১. গুচ্ছ মাথা-ব্যথা
গুচ্ছ মাথা-ব্যথা বা সিএইচ (ক্লাস্টার হেডেইক) বিরলতম মাথা-ব্যথার মধ্যে একটি। হাজারে একজন আক্রান্ত হয় এই রোগে। একই সাথে, এটি মানব-শরীরে সম্ভাব্য যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির মাঝে অবস্থান করছে সবার ওপরে। অন্যান্য ব্যথার চেয়ে সিএইচ প্রচণ্ডতায় এতটাই বেশি যে- বিজ্ঞানিদের একটা বড় অংশ একে মাথাব্যথা না বলে 'নিউরাল ডিজঅর্ডার' বলে থাকেন।
সিএইচ কেন হয় সেটা এখনো বের করা যায় নি। 'কোন একটা কারণে' মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে একটা সঙ্কেত আসে, সেই সঙ্কেত পেয়ে ট্রাইজেমিনাল নার্ভ সক্রিয় হয়ে যায়, আর শুরু হয় ব্যথা। প্রথমে অনেক কিছুই ভাবা হয়েছিল। মাথায় টিউমার, নার্ভে গোলমাল, হাইপোথ্যালামাসে গোলমাল, ব্রেইন ওয়েভে সমস্যা, মাথার রক্ত শিরায় অতিরিক্ত চাপ, ধূমপান, মদ পান- ইত্যাদি ইত্যাদি; কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেল এদের কোনটাই সব ক্ষেত্রে খাপ খাচ্ছে না। চার বছরের শিশুরও হচ্ছে, চল্লিশোর্ধ্ব মদখোর-গাঁজাখোর বাউন্ডুলেরও হচ্ছে। নির্দিষ্ট কারণ? নেই।
পুরুষেরা এই রোগে নারীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণে আক্রান্ত হন। এই ব্যথাটা মাথার একপাশে দপদপায়। সাধারণত চোখের পেছনে, চোখের মণিতে বা আশেপাশে মূল ব্যথাটা শুরু হয়। পাশাপাশি কপালে, নাকে, দাঁতে, মাড়িতে ব্যথা চলতে থাকে। নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। হাইপোথ্যালামাস আমাদের দেহঘড়ি নিয়ন্ত্রণ করে; আবার এটিই ব্যথার সঙ্কেতটা পাঠায়। সুতরাং ব্যথাটা একটা নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে হাজির হয়। অনেকের ঋতু-ভিত্তিক ব্যথা করে, শীতকাল জুড়ে প্রতিদিন ব্যথা, বাকি সময়ে নেই। অনেকের নির্দিষ্ট সময়ে ব্যথা করে- দেখা গেল প্রতিদিন ঠিক রাত তিনটায় ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে প্রচণ্ড যন্ত্রণায়। এই কারণে সিএইচকে বলা হয় অ্যালার্ম ক্লক হেডেইক।
শিল্পীর চোখে সিএইচ এর প্রকাশ
ব্যথা একবার শুরু হলে ১৫ মিনিট থেকে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে। এসময় নাক দিয়ে পানি পড়ে বা জ্বালাপোড়া করে, মুখের একপাশ এবং মাড়ি ফুলে ওঠে, চোখ লাল হয়, বসে যায়। দিনে একবার থেকে আটবার ব্যথা করে, এরকম চলতে পারে সাত দিন থেকে এক বছর! তত্ত্বাবধায়নের জন্যে রোগীর সাথে কেউ না থাকলে ব্যথার চোটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অনেকে দাঁত উপড়ে ফেলেন, চোখের মণি ফাটিয়ে ফেলেন, নিজের মাথায় ঘুষি মারতে মারতে বড় রকমের কনকাশন হয়ে গেছে- এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকি নিয়ন্ত্রিত অবস্থাতেও যে খুব একটা স্বাভাবিক থাকতে পারেন তা না (ভিডিও); নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা করার কেস আছে অসংখ্য। এর কুখ্যাত আরেকটা নাম হয়ে গেছে তাই- সুইসাইড হেডেইক।
