে, আর কী আশ্চর্য!! সেখানকার একতলাতে HAL নামের কম্পিউটারটির উপরে বিশাল কাঁচের ডিসপ্লে!! আসলে গল্পে দেখানো হয়েছিলো (১৯৬৮ এর দিকে লেখা) যে আরবানাতে কম্পিউটার প্ল্যান্টে ১৯৯৭ সালে HAL তৈরী হয়েছিলো, তাই ১৯৯৭ সালে এখানকার কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে ঘটা করে HAL এর জন্মদিন পালন করা হয়, সাইন্স ফিকশন ভক্তরা দল বেধে সারা আমেরিকা থেকে এখানে আসে।
তো, এতো বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কেনো আর্থার সি ক্লার্ক বেছে নিয়েছিলেন কম্পিউটারটির জন্মস্থান হিসাবে? তার কারণ জানতে চেয়েছিলাম এখানকার এক অধ্যাপকের কাছে, ঘটনাচক্রে তিনি আবার উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিং নিয়ে কাজ করে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো, স্ট্যানলি কুব্রিক আর আর্থার সি ক্লার্ক সিনেমাটা বানাবার সময়ে কারিগরী উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দেন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজনকে, তার সুবাদেই HAL এর জন্মস্থান আরবানা। আসলে ষাটের দশকের শেষভাগ থেকেই কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এখানকার সুনাম ছড়িয়েছিলো।
৩
(ILLIAC 3, বর্তমানে আস্তাকুড়ে বা গ্যারেজে পড়ে থাকা তার যন্ত্রাংশ)
ILLIAC নামের প্রথম ৩টি প্রজন্মের কম্পিউটার অতো খ্যাতি বা কুখ্যাতি পায়নি, যেটা পেয়েছিলো ILLIAC-4। এই কম্পিউটারটি সত্তরের দশকের শুরুর দকে তৈরীর পরিকল্পনা নেয়া হয়, তখনকার দিনের নতুন সব প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কুখ্যাতির কারণ অন্য -- এই সুপারকম্পিউটারটির অর্থায়ন আসে মার্কিন সেনাবাহিনী থেকে, আর সময়টা ভিয়েতনাম যুদ্ধের কাল, পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে উদ্দাম তারুণ্য যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে তখন সোচ্চার। তাই এখানকার ক্যাম্পাসেও লাগে যুদ্ধবিরোধী হাওয়া, সেনাবাহিনীর পয়সায় কম্পিউটার বানিয়ে তাতে মানুষ মারার অস্ত্রের নকশা করা হবে, এরকম কোনো কিছুর বিরোধিতা করে ছাত্ররা। বিশাল সেই ছাত্র আন্দোলনের মুখে কম্পিউটারটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়, পরে ক্যাম্পাস থেকে বহু দূরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যপ্রান্ত নাসার গবেষণাগারে তৈরী হয় এটি।
ইলিয়াকের ঘটনা ইতিহাস হয়ে যায়, মার্কি যুক্তরাষ্ট্র হেরে ভুত হয়ে ভিয়েতনাম ছেড়ে আসে, তারও ১০ বছর পর NCSA স্থাপিত হয় ১৯৮৬ সালে, মার্কিন সরকার পুরো দেশজুড়ে কয়েকটি জায়গায় সুপারকম্পিউটারের গবেষণাগার বানায়, যাতে করে পুরো দেশের বিজ্ঞানীরা এগুলো ব্যবহার করতে পারে। NCSA তে গত এই ২৩ বছর জুড়ে অনেকগুলো প্রচন্ড ক্ষমতাধর সুপারকম্পিউটার স্থাপিত ও তৈরী হয়েছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শাখার গবেষকেরা নিজেদের সুপারকম্পিউটার না থাকলেও দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এগুলো ব্যবহার করতে পেরেছেন।
