পাশের বাসার ছেলেটার জন্মদিন আজ। র্যাপিং পেপার কিনতে মনে নেই জহিরের। তাই সেরকম কিছু আছে কিনা খুজতেই স্টোর রুমে আসা। খোজাখুজি করে র্যাপিং পেপার পেল না, কিন্তু ধুলো জমা বেশ পুরোনো একটা ডাইরি পাওয়া গেলো। ঝেড়েঝুড়ে কিছু লেখা আছ কিনা দেখার জন্যে পাতা উলটাতেই খসে পড়ল কি যেন। তুলে দ্যাখে একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফীর প্লেট। তাতে দুটো ছবি।
বুকটা ছ্যাত করে উঠল জহিরের। ও আল্ট্রাসনোগ্রাফীর কিছুই বোঝে না। কিন্তু এই ছবি দুটো ওর খুব চেনা। মনে পড়ল প্রথম যখন ছবি দুটো দেখেছিল, তখনও একই অনুভূতি হয়েছিল ওর। সেই অনুভূতির সিড়ি বেয়েই ও যেন হাজির হল সাত বছর আগের এক বিকেলে......
চিন্তিত মুখে আল্টাসনোগ্রাফী রুমের বাইরে বসা জহির। মুনা ভিতরে। একটু পরে মুনা এসে ডাক দিল, ‘ভিতরে আসো। ডাক্তার ডাকে।’
চশমা পরা এক ভদ্রমহিলা বসে বসে রিপোর্ট লিখছেন। জহির কিছু একটা বলার চেষ্টা করতেই থামিয়ে দেন ওকে।
বেশ কিছুক্ষণ লিখে চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে ঘোষণা করলেন, ‘সেভেন উইক থ্রি ডেজ প্রেগন্যানসি। বাচ্চা সুস্থ আছে। অ্যাপ্রোক্সিমেট ডেলিভারি ডেট সেভেন নভেম্বর।’
বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ল যেন জহিরের। আমতা আমতা করে জানতে চায়, ‘আপনি সিওর পেটে বাচ্চা? আর কিছু না?’
‘আর কিছু মানে?’
‘টিউমার বা আর কিছু?’
‘আর কিছু হবে কেন, বাচ্চাই। বাচ্চার হার্ট চলে আসছে। এই দ্যাখেন।’ দুর্বোধ্য একটা ছবির মাঝে একটা বিন্দু নির্দেশ করেন উনি।
জহির কিছুই বোঝে না। এসি রুমের ভিতরেও কপালে ঘাম দ্যাখা দেয় ওর।
‘কি করব এখন?’ ডাক্তারের রুম থেকে বেরিয়েই উদ্বিগ্ন মুনার প্রশ্ন।
‘জানিনা। বাসায় চল এখন।’
মুনাকে রিকশায় তুলে দেয় জহির। রিকশা ছাড়ার আগে হাত ধরে বলে,
‘চিন্তা করো না। আমি সব দেখছি। ম্যানেজ হয়ে যাবে।’
কিছু বলে না মুনা। শুকনো মুখটা নাড়ে একটু। গত সাত সপ্তাহ ধরেই প্রায় কিছু খেতে পারে না ও। শারীরিক সমস্যা সাথে ভয়ানক মানসিক টেনশন। সামনে আবার ভার্সিটিতে পরীক্ষা। সব মিলিয়ে কিভাবে টিকে আছে ও-ই জানে।
রিকশা ছেড়ে দিলে নিজের বাড়ির পথ ধরে জহির। মুনাকে বিয়ে করেছে মাস ছয়েক আগে, কিন্তু ওদের বাড়ির কেউ জানে না। জানলে মেনে ও নেবে না। দুজনের ফ্যামিলির যে অবস্থা তাতে নিশ্চিত বাড়ি থেকে বের করে দেবে। এখন যদি মুনার প্রেগন্যানসির খবর জানাজানি হয় তাহলেই সর্বনাশ। এ কারণেই এত বড় খুশির খবরটা ওদের জন্যে এত বড় বিভীষিকা হয়ে গেছে।
