১।
মিরাজ খুবই বিরক্ত এবং টেনশিত।
স্যামসাং গ্যালাক্সি এস থ্রি হারানোর আশঙ্কা হলে টেনশন হওয়াই স্বাভাবিক। ওর রুমমেট রনক মাত্র ১৫ মিনিটের জন্যে মোবাইলটা ধার নিয়েছে কিন্তু ব্যাটা সেই যে গেছে আর আসার খবর নেই। কিছু হল নাকি ওর?
আর বিরক্তির কারণ, ও আজ রাতে বাড়ি যাবে। ইচ্ছা ছিল রাত দশটার বাস ধরবে। কিন্তু রাত ৯টা বাজে রনক এখনো আসেনি। আরো লেট করলেতো যাওয়াই হবে না।
পাশের রুমের একজনের ফোন দিয়ে অবশ্য অনেকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু ফোন বন্ধ।
নানান বাজে চিন্তা মাথায় আসে মিরাজের। রনক কি মোবাইলটা নিয়ে পালিয়েই গেল নাকি? না না তা কেন হবে? নিশ্চয়ই ছিনতাই বা কিছু হয়েছে। রনক খুবই ভালো একটা ছেলে। ভার্সিটির ক্লাসমেট হওয়ার সূত্রে মাত্র কয়েক মাসের পরিচয় হলেও কথা দিয়ে কথা রাখেনি এমনটা কখনো হয়নি। মাঝে মাঝে ধারটার যা নিয়েছে, একদম কাটায় কাটায় সময়মত ফেরত দিয়েছে। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে ওর। তারপরও শখের এত দামি জিনিসের জন্যে মনটা কেমন কেমন করেই। টিউশনির টাকা জমিয়ে কেনা।
রনক অবশ্য ইচ্ছা করে মিরাজের ফোন নেয়নি। বেচারা কয়েকদিন আগে বাড়ি থেকে ফেরার পথে বাসে ডাকাত পড়ে। মোবাইল মানিব্যাগতো গেছেই, সাথের ব্যাগশুদ্ধ জামা কাপড় ও নিয়ে গেছে। ঢাকায় রনক নতুন। কোন আত্মীয়ও নেই যার কাছে গিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে আসতে পারে। ওর বাবা ওদের এলাকার এক লোকের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। কিন্তু লোকটার সাথে রনকের আগে দেখা হয়নি কখনো। তাই তার সাথে যোগাযোগের জন্যে বাধ্য হয়েই মিরাজের মোবাইলটা নিয়ে গেছে। দেখা করে টাকা নিয়ে আসবে। ভাল কাপড় চোপড় সব ডাকাতি হওয়ায় মিরাজেরই একটা শার্ট পরে গেছে ও। বলে গেছে শুধু যাবে, টাকা নেবে, চলে আসবে। ব্যস। এসেই সব ফেরত দেবে। সর্বোচ্চ পনের থেকে বিশ মিনিট। সেই বিশ মিনিট এখন ৫ ঘণ্টা হয়ে গেছে।
অবশেষে ওর জানে পানি দেওয়ার জন্যে রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফিরলো রনক। কেমন বিধ্বস্ত চেহারা। মোবাইলটা ফেরত দিতে দেরি হওয়ায় খুব দুঃখ প্রকাশ করল। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতেও কিছু বলে না। শুধু বলে একটু সমস্যায় পড়েছিল তাই দেরি হয়েছে। পরে বলবে। ওকে এখুনি আবার বেরুতে হবে। সময় নেই।
যাওয়ার আগে কি মনে হতে ঘুরে বলল, ‘ মিরাজ তোর শার্টটা এখন দিতে পারব না রে। আরেকটু লাগবে। কাল পরশুর মাঝেই শার্টটা ফেরত পেয়ে যাবি আশা করি। রাগ করিস না প্লীজ।’ বলে মিরাজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের বেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মোবাইল ফিরে পাওয়ার আনন্দে মিরাজের সব বিরক্তি আর টেনশন উধাও। তবে আজ আর বাড়ি যাবে না। টেনশনের কারনে খুব ক্লান্ত লাগছে। কাল সকালের বাসেই বাড়ি যাবে ডিসিশন নিয়ে আরামে ঘুমাতে গেল।
