২০০৫-২০০৮। দৈনিক আমার দেশ অফিস। সকাল ১১টায় অফিসে ঢুকেই লেখা শুরু। পরের দিনের পাতা রেডি করতে হবে। নিউজ কোথায়? তড়িগড়ি করে লেখা নিয়েই প্রূফ সেকশনে জমা দেয়া। কাছের মানুষ বলতে ছিল কামাল ভাই আর মেহেদী ভাই। 'মেহেদী ভাই, প্লিজ একটু দেখে দেন না।' মুখের কোনে চোরা হাসি নিয়ে বলতেন তিনি-'আর কতো বিনোদিত হবো বলেন?' কষ্ট করে তাতক্ষনিকভাবে নিউজটা প্রুপ কারেকশন করে দিতেন মেহেদী ভাই। মেহেদী ভাইয়ের হাত থেকে নিউজটা নিয়ে এক ছুটে মেকাপ সেকশনে। আবারও পাতা রেডি। যথারীতি মেহেদী ভাইয়ের কাছে আবদার। 'আবার একটু দেখে দিতেন যদি'। আবারও সেই চোরা হাসি। দেখতেন তিনি। খুব মনোযোগ সহকারে। বানান কোথাও ভুল হলো কি না? কাজের অবসরে চায়েরর দোকানে একটু অবসাদ দুর করতে ছুটে যাওয়া। সঙ্গে মেহেদী ভাইসহ আরও কলিগরা। চাযের বিল খুব কমই দিতে পেরেছি মেহেদী ভাইয়ের জন্য। তিনিই সবার আগে বিল মিটিয়ে দিতেন। ২০০৮ এর শেষের দিকে আমার দেশ ছেড়ে দিলাম। মাঝে সাঝে অফিসে যেতাম বটে তবে সবার সাথে দেখা হতো না। ভুলো গেলাম মেহেদী ভাইয়ের কথা।
২২ মে, ২০১১। দৈনিক যুগান্তর অফিস। আবারও পেইজ রেডি করে ক্লান্ত হয়ে এক কাপ চা খেতে ছুটে যাওয়া অফিসের বাইরে। গেইটের অদুরে যেতেই হঠাত জীর্ন শীর্ণ এক লোক পা জড়িয়ে ধরলো। 'বস, আমারে মাফ করে দেন। আমি আর কাউকে বিরক্ত করবো না।' ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে গেলাম। 'এই করছেন কি? করছেন কি? কে আপনি?' অবাক হলাম বেশ। তাকিয়ে চিনতে পারলাম না। 'বস আমারে চিনতে পারলেন না। আমি মেহেদী, আমার দেশ পত্রিকায় প্রুফ সেকশনে চাকুরী করতাম। আপনি আমারে কত চা খাইয়েছেন।' এবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। নোংরা কাপড়, এলোমেলো চুল। চেনাই যাচেছনা একদম। এই আমাদের মেহেদী ভাই! দু কাধ ধরে উঠে দাঁড় করালাম তাকে। কি হয়েছে মেহেদী ভাই? চোখের কোনে ততক্ষনে অশ্রুর সম্মিলন। বললেন, 'আগে আমারে মাফ করে দেন। আমি আর কারো কাছে যাবো না।' কিন্তু কি হয়েছে? আমাকে বলুন। আপনার এ দশা কেন?-সুধালাম তাকে। কিন্তু মেহেদী কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, 'অনেক রক্ত গিয়েছে। আমি শেষ হয়ে গেছি। আমাকে শুধু মাফ করে দেন।'
পকেট হাতড়ে কিছু টাকা বের করলাম। লুকিয়ে দিতে চাইলাম তাকে। হাতের মুঠোয় গুজে দিতেই লজ্জায় জিব কাটলেন মেহেদী ভাই। 'বস আমি কারো কাছে ভিক্ষে চাচিছ না। আমি শুধু মাফ চাইতে রাস্তায় ঘুরে বেড়াই।'
আমি চিতকার করে কাঁদতে চাইলাম। বলছে কি মেহেদী ভাই! কি এমন অসুখ বাঁধিয়েছেন তিনি যে কারও কাছে লজ্জায় বলতে পারছেন না। চাকরী হারিয়েছেন অনেক আগেই। চিকিতসার জন্য নিজের জমানো সব সম্বল খুইয়ে আজ রাস্তায় ঘুরছেন একবেলা আধবেলা খেয়ে না খেয়ে। অথচ কারো কাছ থেকে সাহায্য নিবেন না। 'আমার কোন সাহায্যের দরকার নেই, বস। আমিতো চিকিতসা বন্ধ করে দিয়েছি। টাকা দিয়ে আর কি করবো। আমি শুধু রাস্তায় ঘুরছি পরিচিতজনদের কাছে মাফ চাইতে। সময়তো আর বেশিদিন নাই। খুব শিগগিরই চলে যাব।'
কষ্টে আমি পালিয়ে আসতে চাইছিলাম। পারছিলাম না। তবুও আসতে হলো। পিছন ফিরে তাকানোর কোন শক্তিই আমার তখন ছিল না। চা আর খাইণি। অফিনস ঢুকে নিরবে কাঁদলাম কিছুক্ষন। কেন এমন হলো? মেহেদী ভাইয়ের কোন সাহায্য লাগবে না। অথচ ধুকে ধুকে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। পথে পথে ঘুরছেন পরিচিতদের কাছে মাফ চাইতে। আমাকে ক্ষমা করো মেহেদী ভাই। তোমার জন্য কিছুই করতে পারছিনা আমি।