১.
দশতলা একটা বিল্ডিঙের সাত তলায় থাকি আমি। একা না। আরও তিনজন সহ মেস করে। বাড়িওয়ালা ভালো মানুষ। আর তাছাড়া আমরা সবাই চাকুরিজীবি, তাই সরাসরি ব্যাচেলর বলে বাতিল করে দিতে পারেননি। এ কারণেই বাসাটা পাওয়া। বিল্ডিং এ ফ্রি ডাক্তার পেয়ে অন্য বাসিন্দাদেরও কোনো আপত্তি ছিল না। স্বাস্থ্যজনিত যে কোন দরকারে সবাই আমার কাছেই আসে। ছোটখাটো গা গরম বা সর্দি, সবার সমস্যা এ রকমই থাকে। মাঝে মাঝে কারো জন্য ভালো ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করে দেই। এইসব টুকিটাকি কাজ। হঠাৎ সেদিন রাত তিনটায় কলিং বেলের আওয়াজ। সাথে দরজায় ধুপধাপ আর ত্রস্ত কণ্ঠে আমার নাম ধরে ডাকাডাকি। চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে দেখি তিনতলার আনোয়ার সাহেব।
- ডাক্তার সাহেব, একটু তাড়াতাড়ি আসেন। আপনার ভাবীর কি যেন হয়েছে। খুব পেইন উঠেছে।
আনোয়ার সাহেবের ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। সেদিনও দেখে এসেছি, পুরো সুস্থ। এমনতো হওয়ার কথা না। যাই হোক, নামতে গিয়ে খেয়াল করলাম লুঙ্গি পরা। তরুন বয়স, একজন ভদ্র মহিলার সামনে এভাবে যেতে বাঁধল। আনোয়ার সাহেবকে তাই বললাম, আপনি নামুন আমি আসছি।
দ্রুত ট্রাউজার পরে আমার সাইড ব্যাগটা নিয়ে প্রায় দৌড়ে নামলাম তিনতালায়।
গিয়ে দেখি ভাবীর অবস্থা খুবই খারাপ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বেড। ভাবীর মা ভাবীর মাথাটা কোলে নিয়ে বসে আছেন। ভাবীর মুখটা রক্তশুণ্য হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ব্যাথা হচ্ছে বোঝাই যাচ্ছে। পালস চেক করলাম। হার্টবীট খুবই কমে গেছে। এই অবস্থায় এখানে আমি কিছুই করতে পারব না। দ্রুত হাসপাতালে ফোন করলাম এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্যে, আনোয়ার সাহেবকে পাঠালাম ব্লিডিং বন্ধ করার জন্য একটা ইঞ্জেকশন আনতে।
কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, বাচ্চার কিছু হয়েছে কিনা। যে পরিমাণ ব্লিডিং হয়েছে, তাতে মোটামুটি নিশ্চিত যে অ্যাবরশন হয়ে গেছে। না হলেও এই অবস্থায় মাকে বাচাতে হলে অ্যাবরশন করা লাগতে পারে। কিন্তু এখন এসব বলার সময় না। ধমক দিয়ে বললাম, দ্রুত ইঞ্জেকশনটা আনেন। নাইলে বাচ্চার কিছু না হলেও, মা যে মরবে সিওর।
উনি দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আমি আর কি করি, এ্যাম্বুলেন্স আসার আগ পর্্যুন্ত কিছু করার নেই। ভাবলাম বসার ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করি। সেকথা বলতেই ভাবীর মা বললেন, ‘তুমি এখানেই বস বাবা, আমার খুব ভয় করছে। মেয়েটার এই অবস্থা.......’ বলতে বলতে কেদে দিলেন উনি।
- কাদবেন না খালাম্মা, আল্লাহ ভরসা। আল্লাহকে ডাকেন।
রুমের চেয়ারটা টেনে ভাবীর মাথার কাছেই বসলাম। মাত্র কাচা ঘুম থেকে উঠেছি, মাথাটা খুব ভারী লাগছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দেখি চোখও জ্বলছে। বাথরুমে ঢুকে বেশ করে মুখে পানি দিলাম। মাথায়ও ঢাললাম খানিকটা। কিন্তু ফিরে এসেও দেখি ঝিমানি লাগে। আজকে আর ঘুমানো হবে না। চা খেতে পারলে ভালো হত, সেটা তো আর সম্ভব না। বেডসাইড টেবিলে একটা ওষুধের বাক্স। সম্ভবত ভাবীর। খুলতেই যা খুজছিলাম, পেয়ে গেলাম। নাপা এক্সট্রা। এতে ক্যাফেইন আছে। ঘুম তাড়াতে লাগবে। নাপার পাতাটা নিতে যেতেই টান লেগে আরেকটা ওষুধের পাতা মেঝেতে পড়ে গেল। আমি ওষুধটা তুলে রাখতে যাব, এমন সময়েই আনোয়ার সাহেব ফিরে এলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছেন বোঝা যাচ্ছে। উনার ব্যস্ততা আমার মাঝেও সঞ্চারিত হল। দ্রুত ইনজেকশনটা দিয়ে দিলাম। নিচেও আম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা গেল। আমি আর আনোয়ার সাহেব ধরাধরি করে ভাবীকে আম্বুলেন্সে তুললাম।
আমার ধারণাই ঠিক। আবরশন বাসায় থাকতেই হয়েছে। সময়মত হাসপাতালে আনতে পারায় ভাবীকে বাচানো গেছে। সেপটিক হয়ে গেলে তাও যেত না। তবে অবস্থা এখনো ক্রিটিকাল। খারাপ কিছু হতেও পারে। এত রাতে রক্ত ম্যানেজ, ওষুধ ম্যানেজ, অপারেশনের আরেঞ্জমেন্ট সব আমাকেই করতে হয়েছে। তারপরও নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। আনোয়ার সাহেবের সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। রুমে ফিরে এলাম দ্রুত। একটু পরেই কলেজে ক্লাস নিতে যেতে হবে।
২.
