১.
মানুষের চোখের চেয়ে রহস্যময় আর কিছু কি আছে?
ডা. আশরাফের কাছে এর জবাব হল, না নেই। সেই তরুণ বয়সে একজনের বাকা চোখের বাঁকে হারিয়েছিলেন। আজও পথ খুজে পাননি।
চোখের প্রতি আগ্রহ অবশ্য আরো আগে থেকেই ছিল। এম.বি.বি.এস. পড়ার পুরোটা সময় চিন্তা করেছেন অপথ্যালমোলজিস্ট (চোখের ডাক্তার) হবেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে হয়ে গেছেন ইউরোলজিস্ট (কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ)। তবে ডা আশরাফ নিজের ভাগ্য নিজে গড়তে জানেন। নিজের মেধার জোরে আজ তিনি বেশ নামকরা একজন ডাক্তার। কিন্তু চোখের প্রতি পুরনো ফ্যাসিনেশনটা এখনো রয়ে গেছে। রোগী আসলে তাদের চোখের ভাষা পড়া তার হবি বিশেষ। রোগীদের চোখের ভাষা পড়া সহজ। বেশির ভাগের চোখেই লেখা থাকে, ডাক্তার সাহেব আমাকে বাঁচান। আপনিই আমার সব। ডাঃ আশরাফ সেই আকুতি পড়ে মজা পান।
এই মুহুর্তে তার সামনে দুজন বসে আছে। একজনের চোখে বিশাল একটা সানগ্লাস। ডাঃ আশরাফ তার চোখ দেখতে পারছেন না। সম্ভবত এ-ই রোগী। লোকটার মুখ ফোলা। শরীরও যে পানি জমে ফুলে গেছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। নেফ্রোটিক সিনড্রোম এর রোগী। ফোলা দেখে মনে হয় বেশ অ্যাডভানস স্টেজ। লোকটা এই মুহুর্তেও বেশ কষ্টে আছে। কেমন দাঁতে দাঁত চেপে আছে বলে মনে হচ্ছে। এই অবস্থায় লোকটার জন্যে খুব বেশিকিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
বেচারা লোকটার চোখ দেখতে ডাঃ আশরাফের খুব ইচ্ছা হল। দেখবেন আস্তে আস্তে। প্রেসক্রিপশন প্যাডটা টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
- কি নাম আপনার?
- সাদেকুর রহমান।
- বয়স?
- ৩০
ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে সাদেকুর রহমানের দিকে তাকালেন। নাহ লোকটার অবস্থা আসলেই খুব খারাপ। কারন চেহারা দেখে মনে হয় বয়স বুঝি ৪৫।
- আপনার চশমাটা খোলেন প্লীজ।
- কেন?
- আপনার চোখ দেখতে হবে।
- চোখ দেখে কি করবেন?
- সেটা আমি বুঝব। ডাক্তার আমি না আপনি?
- ডাক্তার আপনি, কিন্তু আমিতো আপনাকে দেখাতে আসিনি।
- তো কেন এসেছেন? ডাক্তারের কণ্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি।
- এই বিজ্ঞাপনটা দেখে এসেছি। সাদেকুর রহমান নিজের হাতের পত্রিকাটা ঠেলে দেয়।
কর্ণিয়া চেয়ে বিজ্ঞাপন।
যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি মরার পর তার কর্ণিয়া দান করতে রাজি হন তবে উপযুক্ত সম্মান এবং সম্মানীর সাথে তা গ্রহণ করা হবে।
বিজ্ঞাপণটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডাঃ আশরাফ। কর্ণিয়া দরকার তার স্ত্রীর জন্য। ছাত্রাবস্থায় এই চোখের জালেই আটকা পড়েছিলেন। এখনো আটকে আছেন তবে সে চোখে আর প্রাণ নেই। এক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে চোখের দিকে তাকিয়ে পার করে দিতেন, সে চোখের বোবা কান্না তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায় নিয়মিত।
- হুম, বিজ্ঞাপণটা আমার ই দেওয়া। আপনারা কি কর্ণিয়ার খবর এনেছেন?
- হুম
- কে দেবে কর্ণিয়া?
- আমি।
- আপনি? জীবিত মানুষের কাছ থেকেতো কর্ণিয়া নেওয়া সম্ভব না।
কথাটা শুনে কেমন একটা বাকা হাসি খেলে গেলো সাদেকুর রহমানের ঠোটে।
- তো কি কি নেওয়া সম্ভব ডাক্তার সাহেব?
