দক্ষিণ এশিয়ায় জলবিদ্যুৎ গ্রিড বাংলাদেশের জন্য একটি মৃত্যুফাঁদ।
ভরা বর্ষায় যখন সবগুলি নদী পানিতে পরিপুর্ন, ভারত সরকার তখন ত্রিপুরার ডাম্বুর বাঁধ খুলে ডাম্বুর লেক এর পুরো পানি ছেড়ে দিল, ফলাফল: ফেনি কুমিল্লায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। ডাম্বুর লেক এর পানি ধারণ ক্ষমতা ০.২৩ ঘন কিলোমিটার (সুত্র-১)। অনেকটা যেন পানিবোমা বিষ্ফোরন ঘটানোর মত বিষয়। এই ঘটনা ভবিষ্যতে বারে বারে ঘটতে পারে - সেই কথা মাথায় নিয়ে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। যাতে এর পরেরবার যখন ভারত সরকার এই ঘটনা ঘটাবে - আমরা যেন আগে থেকে প্রস্তুত থাকি।
এক ঘন কিলোমিটারের চারভাগের একভাগ পানি দিয়ে যদি এইরকম সর্বনাশা দুর্যোগ ঘটানো যায়, তাইলে যেসব বাঁধের ধারণ ক্ষমতা এক ঘন কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি, অথবা কয়েকটি বাঁধ সম্মিলিত ভাবে কোন এক বর্ষার রাতে যদি বাংলাদেশের উপর কোন রকম পূর্বাভাস ছাড়া খুলে দেওয়া হয় তাইলে কি ঘটতে পারে একটু কল্পনা করুন। ২০২১ সালের একটা সমীক্ষা (সুত্র-২) অনুযায়ী যমুনা/ ব্রক্ষপুত্র নদীর উজানে পানি ধারণ ক্ষমতা এক ঘন কিলোমিটারের বেশী এমন একাধিক বাঁধ ভারত সরকার কর্তৃক নির্মানাধীন আছে।
চিত্র-১: যমুনার উজানে নির্মানাধীন ১ ঘন কিলোমিটার বা অধিক রিজার্ভার ক্যাপাসিটির তিনটি জলবিদ্যূৎ প্রকল্পের অবস্থান (সুত্র-২)
যত দিন যাচ্ছে, বাংলাদেশের উজানে ভারত তত বাঁধ তৈরী করছে। এক সময় আমরা শুধু ফারাক্কা নিয়ে কথা বলতাম এরপর এর সাথে যোগ হল গজলডোবা, এরপর টিপাইমুখ। এখন জানলাম ত্রিপুরার ডাম্বুর বাঁধের কথা। গজলডোবার উজানে সিকিম ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের ২০ টা পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প আছে। তিস্তার অর্ধেক পানি সেখানে আটকে থাকে, বাকি অর্ধেক পানি যা গজলডোবায় আসে, তা পুরোটাই পশ্চিম বাংলার দরকার (মমতা ব্যানার্জির ভাষ্য মতে)
সিকিম রাজ্যের জল বিদ্যুৎ পটেনশিয়াল প্রায় ৮ গিগাওয়াট (১ গিগাওয়াট = ১০০০ মেগাওয়াট)। এর অর্ধেকের বেশি বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের আকারে ভারতের গ্রিডে সংযুক্ত হয়ে গেছে। এই সব বাঁধ নির্মানের আগে ভাটির দেশ বাংলাদেশের কৃষি, পরিবেশ, জলবায়ু, জীব বৈচিত্র, মানুষের জীবনযাত্রা ইত্যাদির উপরে কি ধরণের প্রভাব পড়বে তা নিয়ে ভারত সরকার কোন পরোয়াই করে নাই। প্রতি বছর অতি ক্ষরা এবং অতি বন্যায় তিস্তা অববাহিকা বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটা কালেক্টিভ পানিশমেন্ট এলাকা হয়ে গেছে।
সিকিমের পূর্ব দিকে ভুটান। ভুটানের জল বিদ্যুৎ পটেনশিয়াল প্রায় ২৪ গিগাওয়াট। এর প্রায় দশ ভাগের একভাগ বিভিন্ন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মানের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত হয়ে গেছে। ভুটানের মধ্য দিয়ে আসা যমুনার উপনদী গুলোর উপর আগামী ১০ বছরের মধ্যে অনেকগুলি জলবিদ্যুতের প্রকল্প সমাপ্ত হলে যমুনা নদীর পানির প্রবাহ আরো সংকুচিত হবে।
