বারাক ওবামার সাম্প্রতিক ভারত সফরে নিশ্চয় কিছু দৃশ্যমান অর্জন আছে; কিন্তু এই সফর আর এটা ঘিরে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলে আগামী দিনের শক্তি সমুহের ভারসাম্যের একটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায় এবং এই সফরের অন্তর্নিহিত কারণ আরো স্পষ্ট হয়। সফরের কারণটা বুঝতে হলে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে নরসিমা রাওয়ের সময় নেয়া ভারতের "পুবে তাকাও" নীতি বা "লুক ইস্ট" পলিসির দিকে (ইংরেজি: "Look East" Policy)। এই পলিসির মাধ্যমে ভারত দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত বৈদেশিক সম্পর্ক বিস্তারের একটি নীতি গ্রহন করে। এই নীতির অন্যতম লক্ষ্য ভারতকে একটি আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত করা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের কৌশলগত প্রভাব খর্ব করা। এই লুক ইস্ট পলিসি মোদীর কাছে পানসে ঠেকে তিনি আরো প্রো অ্যাক্টিভ পলিসি নেন, যার নাম “অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি”। এই নীতি গ্রহনের সাথে সাথেই ভারতের উদ্দেশ্যে অ্যামেরিকা থেকে বলা হয়
“We are well aware of the Look East policy, but we warmly welcome to this new shift ‘Act East’ policy” আমরা খুব ভালভাবেই "পুবে তাকাও" নীতি সম্পর্কে অবহিত ছিলাম, কিন্তু আমরা অ্যাক্ট ইস্ট নীতির এই নতুন পরিবর্তনকে উষ্ণ ভাবে স্বাগত জানাই”।
"পুবে তাকাও" নীতি থেকে অ্যাক্ট ইস্ট নীতির মধ্যে মুল পার্থক্য হচ্ছে, এখন ভারত আগের চাইতে আরো গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক ভুমিকা রাখতে চায় এবং জাপান, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া আর আসিয়ানের সাথে ভারতের বাস্তব সহযোগিতার ভিত্তিতে একটি প্রধান ট্রেডিং নেশন হিসেবে দ্রুততার সাথে নিজের উত্থান চায়।
অ্যাক্ট ইস্ট নীতি গ্রহণের সাথে সাথেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক অর্জন হয় ভারতের। রাজাপাকসে ভারতকে না জানিয়ে চীনের সাবমেরিন কলম্বো তে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছিলেন। একবার নয় ভারত সতর্ক করার পরেও আরেকবার। রাজাপাকসে পূর্ণভাবে চিনের প্রভাব বলয়ে থাকায় বিষয়টা অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে ভারতের জন্য। এছাড়াও, শ্রীলংকায় চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ ও হাম্বানটোটোতে গভীর সুমুদ্র বন্দর প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে নাখোশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। অভিযোগ আছে রাজাপাকসেকে সরাতে তার বিরোধী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে রাজাপাকসে এবং চিনকে হতবিহবল করে সিরিসেনাকে ক্ষমতায় আসার জন্য ভারত প্রত্যক্ষ সহায়তা দেয়। ব্যাপকভাবে মনে করা হয়, মিয়ানমার, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব রুখবার জন্য রাজাপাকসেকে হটাতে সরাসরি ভূমিকা রেখেছে ভারত।