- মানে ?
- মানে কিছু না। যাই হোক। জীবিত অবস্থায় আমি চোখ দেব না। আমাকে দেখেই তো বুঝতে পারছেন কি অবস্থা আমার। আর আয়ু বড়জোর এক থেকে দু’সপ্তাহ। তারপরেই চাইলে আপনি আমার চোখ নিতে পারেন।
- চোখ না কর্ণিয়া।
- যা ই হোক। যেটা চান সেটাই পাবেন। চাইলে আর কিছুও নিতে পারেন। মরার পর কিছুই আর লাগবে না আমার।
কথাটায় কেমন আড়ষ্ট হয়ে গেলেন ডাক্তার সাহেব।
নীরবতা নামল ঘরে। বেশ কয়েকদিনই হয় বিজ্ঞাপণটা দিয়েছিলেন তিনি। কোনো সাড়া নেই। দেশে কর্ণিয়া ডোনারের এত অভাব সেটা কে জানতো। কেউ আসবে না ভেবে যখন হতাশ হয়ে গিয়েছিলেন তখনই এরা এসেছে। আরেকটা পার্টি কবে আসবে কে জানে? কিন্তু এরকম অসুস্থ একজন লোকের কাছ থেকে কর্ণিয়া নিতে অস্বস্তি লাগছে তার। যদিও এ রকম কুসংস্কারের কোনো ভিত্তি নেই। তারপরও কোথায় যেন বাঁধছে! দোনোমনা করতে করতেই বললেন
- হুম, কিন্তু আপনি চাইলেই তো আমরা নিতে পারবো না। আপনাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে।
- করেন। তবে একটু তাড়াতাড়ি করলেই ভালো হবে। কখন কি হয়ে যাবে কে জানে?
- আচ্ছা।
খসখস করে টেস্টের নামগুলো লেখেন ডাক্তার সাহেব।
- এগুলো করিয়ে এনে আমার সাথে দেখা করুন। তারপর দেখি কি করা যায়।
কাপা হাতে কাগজটা নিল সাদেকুর রহমান। খেয়াল করতেই ডাক্তার সাহেবের অস্বস্তিটা ফিরে এল।
- আর এই ল্যাব থেকেই টেস্টগুলো করাবেন। ওদের বলা আছে। আপনার কাছ থেকে কোন টাকা নেবে না।
প্যাডের উপরের ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামের দিকে ইঙ্গিত করলেন উনি।
- আচ্ছা, আসি তাহলে।
- ও, ভাল কথা। টাকা পয়সা?
- যদি আমার চোখ নেন তাহলেই নাহয় সেটা নিয়ে কথা হবে।
- তারপর ও আপনার দাবি সম্পর্কে একটা আইডিয়া দিলে ভালো হত।
শব্দ করে হেসে দিল সাদেকুর রহমান। অসুস্থ মানুষের হাসি। বড় ভয়ংকর।
- আমার দাবি আপনি মিটাতে পারবেন না ডাক্তার সাহেব। দুনিয়ার কেউ ই পারবে না।
- কি বলেন, তাহলে কর্ণিয়া নেব কিভাবে?
