পূর্বের গল্পের লিংক
বড়ই গাছের ভুত (অবাস্তব ভুতের বাস্তব কাহিনী)
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
দেশ স্বাধীন হবার কয়েক বছর পরের ঘটনা। ভাদ্র মাসের শেষ সময়। পুরো এলাকা তখনও বন্যার পানিতে তলানো। পানির উপরে ধান গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকায় পুরো মাঠ ধনক্ষেত বোঝা গেলেও পানির পরিমাণ বোঝা যায় না। দিগন্তজোড়া সবুজের সমারোহ হলেও সবুজ ধান গছের নিচেই এক বুক, এক গলা পরিমাণ পানি। পানি কমতে শুরু করেছে। পানি কমার কারণে প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। আমরাও মাছ ধরার জন্য ধান ক্ষেতের আইলে চাঁই পেতেছি।
আমাদের বাড়ির পিছনে ছোট নালার মত আছে। খুব গভীর নয় আবার সমতলও নয়। নালাটি উঁচু জমি থেকে এক হাঁটু পরিমাণ নিচু। বর্ষা শেষে এই নিচু জমি দিয়ে উজানের পানি নেমে যায়। বাড়ি থেকে তিন চারশ’ গজ দক্ষিণে এবং রাস্তা থেকে পঞ্চাশ গজ পশ্চিমেই বড়ই গাছ। এই বড়ই গাছের তলেই কয়েক বছর আগে আয়তন নেছা সন্ধ্যা রাতে জ্ঞান হারিয়েছিল। যে কারণে এই বড়ই গাছকে সবাই ভূতুড়ে বড়ই গাছ হিসাবে জানে। বড়ই গাছ থেকে পশ্চিমে নালার অপর প্রান্ত পর্যন্ত পুরো নালাটিই বাঁশের বানা দিয়ে ঘের দেয়া হয়েছে।
প্রায় দুই থেকে আড়াইশ গজ বাঁশের বানার মাঝে মাঝে দশ পনরো হাত পরপর চার ছয় ইঞ্চি ফাঁক রেখে সেই ফাঁকের মুখে একটি করে চাঁই বসানো আছে। ভাদ্র মাসের শেষ সময়ে চাঁইয়ে প্রচুর মাছ ধরা পড়ছে। বড় বড় রুই কাতলা চাঁইয়ের ভিতর আটকা পড়লে বের হওয়ার জন্য দাপাদাপি করে চাঁই ভেঙ্গে ফেলে। দিনে বড় মাছের শব্দ শুনলে তাড়াতাড়ি গিয়ে চাঁই ভাঙ্গার আগেই মাছ উঠানো যায়। কিন্তু রাতে পাহাড়া না দিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে অনেক সময় মাছ চাঁই ভেঙ্গে বের হয়ে যায়।
সন্ধ্যার সময় বাড়ির চাকর নাদু বলল. চাচা আইজ রাইতে আমাগো চাই পাহাড়া দেওয়া লাগবো। আইজ অনেক মাছ পড়বার পারে।
আমি নাদুকে জিজ্ঞেস করলাম, আজ এতো মাছ পড়ার কারন কি?