জহির এবার অনার্স ফাইনাল ইয়ারে উঠবে। মুনার সাথে সম্পর্ক তিন বছরের। ওর ইচ্ছা ছিল মাস্টার্স শেষ করে চাকরি ধরে সবাইকে জানাবে। এতে করে যদি ওদেরকে মেনে না ও নেয় তাতেও সমস্যা হবে না। ওরা আলাদা হয়ে যাবে। মুনাও রাজি ছিল এতে। কিন্তু হঠাত অসতর্কতায় কি থেকে কি হয়ে গেলো। এখন ও আলাদা হয়ে যাওয়া যায় কিন্তু খুব কষ্ট হবে ওদের। জহিরের বাবাই সব খরচ দিচ্ছে এখনও। আলাদা হলে নিজেই সব ইনকাম করতে হবে। বাসা ভাড়া, খাওয়া, মুনার খরচ আর এখনতো আবার বাচ্চার খরচ। আগে হলে মুনাও ইনকাম করে হেল্প করতে পারতো কিন্তু এখন এই শরীর নিয়ে তো আর পারবে না। কি করবে জহির? ভেবে পায় না।
অস্থিরতায় কাটে সারা বিকেল। বাসায় ফেরে না ও। রাস্তায় হেটে হেটেই কাটায়। রাতেও বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়। মায়ের জিজ্ঞাসার জবাব না দিয়েই না খেয়ে শুয়ে পড়ে। এত বড় পরীক্ষায় পড়তে হবে ভাবেনি কখনো।
ইদানিং মুনার আচরণে খুব বিরক্ত হচ্ছে ও। এ ব্যপারে কিছু জিজ্ঞেস করলেই বলে, ‘আমি আর কি বলব, তুমি যা বলবে তা-ই হবে।’
আর এদিকে জহিরের দিন কাটে রাস্তায় রাস্তায়। নিজেদের কথা ভাবলে মনে হয় অ্যাবরশন করে ফেলতে। আবার নিজের বাচ্চাকে মেরে ফেলবে? মাথাটা গুলায় ওঠে ওর।
ক্লিনিকে ফোন দিয়েছিল। সব শুনে ডাক্তার বলেছে অ্যাবরশন করাতে চাইলে আর এক সপ্তাহের ভিতর করাতে। শুনে টেনশন আরো বেড়েছে। কারো সাথে শেয়ারও করতে পারছে না। এদিকে মুনার পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্যে যাওয়া আরকি। সারা দিন না খেয়ে, বমি বমি ভাব নিয়ে একটা মেয়ে কতটা আর পারবে। ওর মা যে এখনো ধরতে পারেনি এটাই ভাগ্য।
জহিরের পরিচিত কয়েকজন আছে যারা বিয়ে করে ফ্যামিলী থেকে আলাদা থাকে। তাদের সুখ আছে কিন্তু কষ্ট ভীষণ। স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে ইনকাম করা, সাবলেট থাকা। সাথে পড়াশোনা, বাচ্চা পালা। জহির ভাবতেও পারে না। পারা যেত যদি ওদের ফ্যামিলী সাপোর্ট দিত। কিন্তু সেটা ওরা কখনোই পাবে না।
বাচ্চাটাকে দুনিয়াতে আনা মানে শুধু নিজের না, বাচ্চাটাকেও চরম দুর্গতিতে ফেলা। তাছাড়া মুনার যে অবস্থা, খায় না, টেনশন- বাচ্চাটা সুস্থ অবস্থায় জন্মাবে কিনা সন্দেহ। হয়ত মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে জন্মাবে। তখন অবস্থা আরো খারাপ হবে।
নাহ, অ্যাবরশনই করাবে ও। তারপর সঠিক সময়ে বাচ্চা নেবে ওরা। মুনাকে যা বলবে তা-ই শুনবে। মুনার পরীক্ষা শেষ হলেই যাবে। অবশ্য টাকা লাগবে। বাবাকে মিথ্যা বলে জোগাড় করতে হবে।
ডিসিশনটা শুনে কিছুই বলল না মুনা। খুবই চুপচাপ হয়ে গেছে ও। শুধু নীরবে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল ওর। জহির বুঝাতে যায় কেন ও এই ডিসিশনটা নিতে বাধ্য হয়েছে। তার আগেই কান্না সামলাতে সামলাতে ছুটে যায় মুনা।
রাতে মুনা মেসেজ দেয়, ‘তুমি যা বলেছ তা-ই হবে কিন্তু একটা শর্ত আছে আমার।’
‘কি শর্ত?’