- সেজন্যই বলছি, আমার দাবি মিটাতে হবে না। আপনি আমার চোখটা নেবেন। তাতেই আমি খুশি হব।
- বুঝলাম না।
- বুঝতে হবে না। এ আমার বোনের জামাই। যদি খুশি হয়ে কিছু টাকা পয়সা দিতে চান, তবে একে দিয়ে দিলেই হবে। আমার কিছু চাওয়ার নেই।
তারপর আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ডাক্তার কে নতুন অস্বস্তিতে ফেলে দুলাভাইয়ের কাধে ভর দিয়ে বেরিয়ে গেলো সাদেকুর রহমান।
২
মাসখানেক পরের কথা।
ডাঃ আশরাফ খুব খুশি। স্ত্রীর চোখের অপারেশন হয়ে গেছে। সব ঠিক থাকলে আজই চোখের বাধন খোলা হতে পারে। মাত্র চেম্বার থেকে ফিরেছেন। ফ্রেশ হয়ে হাসপাতালে যাবেন স্ত্রীকে দেখতে।
সাদেকুর রহমানই কর্ণিয়া দিয়েছে। দেখা করার ১৫ দিনের মাথায় লোকটা মারা যায়। সব কিছু রেডিই ছিলো। মারা যাওয়ার পরই লোকটার দুলাভাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। ঐদিনই কর্নিয়া আলাদা করে রাখা হয়। দুদিন পর হয় ডাক্তার সাহেবের স্ত্রীর অপারেশন।
খুশি হয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছেন সাদেকুর রহমানের দুলাভাইকে। কিছুক্ষণ আগে এসে নিয়ে গেছে। আর দিয়ে গেছে একটা খাম। মারা যাওয়ার আগে সাদেকুর রহমান নাকি দিয়ে গেছে। ভেবেছিলেন ধন্যবাদ দিয়ে চিরকুট হয়তো, কিন্তু এটা কয়েক পাতার একটা চিঠি।
রহস্যময় লোকটার রহস্যময় কর্মকাণ্ড ডাক্তার সাহেবকে খুবই মজা দিয়েছে। চিঠিটা পড়ার জন্যে তাই তর সইছিল না। রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়েই চিঠিটা নিয়ে বসলেন। বাড়িতে কেউ নেই। তাঁর ছেলে বাসায় নেই। মেয়ে আর কাজের বুয়া দুজনেই হাসপাতালে।
কাপা হাতের লেখা। বোঝাই যায় কষ্ট হয়েছে লিখতে।
বেচারা! মনে মনে ভাবেন তিনি। কি এমন কথা যে এত কষ্ট করে লেখা লেগেছে? মুখে বললেই পারত।
‘ডাক্তার সাহেব,
পত্রের শুরুতে সালাম দেওয়ার নিয়ম। কিন্তু আপনাকে আমি সালাম দেব না। কারণ আমি চাই না আপনার জীবনে শান্তি আসুক। অবাক হচ্ছেন? চেনা নেই জানা নেই একজন হঠাত কেন আপনার অশান্তি কামনা করছে? একটু ধৈর্য ধরে পড়ুন, বুঝতে পারবেন।
এই অধম আপনার একজন পুরাতন রোগী। আমাকে চিনতে পারেননি। পারার কথা ও না। চেনার মত অবস্থায় আমি নেই। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই চিনি না। আর আপনি এত আগে দেখে কিভাবে মনে রাখবেন?
বছর দশেক আগে খুব সাধারণ একটা কিডনীর সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। বড়জোর দুটো কি তিনটে ওষুধেই ঠিক হয়ে যেতাম কিন্তু আপনার চেম্বারে এসেই পড়লাম কয়েক হাজার টাকার টেস্টের খপ্পরে। তারপরেই ভর্তি হতে হল আপনার ক্লিনিকে। অথচ তার কোনো দরকার ছিল না। চলতে লাগলো ক্রমাগত নানা টেস্ট আর অপারেশনের নামে ক্লিনিকে আটকে রাখা। এর মধ্যে একটা অপারেশন ও করা হল আমার।
আমার দরিদ্র বাবা সরল বিশ্বাসে ফসল বিক্রি করে তার সারা বছরের জন্য জমানো টাকা, এমনকি খানিকটা জমি ও বিক্রি করতে বাধ্য হলেন আপনার বিল মিটাতে গিয়ে।
বাড়ি ফিরে কিছুদিন ভালোই ছিলাম। কিন্তু আবার শুরু হল অসুখ। আগের চেয়ে আরো বড় আকারে। আবার আসলাম আপনার কাছে। কিন্তু আপনি কেমন চেনেন-ই না এমন একটা ভাব। এই সেই বলে আবারো একগাদা টেস্ট আর ওষুধ আর আপনার ক্লিনিকে ভর্তির ফরম ধরিয়ে দিয়ে বিদায় করে দেন। আবারো আপনার ফাদে পা দিলাম। অপারেশনের বাহানায় গেলো আমার বাবার আরো খানিকটা জমি। কিন্তু লাভ হল না। অবস্থার অবনতি হতেই লাগলো।