--
৪
আমি যখন পা রাখি ভুট্টা ক্ষেতে, তখন সবাইকে প্রশ্ন করি, NCSA ভবনটি কোথায়। কোথায় গেলে দেখতে পাবো এই বিখ্যাত গবেষণাগারটিকে। জবাবে ৫টি ঠিকানা পেলাম, জানলাম পুরো ক্যাম্পাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে এটি। এর মধ্যে একটি ভবন নাকি বানানো হয়েছিলো পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঠেকানোর মতো শক্ত করে, যাতে তার ভেতরে থাকা সুপারকম্পিউটারটি রক্ষা পায়। এখন অবশ্য সুপারকম্পিউটার বলতে অতিকায় কোনো একটি মাত্র যন্ত্র বানানো হয়না, বরং র্যাকে রাখা হাজার কয়েক সাধারণ কম্পিউটারকে যুক্ত করে ক্লাস্টারভিত্তিক সুপারকম্পিউটার বানাবার চল এসেছে বহুদিন। তাই সুপারকম্পিউটারের কেন্দ্র হিসেবে NCSA এর খ্যাতিতে ভাগ বসিয়েছে অনেকেই। তার পরেও মাঝে মাঝেই প্রথম ১০ তালিকাতে এদের সুপারকম্পিউটার এসে যায়।
২০০৪ এর শুরুতে NCSA-তে কাজ করার সুযোগ পাই, অবশ্য কোনো সুপারকম্পিউটারবিদের সাথে না, বরং একজন কম্পিউটেশনাল অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের সাথে। খটোমটো যে পদবীটি এই বিজ্ঞানীর ছিলো, তার সার কথা হলো, ইনি কম্পিউটার বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংমিশ্রণে কাজ করেন। কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা তারার মিটিমিটি আলোকে কিংবা বেতার তরঙ্গকে ধরতে নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে বসেছে কয়েকশো রেডিও দূরবীন, সেখানকার সংকেতগুলোর বিপুল পরিমাণ উপাত্ত থেকে এই বিজ্ঞানী ছবি তৈরী করেন, ২০০০ সালের দিকে এক তারার মৃত্যুদৃশ্যের ছবি প্রকাশ করে পুরো বিশ্বজুড়ে খবর হয়েছিলেন।
একদিন অবশ্য সুপারকম্পিউটারের পেটের ভেতরে যাবার সুযোগ ঘটে। বেশ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনো, ভবনে ঢোকার আগে বাইরে ক্যামেরা দিয়ে দেখে যাচাই করা হলো, সাথে পাহারাদার দেয়া হলো আমাদের। পেটের ভেতরে বললাম, কারণ পুরো বিশাল একটি কক্ষজুড়ে লাইব্রেরীর তাকের মতো অনেকগুলো শেলফ, আর তাতে বসানো আছে কয়েকহাজার নোড। প্রচন্ড তাপ সৃষ্টি হয়, তাই পুরো ঘরটির মেঝের নিচে বসানো আছে শীতাতপ যন্ত্র। এটি ছিলো তখন বিশ্বের ৪র্থ দ্রুততম সুপারকম্পিউটার।
(Abe নামের সুপারকম্পিউটারের কিয়দংশ)
---
৫
NCSA এর নাম আমি যে কারণে শোনার কথা শুরুতে বলেছিলাম, তার সাথেও মুখোমুখি হতে হয়, অবশ্য অন্যভাবে। নতুন তৈরী হওয়া NCSA ভবনের সামনে স্থাপিত হয় একটি ফলক, আগ্রহভরে দেখতে গিয়ে দেখি, প্রথম বহুল প্রচলিত ওয়েব ব্রাউজার মোজাইকের স্মারক ফলক ওটি (পুরো ক্যাম্পাসে স্থাপিত অন্য দুটি ফলকের একটি ২বার নোবেল বিজয়ী জন বার্ডিন, আর সিনেমাতে শব্দ যোগ করা বিজ্ঞানীটির স্মরণে)। ঘটনা হলো, এই NCSA তে কর্মরত অবস্থাতেই ১৯৯৩ সালে মার্ক অ্যান্ড্রিসেন আর এরিক বিনা নামের দুজন প্রোগ্রামার মাত্র একটি সপ্তাহান্তে বসে এই ব্রাউজারটি তৈরী করেন, দুজনে পরে শুরু করেন নেটস্কেপ নামের কোম্পানিটি, নব্বইয়ের দশকের যা পরাক্রমশালী মাইক্রোসফটেরও ত্রাস হয়ে যায়, নেটস্কেপ নামের ব্রাউজারটি দিয়ে।