২।
বাস থেকে যখন নামল মিরাজ, তখন সময়টা বিকেল কিন্তু চারপাশে কালিগোলা অন্ধকার। পাশের লোকের মুখটাও দেখা যায় না। ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করায় বেশির ভাগই যাত্রী ছাউনির নীচে আশ্রয় নিলো, কিন্তু বহুদিন পর বাড়ি ফেরার উত্তেজনায় ওর আর তর সইল না। একটু পড়েই ঝড় আরম্ভ হয়ে যাবে, তাই অনেকেই নিষেধ করল বেরুতে। কিন্তু মিরাজ ভয় পেল না মোটেও। বহুদিনের চেনা এই প্রিয় পথে চোখ বেধে দিলেও যেতে পারবে ও। আর তাছাড়া বাড়ি ফেরার কথা ছিল কাল। একদিন অলরেডি লেট। এতদিন পর সবাইকে দেখার জন্যেও আর দেরি করতে মন চাইছিল না। তাই আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়েই পড়ল।
ঝড়ো বাতাস সামলে বাড়ি পৌছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কিচ্ছু দেখা যায় না। অন্ধকারের মাঝে আরো জমাট বাধা অন্ধকার দেখে চেনা গেল যে এটাই বাড়ি। এমনকি কোনো সাড়া শব্দও নেই। কেউ নেই নাকি বাসায়? অদ্ভুত!
সন্ধ্যায় একটা বাতিও জ্বালেনি কেন? কারেন্ট না থাক মোম বা হারিকেন তো জ্বালাবে। উঠোন পেরিয়ে দরোজার কাছে যেতেই ফোপানির আওয়াজ পেল মিরাজ। বুকটা ছ্যাত করে উঠল ওর। কারো কিছু হল নাকি? আর থাকতে পারল না, মা বলে ডাক দিল।
ফোঁপানির আওয়াজ থেমে গেল কিন্তু কোন সাড়া নেই।
‘ও_মা, মা?’ আবার ডাকে।
‘কে?’ কেমন কাপা কাপা আওয়াজ।
‘ওমা আমি মিরাজ।’ বলতে বলতে ঘরে ঢোকে ও।
অন্ধকার চোখে সয়ে গেছে ততক্ষণে। ওর মা বিছানায় শোয়া। কাঁদছিল। পাশে ছোটো বোন। মাকে স্বান্তনা দিচ্ছিল বোধহয়। বাবা আর ছোট ভাই নেই। ওদের কি কিছু হয়েছে নাকি? কেউ কিছু জানায়নিতো।
মিরাজকে দেখেই ওর মা আর ছোট বোনের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। যেন নতুন কাউকে দেখছে। অবাক করা ব্যাপার।
‘ও মা কি হইছে? কাদছ কেন?’ বলে এগিয়ে যায় মিরাজ।
ওকে এগুতে দেখেই একটা আর্তচিতকার দিয়ে ওর ছোট বোন অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়ল। মাকে দেখে মনে হচ্ছে পাথর হয়ে গেছে।
হঠাত পিছনে পায়ের আওয়াজ। ঘুরে দ্যাখে বাবা আর ছোট ভাই। দুজনেরই পরনে পাঞ্জাবি আর টুপি। ওকে দেখেই ব্রেক কষে থেমে গেল। যেন শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খেয়েছে। ওর ছোট ভাইয়ের মুখ হা হয়ে গেছে। চিৎকার বেরুতে গিয়েও বেরুচ্ছে না। বাবার হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। আবার অন্ধকারে ডুবে গেল চারদিক।
‘বাবা কি হইছে। এমন করতেছেন কেনো?’ বলে অন্ধকারেই এবার বাবার দিকে এগোয় ও।
হঠাত ছুটোছুটি, তারপরেই দড়াম করে আছড়ে পড়ার শব্দ পাওয়া যায়। মিরাজের ছোটভাই দৌড়াতে গিয়ে দরজায় বেধে পড়ে গেল বোধহয়।
কি হচ্ছে এসব! সবাই এমন করছে কেন? ওকে কি কেউ চিনতে পারছে না নাকি?