নাদু বলল, আইজ সারা দিন অনেক চড়া রোদ গ্যাছে। বানের পানি অনেক শুকাইছে। পানির খুব টান ধরছে তো, যে কারণে মাছ ধরা পড়বো। মাছ পাহাড়া না দিলে বড় বড় মাছগুলা চাঁই ভাইঙ্গা বাইর হইয়া যাইবো।
আমি নাদুর কথায় সায় দিয়ে বললাম, ঠিক আছে।
রাত আটটা নয়টার দিকে দু’জনেই ভাত খেয়ে দু’টা বালিশ একটা চাটাই আর দু’জনে দু’টা বাঁশের লাঠি নিয়ে চাঁইয়ের কাছাকাছি রাস্তায় চলে এলাম। রাস্তাটি পানি থেকে অনেক উঁচু। রাস্তার উপরে মাঝখানে চাটাই পেতে বসে আছি। ফটফটা চাঁদনী রাত। অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যায়। মাঝে মাঝে রাত চোরা পাখির ফুরুৎ ফুরুৎ শব্দ কানে আসে। মশার উৎপাতও কম নয়। নাদু মশার উৎপাত সহ্য করতে না পেরে ধানের খড় দিয়ে ভূতি বানিয়ে তাতে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। ভূতির ধোয়া দিলে মশার উপদ্রব কিছুটা কমে। নাদু বাতাসের উজানে ভূতি রেখে দেয়ায় মশার উপদ্রব কিছুটা কম। অনেক রাত হলে আমি খালি চাটাইয়ের উপর বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছি। নাদুও তার বালিশে মাথা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে গুনগুন করে গান গাইছে।
রাত এগারোটা বারোটার সময় দুই জনে পানিতে নেমে চাঁই উঠিয়ে কিছু মাছ তুলে এনেছি। মাছগুলো রাস্তার কাছাকাছি বড় একটি চাঁইয়ের মধ্যে ঢেলে অর্ধেক পানিতে ডুবিয়ে রেখেছি। চাঁই অর্ধেক পানিতে ডুবিয়ে রাখার কারণে মাছ মরবে না, কয়েক দিন পর্যন্ত তাজা থাকবে। মাছগুলো চাঁইয়ের ভিতর রাখার পর বন্দী অবস্থায় কিছুক্ষণ লাফালাফি করে ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে নিরব হয়েছে।
রাত একটা দেড়টার দিকে দুইচোখে ঘুম চেপে এসেছে। আকাশে মেঘ বিহীন পুরো চাঁদ। হঠাৎ পশ্চিম দিক থেকে পানির উপর দিয়ে কোনও চারপায়া প্রাণী হেঁটে আসার শব্দ কানে আসল। আমরা দুইজনেই এই শব্দের তেমন কোন গুরুত্ব না দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছি। পানির উপর হেঁটে আসার শব্দ ক্রমে বাড়ছে। বোঝা যাচেছ প্রাণীটি পানির উপর দিয়ে আমাদের দিকেই আসছে। মাথা তুলে পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখি কালো কুকুরের মত দেখা যায়। কুকুরটি পশ্চিম দিক থেকে আমাদের পাতানো চাঁইয়ের ঠিক কাছাকাছি এসেছে। আমি নাদুকে বললাম, কুত্তা কি চাঁইয়ের মাছ খাইবো নাকি?
নাদু বলল, কেন চাচা, কুত্তা তো কাঁচা মাছ খায় না।
-- তাইলে পশ্চিম দিক থেকে ওইটা কি আইসে?
একথা শুনে নাদু শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল। পশ্চিম দিকে তাকিয়ে বলল, দেখতে তো কুত্তার মতই মনে হয়। ধান গাছের উপর দিয়া হাইটা আসতেছে।
নাদুর কথা শুনে আমিও উঠে বসলাম। পশ্চিম দিকে মুখ করে বসে তাকিয়ে দেখি সত্যিই ধান গাছের উপর দিয়ে চার পা ফেলে কালো কুকুর আমাদের দিকেই আসছে।
নাদু হাতের লাঠি উঁচিয়ে বলল, এই কুত্তা, এদিকে আসবি তো পিটন দিয়া মাজা ভাইঙ্গা ফালামু।
নাদু একথা বলার পরও একই ভাবে পানির উপর দিয়ে ছোপ ছোপ শব্দ করে কুকুর হেঁটে আসছে।
আমি বললাম, এটা কোন বাড়ির কুত্তা, এতো রাইতে পশ্চিমে গেছিলো কি করতে?
নাদুও আমার কথার সাথে সাথে সায় দিয়ে বলল, হ চাচা, আমিও তো তাই ভাবতেছি। এক বুক পানি ভাইঙ্গা পশ্চিমে কার বাড়ি গেছিল?
নাদুর মুখে একবুক পানির কথা শোনার সাথে সাথে আমার সম্বিৎ ফিরে এলো। কুকুর তো কখনও এক বুক পানির উপর দিয়ে হেঁটে আসতে পারে না? এক হাঁটু পানিতেই যেখানে কুকুরের সাঁতার হয় সেখানে একবুক পানি তো অনেক। নিশ্চয় এটা কুকুর নয় অন্য কিছু। এ কথা মনে হতেই ভয়ে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠল। সাথে সাথে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। নাদুকে উদ্দেশ্য করে বললাম, নাদু চাচা, তাড়াতাড়ি লাঠি নিয়া খাড়া হন। এ শালা তো কুত্তা না। এক বুক পানির উপর দিয়া কুত্তা আবার হাইটা আসে কেমনে?