ভুটানের পূর্ব দিকে ভারতের অরুনাচল প্রদেশ। যমুনা (ব্রক্ষপুত্র) নদীর শতকরা ৬০ ভাগ পানি অরুনাচল প্রদেশ থেকে আসে।
২০১৪ সালের বাংলাদেশ ভারত যৌথ কারিগরি টিম (JTT) রিপোর্ট অনুযায়ী আরুনাচল প্রদেশে ভারত সরকার ১৫৪ টি জলবিদ্যুত প্রকল্প নির্মানের পরিকল্পনা করেছে। প্রায় ৫৭ গিগাওয়াট সক্ষমতার এইসব প্রকল্প থেকে ভারতের মূল ভুখন্ডে বিদ্যুৎ পরিবহন করে নেওয়ার জন্য একাধিক উচ্চ ক্ষমতার বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন নির্মান করতে হবে। এইখানেই ভারতের বাংলাদেশকে দরকার।
চিত্র ২: ২০১৪ সালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে করিডোর লাইন নেওয়ার জন্য ভারতের দেওয়া প্রাথমিক প্রস্তাব
চিকেন নেক (শিলিগুরি করিডোর) শিলিগুরি শহর, বিভিন্ন রেল, রোড, পানির খাল এবং অনেকগুলি বৈদ্যুতিক লাইনের কারনে ইতোমধ্যে ঘিঞ্জি হয়ে গেছে। নতুন করে উচ্চ ক্ষমতার বৈদ্যুতিক লাইন নির্মান করতে গেলে রাইট অফ ওয়ে পাওয়া সমস্যা। আরো বড় সমস্যা হল দোকলাম ভ্যালিতে চিনা সেনাবাহিনীর ঘাটি। ভারত চিনের মধ্যে যে কোন বড় ধরনের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চিন চেষ্টা করবে শিলিগুরি করিডোর দখলে নিয়ে সেভেন সিস্টার রাজ্য গুলোকে ভারতের মূল ভুখন্ড থেকে আলাদা করে দিতে। কাজেই বৈদ্যুতিক গ্রিডের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাকবোন লাইন শিলিগুরি করিডোর দিয়ে বানানো ভারতের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে এই ব্যাকবোন লাইন বানালে ঝুঁকি অনেক কমে যায়।
সারা পৃথিবীতে প্রায় ১৫০ টি আন্ত সীমান্ত নদীর ৫৪ টিই বাংলাদেশ ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে প্রবাহিত। আন্তর্জাতিক আইনের কোন তোয়াক্কা না করে এই নদী গুলোর উপর ভারত একের পর এক বাঁধ নির্মান করে এক তরফা ভাবে পানি প্রত্যাহার, শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখা, ভরা বর্ষায় বাংলাদেশকে না জানিয়ে পানি ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে হঠাৎ বন্যায় ভাটি অঞ্চলকে ভাসিয়ে দেওয়া ইত্যাদি অপরাধ মূলক কাজকর্ম করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের উজানে যত বাঁধ ভারত তৈরী করবে এই অপরাধ মূলক কার্যক্রম আরও বাড়তে থাকবে। ভারতকে বৈদ্যুতিক করিডোর দিলে বাংলাদেশের উজানে পরিকল্পনাধীন অনেক বাঁধ নির্মানের জন্য ভারতের বিভিন্ন সংস্থা বিনিয়োগ যোগাড় করতে পারবে। এইজন্যই ভারতকে বৈদ্যুতিক করিডোর নির্মান করতে সাহায্য করা বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী একটা সিদ্ধান্ত।