৬
মোজাইকের প্রযুক্তিটি অবশ্য মাইক্রোসফট নিজেও লাইসেন্স করে ব্যবহার করে, আর সে জন্যেই গত সংস্করণ অবধি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের কৃতজ্ঞতা স্বীকার পাতায় NCSA এর কথা বলা থাকতো। আমি মুখোমুখি হই অন্যজিনিষের, আমার প্রফেসর তাঁর পরিবারের সাথে যেদিন পরিচয় করিয়ে দিলেন, সেদিনই দেখা মিলে এরিক বিনার সাথে, যিনি আমার অ্যাডভাইজরের স্বামী। পিকনিকে এরিকের সাথে খোশগল্পের ফাঁকে ফাঁকে জানতে পারি মজার কাহিনী, মোজাইক বানানোর কাজটা ওরা করেছিলো NCSA তে কর্মরত অবস্থাতে, তাই নেটস্কেপ কোম্পানী খোলার সময়ে লাইসেন্স করার দরকার হয়। ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো মাথামোটা কর্মকর্তাকে প্রস্তাব দেয়া হয়, নেটস্কেপ কোম্পানি বা অন্য যারাই ব্রাউজার প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করবে, তারা তাদের লভ্যাংশের একটা বড় অংশ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেবে। মাথামোটা কর্মকর্তা এরকম "অলাভজনক" প্রস্তাবে রাজি হয়নি, বরং বলে, এসবের বদলে কয়েক লাখ ডলার দিলেই অনেক ভালো, তাই সানন্দে মেনে নেয় নেটস্কেপ ও অন্যান্যরা, পরে যখন নেটস্কেপ সহ অন্যান্য ব্রাউজার কোম্পানির লালে লাল রমরমা অবস্থা হয় আর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দাম হয়ে যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় হাত। বেকুব একেই বলে আর কি।
----
নিজের গবেষণার ফাঁকে ফাঁকে NCSA কাজ করেছি প্রায়ই, বিজ্ঞানীটির সাথে ছাড়াও এখানকার সিকিউরিটি গ্রুপের সাথে কাজ করেছি। চমৎকার এই গবেষণাগারটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই আছে, তার মধ্যে একটি হলো The Cave, তথা একটি ভার্চুয়াল রিয়ালিটি কক্ষ,যাতে ঢুকে নক্ষত্রমালার মাঝে ঘুরে বেড়ানো যায়, অথবা মানবদেহের মধ্যে ভ্রমণ করা চলে ভার্চুয়ালি। পুরো প্রতিষ্ঠানে নানান দেশের কয়েকশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী কাজ করেন, বাংলাদেশী একজন প্রকৌশলী কাজ করতেন-- এখন অবশ্য উনি নেই, আর রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্টদের মধ্যে আমি ও আর দুই একজন কাজ করেছেন।
পাদটীকা
সর্বসাম্প্রতিক খবর হলো, এখানে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার ব্লু ওয়াটার্স বানাবার কাজ শুরু হয়েছে। এটাও মার্কিন সরকারের অর্থায়নে ও আইবিএমের সহযোগিতায়। হয়তোবা মানবকল্যাণ, ক্যান্সার গবেষণা, এসব কাজে ব্যবহার হবে এটি, অথবা মারণাস্ত্রের নকশা প্রণয়নে, কিন্তু ষাটের দশকের বিশ্ব আর নেই, তাই নেই এই সুপারকম্পিউটারটির বিরোধিতা।
পৃথিবীটা বদলে গেছে, পালটে গেছে তারুণ্যও ...
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ১১:২০