এর চিকিৎসা করে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব হয় না। যেহেতু সমস্যার উৎপত্তি হাইপোথ্যালামাসে, এবং হাইপোথ্যালামাস অপসারণ করা সম্ভব না- সেজন্যে সার্জারি করা হয় চারিপাশের নার্ভে। তাতে যে সুফল হয় সব সময় তা বলা যায় না, বরঞ্চ অবস্থা খারাপ হয়েছে এমন নজির আছে বহুৎ।
যাদের সামর্থ্য আছে, তারা ব্যবহার করছেন নার্ভ ইমপ্ল্যান্ট, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় বছর বছর ব্রেন সার্জারির ধকল সামলাতে গিয়ে মস্তিষ্কে অপূরণীয় ক্ষতি হবার ঝুঁকি রয়ে যায়।
ড্রাগস নিয়ে সুফল পেয়েছেন অনেকে। এলএসডি, আফিম, নানা বিভ্রম-সৃষ্টিকারী মাদক, মাশরুম গ্রহণ করলে ব্যথা কমে আছে বা কম অনুভূত হয় বলে বহুজনের ধারণা। কিন্তু সমস্যা হোল, যারা এপথে গেছেন, তারা নব্বুই ভাগই মাদক-নির্ভর, খাঁটি মাদকসেবী হয়ে গেছেন। মাদক ব্যতিত স্বাভাবিক জীবনযাপন তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না। সিএইচ আক্রান্ত ব্যক্তির জীবন ব্যাপ্তি এসব কারণে কমে আসে আশঙ্কাজনক ভাবে।
যাদের মাইগ্রেনের ব্যথা/ ক্রনিক মাথাব্যথা/মেডিকাল ডিপ্রেশন/ইনসমনিয়া আছে কিংবা ছিল, তাঁদের মধ্যবয়সে গিয়ে সিএইচ-এ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায় প্রায় দ্বিগুণ।
আর সিএইচ এর কোন আগাম লক্ষণ আবিষ্কৃত হয় নি আজ পর্যন্ত। এটি আপাতদৃষ্টিতে যে কারো মস্তিষ্কে আক্রমণ করতে পারে, যখন তখন।
২. মাংসখোর ব্যাকটেরিয়া
নেক্রোটাইযিং ফ্যাসিটিস বিরল এবং কুৎসিত একটি চর্মরোগ। এটা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে ছড়ায়। ব্যাকটেরিয়াগুলো বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে চামড়া আর পেশির মাঝখানের টিস্যু ধ্বংস করে দেয়; তখন পেশি পচতে শুরু করে, আর চামড়া খসে খসে পড়ে যায়।
রোগটি ছড়ায় অতিদ্রুত। নিরীহ একটা চুলকানি বারো থেকে চব্বিশ ঘন্টায় ছড়াতে ছড়াতে প্রাণহানি রোগে রূপান্তরিত হয়ে রোগীকে মেরে ফেলে একসময়। চিকিৎসা? অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে তৎক্ষণাৎ রোগ বিস্তৃত হবার হার কমান হয় প্রথমে, আক্রান্ত অঙ্গ বা অঙ্গাবশেষ তারপর সার্জারি করে অপসারণ করা হয়। ঠিক সময়ে শনাক্ত না করতে পারলে মৃত্যু নিশ্চিত। শনাক্ত করার পরও প্রতি একশ জন রোগীর মাঝে ৭৩ জন মারা যায়।
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ( অথবা ক্যান্সার, এইডস বা ডায়াবেটিস রোগী); বা অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করেন- তাঁদের এই রোগে অনেক বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এছাড়া দেহের ক্ষত পরিষ্কার না রাখাও অন্যতম কারণ। কিছু বিরল কেস আছে- যেখানে যৌনাঙ্গ এবং স্ক্রোটাম বা শুক্রাশয়ে-- অতিরিক্ত হস্তমৈথুনের কারণে, কিংবা ভুল-অনিরাপদ পন্থায় সারকামসিযন করানোর কারণেও এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটেছে।