‘কাজ শেষ হওয়ার পর ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আর কখনোই তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে না। আমার সামনেও আসবে না।’
‘কি বলছ তুমি এসব? কেন?’
‘এত কথা বলতে পারব না। শর্তে রাজি থাকলে কাল সকালে ফোন দিয়ো। না হলে না।’ মেসেজটা দিয়ে ফোন অফ করে দেয় মুনা।
সারারাত ছটফট করে জহির। আবার ভাবে গোড়া থেকে। এই ডিসিশনটাই ঠিক বলে বারবার মনে হয়। তারপরও কোথায় যেন খচখচানি থেকেই যায়। নাহ বাচ্চাটাকে দুনিয়াতে আনলে দুর্ভোগই বাড়বে শুধু। বাচ্চাটাও মানুষ হবে না। ওরাও ভালো থাকবে না। শেষমেশ মনস্থির হয় ওর।
সারা রাত নির্ঘুম থেকে পরদিন চোখ লাল করে মুনাদের বাড়ির সামনে হাজির হয় জহির। মুনার অবস্থা দেখে বোঝে যে ও-ও ঘুমায়নি।
সারা রাস্তা একটা কথাও হয়না ওদের। এমনকি অপারেশনের পরেও। শুধু মুনা রিকশায় ওঠার পর জহির যখন ওর হাত ধরতে যায় তখন ও শীতল গলায় বলে,
‘হাত ছাড়ো জহির। রাস্তায় সীন ক্রিয়েট কোরো না।’
‘পাগলামি করে না মুনা। আমি কি তোমার কেউ না?’
‘ছিলে, এখন আর নাই। আর কখনো আমার সামনে আসবে না।’
‘মুনা প্লীজ। বুঝতে চেষ্টা করো।’
‘বোঝাবুঝি শেষ। এগুলো রাখো।’ বলে অপারেশনের সব কাগজ পত্র ধরিয়ে দেয় জহিরকে।
‘মুনা...’ আরেকবার চেষ্টা করে জহির।
‘এই রিকশা, চলেন।’
স্তব্ধ জহিরকে ফেলেই মুনা চলে যায়। ও যে আসলেই এমন করবে, জহির তা ভাবতেও পারেনি।
পরের কয়েকটা দিন যে কিভাবে গেল! আশে পাশে কোন বাচ্চা দেখলেই কান্না পেত জহিরের। এদিকে মুনাও ফোন ধরে না। ইদানীং নিজেকে শুধুই একটা খুনি মনে হয় ওর। নিজের লাইফের সামান্য সুখের জন্য নিজের বাচ্চাকে নিজ হাতে খুন করেছে। বিয়ের পর কয়টা বাচ্চা হবে ওদের, নাম কি রাখবে, বাচ্চারা বাবার নাকি মার, কার ন্যাওটা হবে, এসব নিয়ে কতই না তর্ক করেছে ওরা। আর আজ যখন সত্যিই সেই সুযোগ আসল, নির্মম ভাবে তাকে খুন করে রেখে আসলো। থুহ! নিজের অপর খুব ঘেন্না হত ওর।
আল্টাসনোগ্রাফীর প্লেটটা ছিল ওদের বাচ্চাটার একমাত্র স্মৃতি। প্রায়ই জহির দুর্বোধ্য ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকত। অসংখ্য আকিবুকির ভিতরেও ওর বাবুর ছোট্ট হার্টটা ঠিকই চেনা যেত। যার ধুকপুকানি শুরু হওয়ার বহু আগেই থামিয়ে দিয়েছে ও। ছবিটা বুকে চেপে তখন দম বন্ধ করে কান্নার দমক আটকাতো ও।
তারপর......