এটা ছিল মোদীর অ্যাক্ট ইস্ট নীতির প্রথম কূটনৈতিক বিজয়। রাজাপাকসের উত্তরাধিকারী নতুন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিজালা সিরিসেনা বলেছেন, তার প্রথম কাজ হচ্ছে চীনের সঙ্গে শ্রীলংকার যাবতীয় চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা। এই ঘোষণায় এটা পরিস্কার কে জিতেছে, আর কে হেরেছে। শুধু তাই নয়, চীনকে ঠেলে ঠেলে আরো কোণঠাসা করতে জাপান ও ভিয়েতনামের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করেছে ভারত। ওই দুই দেশের সঙ্গেই চীনের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। চিনের সাথে বাফাত স্টেইট নেপালে প্রভাব প্রতিষ্ঠায় মোদি দু’বার সফর করেছেন এরই মধ্যে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে, বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠার আট বিলিয়ন ডলারের প্রজেক্টটি চীনা সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানিকে হটিয়ে দিয়ে ভারতের কোম্পানি আদানি গ্রুপ কাজটি প্রায় নিয়ে নিয়েছে। কথিত আছে আদানি গ্রুপ মোদীর সবচেয়ে কাছের বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান। মোদী সরকারের সাথে শেখ হাসিনার সরকারের আন্তরিক সম্পর্কের উৎস হতে পারে এই প্রোজেক্টের কন্ট্র্যাক্ট হস্তান্তর। নরেন্দ্র মোদি প্রায় এক যুগ গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং সেসময় আদানী গুজরাটের অধিকাংশ সরকারী কাজই বাগিয়ে নিয়েছে। তাদের বাৎসরিক রাজস্বের পরিমাণই এখন সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ভারতের বিগত নির্বাচনে সময় কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল গান্ধী একাধিকবার অভিযোগ করেছেন যে, মোদি আদানীকে যত টাকার কাজ পাইয়ে দিয়েছে, এখন তারা মোদির নির্বাচনীর প্রচারণায় সেই টাকা ঢালছে। সোনাদিয়া দ্বীপ ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় দ্বীপটিতে চীন সেখানে নিজেদের স্থাপনা নির্মাণ করতে চেয়েছিল।
চীন শ্রীলঙ্কায় কলম্বো আন্তর্জাতিক কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এছাড়াও দক্ষিণ শ্রীলঙ্কার হ্যামবানটোটা গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে চীন। পাকিস্তানের গাদার সমুদ্রবন্দরের দায়িত্ব নিয়েছে চীন। আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহনে চীনের এসব ধারাবাহিক কার্যক্রম ইতিমধ্যে ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ থেকে চীনকে হঠিয়ে দেয়াটা ভারতের জন্য জরুরী ছিল। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় দৈনিক গুলোতে আধা পৃষ্ঠা জুড়ে আদানী গ্রুপের তৈরি মুন্দ্রা সমুদ্র বন্দরের বিজ্ঞাপন অনেকেরই নজরে এসেছে।
পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী দানিয়েল রাসেল গত মাসে বলেন,
“আমাদের কাছে যা মনে হয়, আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় ভারত নিজের ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই।“
অ্যাক্ট ইস্ট পলিসির শুরুতে আমেরিকার যেই উচ্ছ্বাস প্রদর্শন করেছে তার পরে এই অঞ্চলে বাস্তবিকই চীনকে বেকায়দায় ফেলা দুইটি ঘটনায় অ্যামেরিকার তরফে ভারতের সক্ষমতা বাড়াতে আরো কিছু যদি যুক্ত করার থাকে সেক্ষেত্রে অ্যামেরিকার রাষ্ট্রপতির নিজে এসে সেই কাজটি করে দেবেন এটা অসঙ্গত নয়। সেই কাজটাই এসে করলেন বারাক ওবামা। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাবকে মোকাবেলা করার একক সক্ষমতা আমেরিকার নাই, সেই অতি জটিল কাজটি অনায়াসে যেই রাষ্ট্রটা করে দিচ্ছে তার পাশে থেকে সর্বতোভাবে সাহায্য করা আমেরিকার জন্য একটি অতি জরুরী কূটনৈতিক দায়িত্ব। লক্ষ করলে দেখবেন এই সফরে সেই সেই ক্ষেত্রেই চুক্তি হয়েছে, আগের মতপার্থক্য মিটেছে যা আমেরিকার সহায়তায় ভারতের সামরিক সক্ষমতা বাড়াবে, ভারত ও আমেরিকাকে দক্ষিন চীন সাগরে একটি যৌথ শক্তি হিসেবে অধিকতর প্রতিষ্ঠা দেবে।