যারা বাঁচেন- তাঁদের শরীর-চেহারা স্থায়ীভাবে বিকৃত হয়ে যায়। ঘন ঘন সার্জারি আর অ্যাম্পুটেশনের পর আক্রান্ত স্থানে আর চামড়া জন্মে না, হলুদ চর্বির নিচে লাল-বাদামি মাংস বেরিয়ে থাকে; স্কিন গ্রাফটিং ব্যতিত এই ক্ষত ঢাকা সম্ভব নয়। তুলনামূলক সুস্থ ব্যক্তিরাও বীভৎস ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ান সারাজীবন।
[সরাসরি ছবি দিতে চাচ্ছি না। উৎসাহীরা গুগল ইমেজে গিয়ে Necrotizing Fasciitis লিখে সার্চ দিন, অসংখ্য উদাহরণ এসে যাবে]
তবে স্বস্তির ব্যাপার, শরীরের কাটাছেঁড়া-ক্ষত সব সময় পরিষ্কার রাখলে এবং মোটামুটি স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করলে এরকম ব্যাকটেরিয়া সহজে আক্রমণ করে না।
৩. মস্তিষ্ক-প্রেমী অ্যামিবা
অ্যামিবা জগতের সরলতম পাবলিক। এরা অতি পিচ্চি, মাইক্রোস্কোপের নিচে রেখে দেখতে হয়। এককোষী প্রাণী, বাড়তি কোষ নেই, বাড়তি চিন্তাভাবনাও নেই। ক্ষণপদ দিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী ধরে ধরে খায়; পেট ভরে গেলে উপযুক্ত পরিবেশে নিজেকে দুই ভাগ করে বিভাজিত হয়ে যায়। আর খাবার না পেলে গুটির মতো আকার ধারণ করে অপেক্ষা করে। স্বাভাবিক মৃত্যু নেই-ই বলতে গেলে।
কিন্তু এই অ্যামিবার একটা জাত আছে, Naegleria fowleri, যারা মিষ্টি পানিতে থাকে। পুকুরে, দীঘিতে, কুয়ায়, ঝরনায়, নদীতে, ময়লা সুইমিং পুলে ইত্যাদি। এরাও নিরীহ পাব্লিক। সমস্যা হোল, মানুষের মস্তিষ্কে নিউরনগুলো পরস্পর যোগাযোগ করার জন্যে যে তরঙ্গ ব্যবহার করে- সেটাকে এরা ধরতে পারে, তখন ভুল করে মস্তিষ্কটাকে খাবার ভেবে নেয়। সুতরাং, একটা লোক যখন এই মিষ্টি উষ্ণ পানিতে নামবে, তখন অ্যামিবা পানিতে ভেসে ভেসে নাকে গিয়ে উঠবে। তারপর ক্ষণপদ ব্যবহার করে করে মস্তিষ্কে পৌঁছে যাবে। তারপর মহানন্দে ভোজন শুরু, জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধি শুরু!
প্রায় পনেরো দিন লাগে উপসর্গ প্রকাশ পেতে। ঘাড় শক্ত হয়ে থাকে, বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা, মাঝে মধ্যে বিনা কারণেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, হ্যালুসিনেশনে ভোগা ইত্যাদি। উপসর্গ প্রকাশের পাঁচ দিনের মাথায় রোগী মারা যায়।
চিকিৎসা যে নেই তা না। চিকিৎসা আছে, কিন্তু রোগটা ধরতে পারাই কঠিন। প্রায় পঁচানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে ভুল ডায়াগনোসিস দেওয়া হয়। রোগী মারা গেলে কারণ দেখান হয়- মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, কিংবা ফ্রন্টাল লোব ক্ষতিগ্রস্ত, এমনকি মেনিনজাইটিস-ও! বিশেষ করে এশিয়ায় মানুষের ভৌগলিক অবস্থান ও পেশার কারণে এই রোগ ধরতে পারাটা খুব কঠিন।
এবং হাস্যকর ব্যাপার, রোগটা ঠেকানো কোন ব্যাপার না। অ্যামিবা-অলা পানি ঢকঢক করে খেলেও অ্যামিবাটা মস্তিষ্কে যেতে পারে না। স্রেফ নাক দিয়ে ঢুকতে পারে, সুতরাং নাকে পানি যেন না যায় সেটা নিশ্চিত করলেই হোল!