তারপর কেটে গেছে সাত বছর। রাগ ভেঙ্গে মুনা ঠিকই ফিরে এসেছিল জহিরের জীবনে। বিয়ে তো করাই ছিল। চাকরি পেয়ে বাসায়ও সেটা জানানো হয়। পরিবারের প্রবল আপত্তির মুখে ওরা বেরিয়ে আসে ফ্যামিলি ছেড়ে। তারপর মুনার ভালোবাসা আর জহিরের পরিশ্রমে একটু একটু করে সাজিয়েছে ওদের সংসার। অনিশ্চয়তা না থাকায়, ঠিক ভাবেই চলছে সব। ওদের পরিবারও মেনে নিয়েছে শেষ পর্যন্ত। যদিও আর ফিরে যাওয়া হয়নি।
আর সেই আল্ট্রাসনোগ্রাফীর প্লেটটার জায়গা হয় একটা ডাইরির পাতার ফাকে। তারপর হারিয়ে যায় বিস্মৃতির গহ্বরে।
জীবন সংগ্রাম জীবিত মানুষকেই ভুলিয়ে দেয়। আর যার জন্মের আগেই লিস্ট থেকে নাম কাটা গিয়েছিল তাকে আর কে মনে রাখবে? জহিরের স্মৃতির উপরেও তাই তালা পড়েছে বহুদিন আগেই। আজ হটাত খুজে পাওয়া আল্ট্রাসনোগ্রাফীটা সেই বদ্ধ দুয়ার খুলে দিল নিমিষেই। ছবির বিন্দুরূপী ছোট্ট হার্টটা আচমকা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল। একটা বাচ্চা যেন কোত্থেকে ডাক দিল, ‘বাবা, ও বাবা। কোলে নাও।’
চমকে তাকায় জহির। না, কেউ নেই। পাশের বাসার ছেলেটার কথা মনে পড়ল। ওর বাবুটা বেচে থাকলে এই বয়সিই হতো। প্রতি বছর সাতই নভেম্বর ওর জন্মদিন পালন করতে পারতো।
ভাবতেই বুকটা কেমন ফাকা লাগে ওর। করত নাহয় একটু কষ্ট তখন। সারা দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হত হয়ত। কিন্তু বাবুর মুখের দিকে তাকালেইতো ভুলে যেত সব।
নিজের সুখের জন্যে ওকে খুন করলো! সুখতো পেয়েছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বাবু? ওকেতো চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে। ওর বাবু ওর কাছে কখনোই ফিরবে না। ভ্রান্তির জালে আটকে ও ওর আসল সুখ চিনতেই ভুল করেছে। নিজের হাতে নষ্ট করেছে ওর জীবনের সবচে বড় ঐশ্বর্য্য। মুনা মা হবে সামনেই। কিন্তু যাকে মেরে ফেলেছে? সে তো আর ফিরবে না। সুখের সমীকরণ মেলাতে গিয়ে ধ্রুবকটাকেই বাদ দিয়ে দিয়েছে।
আর পারেনা জহির। বুক ভেঙ্গে কান্না আসে ওর । ছবিটা বুকে জড়িয়ে পাগলের মত কেদে ওঠে ও, ‘বাবুরে...ও বাবু। বাবু আমার।’
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৪ রাত ১২:৩৮