আরেকটু এগুতেই মিরাজের পা পড়ল টর্চের উপর। ধপাস করেএবার নিজেই উল্টে পড়ল ও। জ্ঞান হারাল পরমূহুর্তেই।
৩।
মোমের আলোয় মিরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন ওর বাবা আবুল হাশেম সাহেব। অজ্ঞান হয়ে মেঝেতেই পড়ে আছে ও। বেশি কাছে অবশ্য যাননি। মিরাজের মা আর ছোট ভাই বোন জড়াজড়ি করে বিছানায় বসে আছে। আতঙ্কে মুখ ফ্যাকাশে।
আরে এটা মিরাজই তো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে হাশেম সাহেবের।
বিশ্বাস হবেই বা কি করে, মিরাজকে তিনি নিজ হাতে কবর দিয়েছেন আজ বিকেলে।
গতকাল সন্ধ্যায় ফোনটা আসে। রমনা থানার এক এস আই মিরাজের ফোন থেকেই ফোন দিয়ে জানান এই ফোনের মালিক অ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেছে। মুহুর্তেই আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মাথায়।
তখনি ছুটলেন ঢাকায়। ইচ্ছা ছিল লাশ নিয়ে তখনি ফিরবেন কিন্তু পোস্ট মর্টেম সহ নানান ঝামেলা শেষ করে লাশের এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পৌছতে আজ দুপুর লেগে যায়। তখনি ঝড়ের আভাস দেখা দেওয়ায় আসরের পর পরই কবর হয়েছে মিরাজের। বাসের চাপায় ছেলেটার মাথা একদম থেতলে গেছিল। চেনার কোন উপায় নেই। গোসলে করানোর লোক ছাড়া লাশ কাউকে দেখতে দেননি তাই। ওর মা দেখলে সহ্য করতে পারত না। এতক্ষন বাসায় লোক ছিল অনেক, হঠাত পুরোদমে ঝড় শুরু হয়ে যাওয়ায় সবাই নিজের বাসা সামলাতে গেছে। তাই বাসা ফাকা।
মাত্রই ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে যার কবর যিয়ারত করে আসলেন, ঘরে ফিরতেই এরকম ঝোড়ো পরিবেশে তাকে দেখা গেলে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। এ জন্যেই সবাই এমন অদ্ভুত আচরণ করছে।
হঠাত নড়ে উঠল মিরাজ। কিছুটা ভয়ে পিছিয়ে যান হাশেম সাহেব।
‘বাবা, এমন করছেন কেন? কি হয়েছে?’ উঠে বসেই প্রায় দৌড়ে গিয়ে হাশেম সাহেবকে জড়িয়ে ধরে মিরাজ। খুব কান্না পাচ্ছে ওর।
দুঃখে, ভয়ে, আতঙ্কে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না হাশেম সাহেব। এবার উনি নিজেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বিছানায় মিরাজের মা, ভাই, বোন একসাথে কেদে উঠল। হতভম্ব মিরাজ বাবাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। কি করবে বুঝতে পারে না।
এই দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতেই যেন কারেন্ট চলে আসে। বাবাকে বিছানায় শুইয়ে মিরাজ এবার মাকে জড়িয়ে ধরে।
‘মা, আমি মিরাজ। এমন করছ কেন? ও মা।’