আমার কথা শুনে নাদু সায় দিয়ে বলল, হ চাচা, ঠিকই তো! এক হাঁটু পানিতে যেহানে কুত্তার সাঁতার হয় সেইহানে এক বুক পানির উপর দিয়া কুত্তা আবার হাইটা আসে কেমনে? বলেই নাদু লুঙ্গি মালকোছা দিতে দিতে বলল, চাচা লুঙ্গি কাছা মাইরা রেডি হন। এইডা কুত্তা না, অন্য কিছু! বলেই সে বলে উঠল, এই কুত্তা, আর এক পা সামনে আসবি তো ঠ্যাং ভাইংগা ফালামু।
কিন্তু কুকুর সেই আগের মতই একই গতিতে এগিয়ে আসছে। চাঁদের আলোতে কালো লম্বা চারটি ঠ্যাং ঠিক কুকুরের মতই মনে হচ্ছে। আমিও নাদুর দেখাদেখি জোরে জোরে ধমক দিয়ে বললাম, এই কুত্তা, আর এক পা সামনে আসবি তো লাঠি দিয়া পিটাইয়া মাথা ছেঁইচা ফালামু।
আমরা যত ধমকই দেই না কেন, কোন কিছুতেই কুকুর থামছে না। কুকুর একই গতিতে আমদের দিকে হেঁটে আসছে। মুখে জোরে জোরে যাই বলি না কেন এদিকে ভয়ে আমাদের হাত পা থর থর করে কাঁপছে। ওদিকে কুকুর প্রায় একশ’ গজের মধ্যে চলে এসেছে। আমাদের থেকে পঞ্চাশ গজ দুরে সেই ভুতুরে বড়ই গাছ। যে গাছের নিচে আট দশ বছর আগে আয়তন নেছা নামের সদ্য বিবাহিতা মহিলা রাতে দুই দুইবার চিৎ হয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। ওই ঘটনার পরে আরো অনেকেই ভয় পেয়েছে। আমরাও মাঝে মাঝে গভীর রাতে এই বড়ই গাছের নিচে আলোর নাচানাচি দেখেছি। কুকুরটি ঠিক ঐ বড়ই গাছের দিকেই চলে আসতেছে। ভয়ে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে মনে ভাবছি আরেকটু সামনে আসলেই চাঁটাই বালিশ ফেলেই বাড়ির দিকে দৌড় দিব। নাদু একটু ফাঁকে ছিল, ভয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। দু’জনে মিলেই খুব ধমক ধামক দিচ্ছি কিন্তু কোন কিছুতেই বাঁধা মানছে না।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মাঠে এক বুক এক গলা পরিমাণ পানি তার উপরে ধান গাছ, ধান গাছও এক কোমর পরিমাণ উঁচু, তার উপর দিয়ে কুকুর হেঁটে আসছে অথচ চার, ছয় ইঞ্চি পানিতে কুকুর হাঁটলে যে রকম ছোপ ছোপ শব্দ করে সেই রকম পানিতে হেঁটে আসার শব্দ হচ্ছে। এই ভৌতিক দৃশ্য দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল। কুকুর প্রায় বড়ই গাছের কাছাকাছি এসেছে। নাদু আমকে উদ্দেশ্য করে বলল, চাচা আর থাকা ঠিক হইবো না। এবার বাড়ির দিকে দৌড় দ্যান।
দৌড় দিতে যাবো এমন সময় আমাদের বাড়ির সামনে থেকে বাবার কণ্ঠ শোনা গেল। বাবা নাদুকে ডাক দিয়ে বলল, এই নাদু কি হইছেরে?
নাদু জবাব দিল, দাদা একটা কুত্তা পানির উপর দিয়া আমাগো দিকে আইতেছে। ধমক দিলেও থামে না।
এ কথা শুনে বাবা ডাক দিয়ে বলল, তোরা দুইজন ঐহানেই থাক, আমি আইতেছি।
বাবা কিছুদুর এসে বলল, এই নাদু, কুত্তা কি এহনও আইতেছে রে?