এই অ্যামিবা আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে, ইউরোপে, পাকিস্তানে, এবং চীনে অফিসিয়ালি শনাক্ত করা গেছে।
৪. অকস্মাৎ মৃত্যু
সাডেন আন-এক্সপেক্টেড ডেথ সিনড্রোম রহস্যময় একটি রোগ। সাধারণতঃ ঘটে রাত্রিবেলায়। একজন সুস্থ সবল ব্যক্তি ঘুমাতে যাবে, ঘুমের মধ্যে কোন কারনে হৃদপিণ্ড থেমে যাবে, রক্তের স্রোত শরীরে আর বইবে না। মৃত্যু ঘটবে সাথে সাথে।
এই রোগ দেখা যায় উত্তরপূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীতে। চাইনিজ, ফিলিপিনো, জাপানি পুরুষরা সবচে বেশি আক্রান্ত হয়। ইন্টারেস্টিং কিছু কুসংস্কার জড়িয়ে আছে এর সাথে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধের সময় হমোং রিফিউজিদের মাঝে সর্বপ্রথম রোগটা ধরা পড়ে। তারা ভাবত- বিভিন্ন কারণে তারা পুরনো ঈশ্বরদের কাছে প্রার্থনা করতে ভুলে গেছে, তাই ঈশ্বরেরা খেপে গিয়ে আর প্রটেকশন দিচ্ছেন না। এই সুযোগে রাতের অপদেবতারা এসে মেরে ফেলছে তাদেরকে একে একে।
ফিলিপিনোরা বলে- এক ধরণের কুঁজো কুৎসিত প্রাণী রোগীর মুখে বা বুকে ভর দিয়ে বসে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ করে দেয়, নড়তে চড়তে দেয় না। একে কেবল রোগীই দেখতে পায়। তখন জিভে কামড় দিয়ে পায়ের আঙুল নাড়াতে হয়, নইলে মৃত্যু নিশ্চিত!
বিজ্ঞানীরা যে এদের চেয়ে ভাল কোন কারণ বের করতে পেরেছেন তাও না। কেন এ রোগ হয়, মৃত্যু ঘটে বের করা যায় নি। রোগ প্রতিরোধের কোন ওষুধও নেই। বুকে হার্ট ডিফিব্রিলেটর লাগিয়ে শুলে মৃত্যু ঠেকানো যাবে; কিন্তু রোগ র্যানডমভাবে দেখা দেয় বলে এই সতর্কতা সব সময় বজায় রাখা সম্ভব নয়।
৫. পরজীবী এবং মাইন্ড কন্ট্রোল
খাদ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে বাসস্থানের জন্যে যে প্রাণী/উদ্ভিদ অন্যের ওপরে নির্ভরশীল, তারাই পরজীবী। অনেক ভাল পরজীবী আছে, যারা আসলে হোস্টের (যার ওপর নির্ভরশীল) উপকার-ই করে বলতে গেলে। কিছু আছে, অপকার করে। পুষ্টি শুষে নেয়, হোস্ট অপুষ্টিতে ভোগে।
আর কিছু আছে, যারা হোস্ট এর শরীরের ভেতরে ঢুকে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে, প্রয়োজন হলে হোস্টকে দিয়ে আত্মহত্যা করায়!