ছেলের স্পর্শে সম্বিত ফেরে মিরাজের মার। এতক্ষনে টের পান আসলেই এটা তার ছেলে। কোনো অশরীরী প্রেতাত্মা না। এতক্ষণ ছেলে হারানোর কষ্টে কেদেছেন এখন নতুন করে তাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে কেদে উঠলেন।
৪।
সব শুনে মিরাজ বুঝল, আসলে ও মারা যায়নি। অন্য কারো সাথে ওকে গুলিয়ে ফেলেছে সবাই। এমনকি ও মনে করে কবরও দিয়ে ফেলেছে। খটকা লাগছে এটা ভেবে যে, ওর নাম্বার থেকে ফোন আসলো কিভাবে? ওর ফোনতো ওর সাথেই। সম্ভবত ক্রস কানেকশন হয়েছে। বাবাও তড়াহুড়ায় ঐ এস আইয়ের কাছ থেকে ফোনটা আনতে ভুলে গেছেন। নাহলে ফোনের আসল মালিকের আত্মীয়দের খবর দেওয়া যেত। ঢাকায় ফিরেই থানায় খোজ করতে হবে। কি একটা মনে হতে বাবাকে জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা বাবা, লাশটার চেহারা নাকি থেতলানো ছিল। তো এটা আমার লাশ বুঝলেন কিভাবে?’
‘আরে তোর মতই একটা শার্ট ছিল গায়ে।’
‘কই দেখি?’
‘এইতো।‘ বলে শার্টটা বের করে দেন ওর মা।
দেখেই নিশ্বাস নিতে যেন ভুলে যায় মিরাজ।
এই শার্ট পরেই কাল রনক বাইরে বেরিয়েছিল।
তবে কি রনকই মারা গেছে? মিরাজের মোবাইল রনকের কাছে থাকায়, মিরাজের পরিবারকেই জানানো হয়েছে। তাতেই এত গণ্ডগোল?
ওদের দেহের গড়ন এক টাইপেরই। চেহারা না দেখা গেলে আলাদা করা যাবে না। আর শোকের সময়ে কেউ বেশি খেয়াল করেনি নিশ্চয়ই। তাই এত বিপত্তি।
কিন্তু তাহলেতো রনক মারা গেছে কাল বিকেলেই। সেক্ষেত্রে কাল রাতে মোবাইল ফেরত দিল কে? ওটাতো রনকই ছিল। শীতল একটা ধারা নেমে যায় মিরাজের মেরুদণ্ড বেয়ে। তাহলে কি রনক ...?
কাল রাতের ঘটনা মনে করার চেষ্টা করে মিরাজ। ‘কাল পরশুর মাঝেই শার্টটা ফেরত পেয়ে যাবি আশা করি।’ কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারে ও এখন। ওর বাবা ভুল করে মোবাইলটা ফেলে এসেছিলেন বলেই অশরীরী রনক ফোনটা উদ্ধার করে ফেরত দিয়ে যায় ওকে। আর শার্টটাতো বাড়িতে ফিরলেই ফেরত পাবে, তাই ওটা দেয়নি। মরেও বেচারা নিজের দেওয়া কথা রেখে গেল। ভাবতেই মিরাজের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়।
পরিশিষ্ট
রমনা থানার এস আই কামরুল হাসান বেশ খুশি। কাল একটা লাশের পকেট থেকে একটা গ্যালাক্সি এস থ্রি উদ্ধার করছেন। গার্জিয়ানরা লাশ নিয়ে গেলেও ওটা নেয়নি। হয়তো খেয়ালই নেই। উনিও তাই আর মনে করিয়ে দেননি। রাতে নিজের ডেস্কের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলেন। লাশের ঝামেলা শেষ, এখন ব্যবহার করা যায়।
কিন্তু ড্রয়ার খুলতেই ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেলেন উনি। কিচ্ছু নেই ভিতরে। পুরো ডেস্ক তন্ন তন্ন করে খুজেও ফোনটা আর পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১৪ রাত ১:৩৮