অবস্থা দেখে আরেক ডাক্তারের কাছে গেলাম। গিয়ে শুনলাম আমার দুনিয়া এলোমেলো করে দেওয়া সেই খবর। আমার কিডনী একটি। না এটা আমার জন্মগত সমস্যা ছিল না। আপনার কাছে আসার আগ পর্যন্ত কিডনী দুটোই ছিল। কিন্তু অপারেশনের ছুতোয় আপনি আমার একটি কিডনী কেটে রেখে বেচে দিয়েছেন। বাকি কিডনীটার অবস্থা এখন খারাপের পথে।
ছুটলাম আপনার কাছে। কিন্তু সদুত্তরতো দূরে থাক দারোয়ান ডেকে বের করে দিলেন আমাকে আর আমার বাবাকে। বললেন আমরাই নাকি কিডনী বেচেছি আপনার কাছে। পরে জেনেছিলাম অপারেশনের বণ্ড সই নেওয়ার সময় আমার স্বল্প শিক্ষিত বাবার কাছ থেকে মিথ্যা বলে আরো একটি কাগজে সই নিয়েছিলেন আপনি। সেটাই ছিল কিডনী বিক্রির অনুমতিপত্র।
যাই হোক, অনেক দৌড়াদৌড়ি করেও আপনাকে আর নাগালে পেলাম না। উল্টো হয়রানি করার অপরাধে আমরাই মামলা খাওয়ার হুমকি পেলাম। এদিকে আমার অবস্থা আরো খারাপ হল। বাবা তার সব কিছু বিক্রি করে আমার চিকিৎসা করাতে লাগলেন। আমি আর পুরোপুরি সুস্থ হলাম না।
আমার পড়াশোনা লাটে উঠল। স্বাস্থ্য ভেঙ্গে গেল। বহুদিনের চিকিৎসার পরে খানিকটা যখন সুস্থ হলাম ততদিনে আমরা রাস্তার ফকির। বাবার কাধে ঋণের পাহাড়। রোজগার নেই, ঋণ শোধের তাড়া, আমার এই অবস্থা- টেনশনে বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমার চিকিৎসায় সর্বশান্ত বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। কিছুদিন পর মা-ও। চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু। আমার অবস্থা আরো খারাপ ততদিনে। হাত পা ফুলে যাচ্ছে। কিভাবে বেচে ছিলাম জানিনা। আত্মীয় স্বজনেরা ধরে বেধে আমার বোনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। ছোট দুই ভাই পড়া বন্ধ করে একজন রিকশা চালানো আরেকজন একটা দোকানে কাজ শুরু করল। আর বড় ভাই হয়ে তাদের কাধে বসে খেতে লাগলাম।
মাত্র তিন বছরের মাথায় আমাদের সোনার সংসার পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সব আপনার কারণে। শারীরিক সামর্থ থাকলে আমি আপনাকে খুন করতাম। কিন্তু আপনার কাছে ভেড়ারই সুযোগ ছিল না। কিন্তু প্রতিশোধের উন্মাদনা আমার প্রতি শিরায় শিরায়। নিস্ফল আক্রোশে কাটত আমার দিন। শেষমেশ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে সুযোগ পেয়ে গেলাম। এবার আমি বদলা নেব।
কিভাবে? আপনি আমার কিডনী কেটে রাখার পর, আমি এসব নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছিলাম। কিডনী দিয়ে শুরু করলেও পরে অন্যান্য অঙ্গ নিয়েও জানার চেষ্টা করি। তখন ই জেনেছিলাম কি কি প্রাণঘাতী জীবাণু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সময় স্থানান্তরিত হয়।
চমকে গেলেন নাকি? আপনি বুদ্ধিমান মানুষ, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আমি আসলে আমার কর্ণিয়ার সাথে সাথে একটা ভয়ঙ্কর জীবাণু আপনার স্ত্রীর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছি।
কুইক কুইজ। বলুনতো কোন রোগের জীবাণু?