অবশ্য এদিকে শুরু হয়েছে আরেক সমীকরণ। পাকিস্তান ঝুঁকছে রাশিয়ার দিকে। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান হাজি মুহাম্মাদ আদিল বলেছেন
“Pakistan’s historical mistake after its inception was to establish close ties with the United States but to ignore the Russians, We went to war with Russia in Afghanistan, and that brought us gifts of terrorism, extremism and drugs. Now Pakistan is trying to forge friendly ties with Russia to correct the mistakes of past.” (পাকিস্তানের জন্ম থেকে ঐতিহাসিক ভুল হচ্ছে রাশিয়াকে অবহেলা করে আমেরিকার সাথে গভীর বন্ধুত্ব, আমরা রাশিয়ার সাথে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছি, এই যুদ্ধ আমাদের উপহার দিয়েছে সন্ত্রাসবাদ, উগ্রপন্থা আর মাদক। এখন পাকিস্তান অতীতের ভুল শোধরানোর জন্য রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বাড়াতে চায়।)
ক্ষমতার এই নতুন সমীকরণে কিছুটা বেকায়দায় পড়া চীন পড়েছে অস্বস্তিতে, বিশেষ করে দক্ষিন চীন সাগরে অ্যামেরিকা আর ভারতের সাম্ভব্ব্য সামরিক উপস্থিতির সম্ভাবনায় তারা উদ্বিগ্ন। বারাক ওবামার সফর কালীন সময়ের মধ্যেই চীনা রাষ্ট্রপতি ইন্দো চায়না কৌশল গত মিত্রতাকে আরেক স্তরে নিয়ে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে পাশাপাশি সতর্কবার্তাও দিয়েছে ভারত যেন অ্যামেরিকার পাতানো ফাদে পা না দেয়। এখন ভারতের সামনে বড় চ্যালেইঞ্জ হচ্ছে চীনকে আশ্বস্ত করা। সেই কাজও শুরু হয়েছে, সুষমা স্বরাজ ছুটছেন চীনে।
ভারতের মিত্র রাশিয়া কীভাবে দেখছে এই সফরকে? রাশিয়ার জন্য এই সফর ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এবং এই অঞ্চলে রাশিয়ার স্বার্থের ক্ষেত্রে কোন ইমিডিয়েট চ্যালেইঞ্জ নয়। সেকারণেই রাশিয়া কৌতুকের সঙ্গে এই সফরকে লক্ষ করেছে। কোন প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কি আলোচিত হয়েছে এই সফরে? বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত আর অ্যামেরিকার সুস্পষ্ট ভিন্ন অবস্থান ছিল। অনুমান অসঙ্গত নয়, এই বিষয়টি নিশ্চয় আলোচিত হয়েছে। এ বিষয়ে দুই দেশের অবস্থানের কি কোন পরিবর্তন হয়েছে? তিনটে বিষয়কে মিলিয়ে নেয়া যেতে পারে। প্রথম, সোনাদিয়া সমুদ্র বন্দর থেকে চীনকে সরিয়ে দেয়া অ্যামেরিকার জন্য স্বস্তিকর। দ্বিতীয়, বারাক ওবামার সফর শুরুর দিন থেকে ৩৬ ঘণ্টা হরতাল আহবান, যেন বি এন পির পক্ষ থেকে এটা দেখানো যায় যে পাশের দেশেই একটা অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আর তৃতীয়, সফর শেষ হওয়া মাত্রই নাশকতা ‘যে কোনো উপায়ে দমন’ করতে পুলিশ বাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ। এই তিনটি বিষয় বিবেচনায় ভারত ও অ্যামেরিকার সন্মিলিত অবস্থান বর্তমান সরকারের দিকে আপাতত কিছুটা ঝুকে গেছে, এই অনুমান অসঙ্গত নয়। যদিও, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কোন স্থির বিষয় নয়, এটা একটা ডাইনামিক সম্পর্ক।
ভারতের অ্যাক্ট ইস্ট নীতি যতই অগ্রসর হবে ততই আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে ঘটবে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন। এই পরিবর্তন বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে নিশ্চিতভাবে। তবে সেই পরিবর্তনকে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে নিয়ে যাওয়ার মতো চিন্তাশীল পরিকল্পনার সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে কিনা সেটাই একটা বড় প্রশ্ন।