নাদু বলল, হ দাদা, এহনও আইতেই আছে। থামে নাই।
নাদুর কথা শুনে বাবা কুকুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, কি- রে-- পোলাপানে মাছ ধরবার আইছে তর সহ্য হইল না, না-- হ ? ভয় দেহাইবার আইছস। যেহান থাইকা আইছস সেইহানে ফিরা যা, নইলে কিন্তু লাঠির পেটন খায়া মরবি। মনে করছোস আমি ঘুমাইয়া গেছি না-- হ? বলেই জোরে জোরে তিনটা গলা খাকারী দিতেই কুকুর থেমে গেল।
কুকুর থেমে যাওয়ায় পানির উপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর ছোপ ছোপ শব্দও বন্ধ হয়ে গেল। বাবা আবার নাদুকে জিজ্ঞেস করল, কিরে নাদু, কুত্তা কি এহনও আইতেছে না থামছে?
নাদু বলল, দাদা কুত্তা থামছে।
বাবা বলল, খালি থামলে তো হইবো না। যেহান থাইকা আইছে হেইহানে যাইবার ক--। বলেই বাবা কুকুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, কিরে ফিরা যাবি, না আমার হাতের পিটন খাবি? একথা বলেই বাবা আবার জোরে গলা খাঁকারি দিলো। বাবার গলা খাঁকারী শুনে কুকুর বাবার দিকে ফিরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থকল এরপর আস্তে আস্তে যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই চলে গেল।
বাবা ইতমধ্যেই আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছেন। কুকুর পিছন ফিরে কিছুদুর যাওয়ার পরেই আর কোন সাড়া শব্দ নেই। ভাল করে তাকিয়ে দেখি কুকুরের কোন চিহ্নই আর দেখা যায় না।
বাবা আবার কুকুরকে উদ্দেশ্য করে বলল, কই গিয়া মিশা গেলিরে? এই এলাকায় আর যেন না দেহি। সোজা ঠাকুরের ভিটায় চইলা যা।
ঠাকুরের ভিটা মাঠের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত। ভিটাটি সম্পূর্ণ পোড়ো ভিটা। আগাছা এবং নানা ধরনের গাছগাছালিতে ভরা। রাতের আঁধারে মাঝে মাঝে ভুতের আলো জ্বলে উঠে। ঠাকুরের ভিটায় আলো জ্বলে এক জায়গায় থাকে না, মাঝে মাঝে সোজা গাছের উপরে উঠে যায় আবার সরাৎ করে নিচে নেমে আসে। যে কারণে এই ভিটাকে সবাই ভুতুরে ভিটা হিসাবে জানে। সন্ধ্যার পরে ঐ ভিটায় কেউ মরে গেলেও একা যায় না।
কুকুরকে ধমক দিয়ে বাবা আমাদের বলল, চাটাই আর বালিশ নিয়া বাড়ি যা। বাকী রাত আর থাকার দরকার নাই। ওই হারামজাদা মাছ খাইতে আইছিল, আবার আইতে পারে।
নাদু মাছসহ চাঁইটি পানি থেকে উঠিয়ে আনল। চাই পানির উপরে উঠাতেই অনেক মাছ একসাথে ফরফর শব্দ করে লাফাতে লাগল। আমি বালিশ দু’টি দু’হাতের বগলতলায় নিয়ে নিলাম। বাবা চাটাই গুছিয়ে হাতে নিয়ে নিলে তিনজনই বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
ঐ ঘটনার পর আর কখনও এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি। তবে অবাস্তব ভুতের বাস্তব চেহারায় এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি দেখার পরে, ভুত বলে কিছু নেই এটা বিশ্বাস করলেও ভৌতিক দৃশ্যটি ভুলতে পারছি না। কারণ এক বুক পানিতে এক কোমর পরিমাণ উঁচু ধান গাছের উপর দিয়ে এই কুকুর কিভাবে হেঁটে আসলো আবার কিছুদুর গিয়ে কিভাবে স্বশরীরে মিলিয়ে গেল এই প্রশ্নের উত্তর আজো খুঁজে পাইনি। তবে বাস্তব ঘটনাটি আমার মনে দাগ কেটে আছে।
-ঃ সমাপ্ত ঃ-
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৮