ভাবতে থাকুন, ততোক্ষণে বলি, কেন আমি এমনটা করলাম। আপনাকে খুন করলে তো আপনি মুক্তি পেয়েই গেলেন কিন্তু আমিতো এত সহজে মুক্তি পাইনি। তাই ভেবে দেখলাম আপনাকে আমার মতই তিলে তিলে কষ্ট দিতে হবে। আর তা আপনি পাবেন আমার মতই প্রিয়জন হারালে। এবং কষ্টটা সর্বোচ্চ মাত্রা পাবে যদি সে আপনার সামনে ভয়ানক কষ্ট পেয়ে দুমড়ে মুচড়ে মারা যায়।
আপনার দোষে আপনার স্ত্রী কেন সাজা পাবে? আপনার অপরাধের সব কথা আপনার স্ত্রী জানতেন। তাতে তার নীরব না বরং সরব সম্মতি ছিল। চেম্বারে আপনার কাছে যেতে না পেরে আমরা আপনার বাসায় গিয়ে আপনার স্ত্রীকে সব বলে আমাদের একটু সাহায্যের আবেদন করেছিলাম। কিন্তু উনি নির্লজ্জের মত আপনার পক্ষাবলম্বন করে আমাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই তাকে কষ্ট দিতে আমার বিন্দুমাত্র আটকাচ্ছে না।
যাক, আসল কথায় আসি। কর্ণিয়ার সাথে সাথে আপনার স্ত্রীকে আমি জলাতঙ্ক রোগের জীবাণুও দিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। এটা ছাড়া আসলে আমার কাছে আর কোনো উপায় নেই। আমি ক্ষুদ্র মানুষ, চাইলেও আর কোনো রোগের জীবাণু জোগাড় করতে পারব না। আর মাত্র মাসখানেক ছিল আমার আয়ু। জলাতঙ্কের কারণে আরো দুই সপ্তাহ কম বাচব। কিন্তু আমার বদলা নেওয়া তো হবে।
আপনি যাতে টের না পান সে জন্যেই সব ফাইনাল করে বাবার কবর যিয়ারত করার নাম নিয়ে গ্রামে চলে এসেছি। গ্রামে পাগলা কুকুর সহজলভ্য। নিজ দায়িত্বে কামড় খেয়ে এসেছি। কেউ জানে না এখনো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করব কাউকে না জানানোর। খুশির খবর হল, জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেওয়া শুরু করেছে। আমার গলা শক্ত হয়ে গেছে, ঢোক গিলতে পারি না। কাল পরশুই হয়তো মরে যাবো।
আমার দুলাভাইকে বলেছি চিঠিটা যেন অপারেশনের কমপক্ষে দশদিন পরে দেয়, কারণ এর পর টীকা দিয়েও আপনার স্ত্রীকে বাচাতে পারবেন না।
ভালো থাকবেন!!!
খুব ইচ্ছা করছে আপনার মুখটা দেখতে। এই চিঠি পড়ার সময়তো আর সামনে থাকতে পারব না। কল্পনায় দেখে নিচ্ছি।
শোকে পাথর হয়ে গেলেন নাকি? জীবন্মৃত পাথর হয়েই বেচে থাকুন বাকি জীবন।
স্নেহধন্য !!
সাদেকুর রহমান
পুনশ্চঃ আমি জলাতঙ্ক রোগী কিন্তু এটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না যে আমার কর্ণিয়াতে জলাতঙ্কের জীবাণু বাসা বেধেছে কিনা। যদি তা না হয়, তাহলে আপনার স্ত্রী বেচে গেলেন। প্রতিশোধ নিতে গিয়েও আপনাকে আমি একটা সুযোগ দিচ্ছি, যা আপনি আমাকে দেননি। তবে মনে প্রাণে আশা করছি সুযোগটা যেন আপনি না পান। একজন মরণাপন্ন লোকের দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন আশা করি।
চিঠি পড়ে আসলেই পাথর হয়ে বসে রইলেন ডাঃ আশরাফ। নিস্পলক চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। পাপের সাজা দুনিয়াতেই এভাবে পাবেন ভাবেননি।
আচ্ছা, লোকটার কর্নিয়াতে কি জলাতঙ্কের ভাইরাস ছিল? কথাটা ভাবতেই সম্বিত ফেরে তার। এখনো হয়তো সুযোগ আছে। স্ত্রীর খোজ নিতে দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখেন ১৪টা মিসড কল। সব গুলোই তার মেয়ের নাম্বার থেকে।
সর্বনাশ! তবে কি সুযোগটা আর পাওয়া গেল না? স্ত্রীর অবস্থা খারাপ বলেই কি এতবার ফোন? নাকি চোখের বাধন খোলা হবে বলে তাকে যাওয়ার জন্যে ফোন দিয়েছে। ভাবতে ভাবতেই কল আসে আবার। আতঙ্কিত চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন ডাঃ আশরাফ।