যেমন ধরা যাক হর্সহেয়ার পরজীবীর কথা। এরা শিশু ঘাসফড়িঙয়ের শরীরে ঢুকে বাস করা শুরু করে, তারপর ঘাসফড়িং পরিণত হলে একে পানিতে লাফিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে। তারপর মৃত ঘাসফড়িঙয়ের দেহ থেকে বেরিয়ে বংশবৃদ্ধি করে। তখন নতুন ঘাসফড়িং হোস্ট খুঁজতে শুরু করে আবার। (ভিডিও)
জেনোস ভেস্পেরাম নামক পরজীবীরা স্ত্রী/পুরুষ লিঙ্গে বিভক্ত। এরা পুরুষ বা স্ত্রী বোলতার শরীরে বসত গাড়ে, ফলে বোলতাটি আকারে ছোট থেকে যায়, বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। যখন পরজীবীর প্রজনন ঋতু আসে, এরা যার যার হোস্টকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। পুরুষ পরজীবী নিজের হোস্টকে মেরে ফেলে, তারপর স্ত্রী পরজীবীর সাথে মিলিত হয়। স্ত্রী পরজীবী নিজ হোস্টের দেহের ভেতরেই লার্ভার জন্ম দেয়, তারপর হোস্টকে বাধ্য করে শীতনিদ্রায় যেতে। এই ফাঁকে লার্ভা বড় হয়, তারপর ঐ হোস্টকে মেরে ফেলে বাইরে বেরোয়।
কর্ডিসেপস নামের এক প্রকার ফাঙ্গাস- এদের প্রায় ৪০০ টা প্রজাতি আছে, একেক প্রজাতি একেক টাইপের কীটপতঙ্গকে আক্রমণ করে। একটা জাত শুধু পিঁপড়েকে সংক্রমিত করে। আক্রান্ত পিঁপড়ে কোন উঁচু জায়গায় গিয়ে ঝিম ধরে বসে থাকে, আর কখনো নড়াচড়া করে না। সময় অতিবাহিত হতে থাকে, পিঁপড়ের দেহ, মাথা, পা ফেঁড়ে ফাঙ্গাস বাড়তে থাকে তরতর করে। অন্য কোন পিঁপড়ে কাছাকাছি এলে সেও আক্রান্ত হয়, এভাবে পুরো কলোনিতে ছড়িয়ে পড়ে ফাঙ্গাস মহামারির মতন। (ভিডিও)
মাছের ক্ষেত্রে এরকম পরজীবী অহরহ দেখা যায়। এছাড়া ফ্লুক নামের পরজীবী আছে, আক্রান্ত করে শামুককে। শামুকের শুঙ্গতে ডিম পেড়ে সেটাকে পোকার মত আকৃতি ধরায়, তারপর শামুককে বাধ্য করে উঁচু জায়গায় যেতে। কোন পাখি সেই শুঙ্গ দেখে খাবার ভাবে, খায়, তারপর নিজেই আক্রান্ত হয় পরজীবীতে। এভাবে পরজীবীর জীবনচক্র মায়াদয়াহীনভাবে সামনে এগোয়। (ভিডিও)
স্বাভাবিকভাবেই কথা ওঠে, আমাদের, মানুষের ক্ষেত্রে এরকম কোন পরজীবী আছে কিনা? নিরীহ পরজীবী তো কতই আছে, ফিতাকৃমি-যকৃৎকৃমি- এমনকি সংজ্ঞানুসারে মানব ফিটাসও পরজীবীর গোত্রে পড়ে; কিন্তু মানব মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, আমাদের হাব-ভাব-চলন পরিবর্তন করতে সক্ষম- এমন পরজীবী পাওয়া গেছে কি?