যেখানে ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মান ঠেকানোর জন্য কুটনৈতিক, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি অঙ্গনে জোর প্রচেষ্টা চালানোর প্রয়োজন ছিল, সেইখানে শেখ হাসিনা রেজিমের ভারতীয় দালালরা ভারত, ভুটান এবং নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির নামে ভারতকে বৈদ্যুতিক করিডোর দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এই অপচেষ্টা ঠেকানোর জন্য সরকারের ভিতরের কিছু কর্মকর্তা আপ্রাণ চেষ্টা করায় করিডোর লাইন বাস্তবায়নের বিষয়টি আওয়ামী সরকার আরম্ভ করতে পারে নাই।
এখন দেখা যাচ্ছে ইউনুস সরকারও ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের মত একই রাস্তায় হাঁটা আরম্ভ করেছে। বাংলাদেশ খুবই সস্তা আরকি। যে যেভাবে পারে বেচে দিয়ে খেয়ে যাচ্ছে।
সাউথ এশিয়ান গ্রিডের নামে এই মূহুর্তে বরনগর-পার্বতিপূর-কাতিহার ৭৬৫ কেভি সঞ্চালন লাইন নামক এই করিডোর লাইন নির্মানের নকশা প্রণয়নের জন্য পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসি পরামর্শক নিয়োগ করেছে বলে জানা যায়। এছাড়াও এই লাইনের পরিবেশগত ইত্যাদি ছাড়পত্র প্রণয়নের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন পাওয়ার সেলে আরেকটি পরামর্শক নিয়োগের কার্যক্রম চলমান আছে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশের নদীর উজানে বাঁধ নির্মানের প্রকল্প গুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পানি প্রত্যাহারের মত বিষয়ের সাথে জড়িত হলেও কয়েক বছর ধরে তিস্তার পাশাপাশি সিলেটে হঠাৎ বন্যার প্রকোপ বেড়ে গেছ। ২০২২ সালের বন্যায় সরকারি হিসাবমতেই বাংলাদেশের ক্ষতি প্রায় ৮৭ হাজার কোটি টাকা, সেই সময়কার জাতীয় বাজেটের প্রায় ১৫%। এইবার ত্রিপুরার ডাম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়ার পর একটা বিষয় ক্রমান্বয়ে পরিষ্কার হচ্ছে। বাংলাদেশকে ঘিরে অসংখ্য বাঁধ নির্মানের উদ্দেশ্য প্রাথমিক ভাবে অর্থনৈতিক বলে প্রচার করা হলেও এই অবকাঠামো গুলোকে ব্যাপক বিদ্ধংসী পানি বোমা হিসাবে ব্যাবহার করার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এইটা এক ধরণের "ওয়েপন্স অব মাস ডিষ্ট্রাকশন" WMD। বাংলাদেশকে ঘিরে ভারত একধরণের WMD তৈরী করছে, যাকে ভবিষ্যতে বারে বারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা যাবে।
২০১৭ সালে মেঘালয় থেকে নেমে আসা বন্যার পানিতে তেজস্ক্রিয়তা (সুত্র-৩) থাকার কারনে মাছ এবং জলজ পাখি ইত্যাদির গনহারে মারা যাওয়ার খবর আরো উদ্বেগজনক, উজানের দেশ যদি ভাটিতে শুধু হঠাৎ বন্যার ক্ষতির বাইরেও আতিরিক্ত ক্ষতি করতে চায়, যেমন বাঁধের পানিতে কোন ক্ষতিকর কেমিকেল অথবা তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশিয়ে তারপর ভাটির দেশের উপরে তা ছেড়ে দিতে চায় তা খুবই সম্ভব। এবং ভারতের মত দেশের পক্ষে, যারা নিয়মিত ভাবে বাংলাদেশের বর্ডারে গুলি করে মানুষ মেরে আসছে, এইরকম নাশকতা ঘটানো অসম্ভব না।
সুত্র:
(১) Click This Link
(২) Click This Link
(৩) Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০২৫ ভোর ৫:৪০