গত শতাব্দিতেও উত্তর ছিল - না। কিন্তু টক্সোপ্লাজমা গোণ্ডী নামের এককোষী প্রোটোজোয়া পালটে দিয়েছে সমীকরণ।
টক্সোপ্লাজমা অতি কমন, থাকে বিড়ালের নাড়িভুঁড়িতে। মলের সাথে বেরোয়, বাতাসে-মাটিতে-পানিতে যেকোনোভাবে ছড়াতে পারে। সাধারণতঃ আক্রমণ করে ইঁদুরকে। আক্রান্ত ইঁদুর, বেড়াল দেখে আর ভয় পায় না, বরঞ্চ বেড়ালের মূত্রের ঘ্রাণে আকর্ষিত হয়, পারলে তারাই তখন খুঁজে খুঁজে বের করে বেড়ালকে। এইটুকুই টক্সোপ্লাজমার ক্ষমতা- বিজ্ঞানীরা অন্ততঃ তাই ভেবেছিলেন।
কিন্তু তারপর গবেষণায় দেখা গেল- না! - টক্সোপ্লাজমা আক্রান্ত করছে মানুষকেও! এমনকি বর্তমানে ধারণা করা হচ্ছে, বেড়াল পোষা জনপ্রিয় শখ হয়ে যাওয়ায়, সমগ্র মানবজাতির প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ আক্রান্ত এই পরজীবীতে।
তো টক্সোপ্লাজমা কিভাবে পরিবর্তন করে মানুষের আচরণ? পরীক্ষা করে বের করা হোল - আক্রান্ত পুরুষেরা তুলনামূলক বেশি সন্দেহে ভোগেন, ঝোঁকের মাথায় কাজ করেন। আক্রান্ত নারীরা সহজে রেগে যান, নিজের ইমেজ নিয়ে অস্বস্তিবোধ করেন। এসব বৈশিষ্ট্য সুইসাইডের পেছনে অপ্রধান ভূমিকা রাখতে পারে।
আচরণ নিয়ন্ত্রণের কথা বাদ দিলেও, টক্সোপ্লাজমা কম মারাত্মক নয়। আক্রান্ত রোগীর ঠাণ্ডা, মাথাব্যথা দু-এক সপ্তা থাকতে পারে, জীবনঘাতি নয়। কিন্তু দুর্বল রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মানুষেরা বা শিশুরা আক্রান্ত হলে সহজেই মারা যেতে পারে। গবেষকরা বলেন- প্রতি বছর ছ'কোটি মানুষ মারা যায় এর কারণে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মূল কারণ ধরা পড়ে না।
এছাড়া আতঙ্কের ব্যাপার- টক্সোপ্লাজমার সাথে সিজোফ্রেনিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা গেছে। গত শতাব্দীতে হুট করেই বৃদ্ধি পেল ঘরে ঘরে বেড়াল পোষার অভ্যেস, এবং কি আশ্চর্য, ঠিক সেই সময়ে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে গেল! এই পরজীবী-আক্রান্ত রোগীকে সিজোফ্রেনিয়ার ওষুধ দিয়ে দেখা যাচ্ছে- সেটি দেহে টক্সোপ্লাজমা-বিরোধী প্রভাব সৃষ্টি করে ফেলছে! এই পরজীবীতে আক্রান্ত গর্ভবতী মায়েরা পরবর্তীতে যে শিশু জন্ম দিচ্ছেন- তাদের একটা বড় অংশ পরবর্তী জীবনে সিজোফ্রেনিয়াক হয়ে যাচ্ছে।
যদি এককোষী সিম্পল গড়নের একটা প্রোটোজোয়া এরকম বিশাল ঝুঁকিতে ফেলতে পারে আমাদের, তাহলে প্রশ্ন ওঠে- অদূর ভবিষ্যতে গল্পে-সিনেমায় দেখা মাইন্ড-কন্ট্রোলিং প্রাণীর অস্তিত্ব বাস্তব হওয়া কি অসম্ভব কিছু?
বিজ্ঞান বলছে- না, বিবর্তনের ধাপে ধাপে খুবই সম্ভব সেটা।
*আনন্দময় দুনিয়ার ততোধিক আনন্দময় খুঁটিনাটি - ১
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৫২