খুব বিধ্বস্ত লাগছিল। কলেজে শেষ ক্লাসটা না নিয়েই রুমে চলে এলাম। দেখি দুপুরের রান্না চলছে। গোসল সেরে শরীর ফ্রেশ হল কিন্তু মন পূরোপুরি ফ্রেশ হল না। বারবার রাতের কথা মনে পড়তে লাগল। ডাক্তার হয়েছি, কিন্তু এখনও অ্যাকসিডেন্টগুলো মেনে নিতে শিখতে পারিনি পুরোপুরি। তখনই হঠাৎ মাথায় আসল, আচ্ছা, ভাবীর তো এই অ্যাকসিডেন্টটা হওয়ার কথা না। ভাবীর সব রিপোর্ট আমি দেখেছি। সব কিছুই একদম নর্মাল। আনোয়ার সাহেবের অনুরোধে আমি নিজেও চেক করেছি একবার। সব কিছু একদম পারফেক্ট। এমনি এমনি আবরশন হওয়ার মত কোন কারণই নেই। উনি কি এই অবস্থায়ও কি বাসার ভারি কাজ কর্ম করতেন নাকি? দুজনের সংসারে কাজ তেমন নেই বলে এতদিন কাজের লোক ছিল না। কিন্তু ভাবী প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর আমাদের বাসার বুয়াকেই তো রেখেছেন ছুটা কাজ কর্ম করার জন্যে। তাছাড়া ভাবীর মাও আছেন। পড়ে টড়ে গেছিলেন নাকি?
আমি বুয়াকে ডাকলাম জিজ্ঞেস করার জন্য।
বুয়ার কাছ থেকে যে তথ্য পেলাম, তা বেশ ভয়ঙ্করই বলা চলে। আনোয়ার সাহেব আর ভাবী নাকি নিয়মিত ঝগড়া করেন। এমনকি উনি একদিন ভাবীকে বুয়ার সামনেই চড় মেরেছিলেন। বুয়ার ধারণা আনোয়ার সাহেব বাচ্চাটা চাননা। কারণ উনার ধারণা বাচ্চাটা অন্য কারোর। উনি নাকি প্রায়ই আরেকজনের নাম ধরে ভাবীকে গালাগালি করেন। ভাবী বহুবার বাপের বাড়ি চলে যেতে চেয়েছেন কিন্তু আনোয়ার সাহেব দেননি। শেষমেশ বহু কান্নাকাটির পর ভাবীর মাকে বাসায় আনেন। উনি আসায় রক্ষা। নইলে আনোয়ার সাহেব এতদিনে ভাবীকে খুনই করে ফেলতেন।
আমি বিরক্ত হয়ে বুয়াকে ফেরত পাঠালাম। তিলকে তালগাছ করা এদের মজ্জাগত অভ্যাস।
তবে ব্যাপারটা মাথা থেকে সরাতে পারলাম না।
আনোয়ার সাহেবকে দেখেতো বৌ পেটানো লোক মনে হয় না। ঝগড়া ঝাটি হতেই পারে, তাই বলে বৌকে এই কণ্ডিশনেও মারবেন? নাকি আসলেই উনি ভাবীকে বাচ্চাটার ব্যাপারে সন্দেহ করেন আর বাচ্চাটাকে নষ্ট করতে চান। বুয়ার সামনেও যখন চড় মারতে পেরেছেন, যখন কেউ ঘরে থাকে না, তখন আরো বড় কোন শারীরিক আঘাত করা অসম্ভব কিছু নয়। ঐদিন রাতেও কি তেমন কিছু করেছিলেন? যদি করে থাকেন, তাহলে এটা একটা ক্রিমিনাল আবরশন। ভাবীর যদি খারাপ কিছু হয়, তাহলে পুলিশকে জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব। তবে তার আগে ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে হবে।
ভাবীর মাকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত জানা যেতে পারে।
রাতে ডিউটির ফাকে আবার গেলাম হাসপাতালে। আত্মীয় স্বজন অনেকেই এসেছেন দেখলাম। ভালোই হল। ভাবীর মাকে ডেকে নিলাম একপাশে
- খালাম্মা, একটা কথা বলার ছিল।
- বল বাবা।
- না মানে, কথাটা আসলে এখন বলাটাও কেমন লাগে, কিন্তু না বলেও পারছিনা।
- বল তুমি। সমস্যা নেই।
- ইয়ে, আনোয়ার সাহেব আর ভাবীর মধ্যে সম্পর্কটা কি স্বাভাবিক ছিল?
- কেন, বলতো বাবা।
- আসলে, আমি ভাবীর রিপোর্ট গুলো দেখলাম। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। হুট করে আবরশন হওয়ার কথা না, যদি না কোন অ্যাকসিডেন্ট হয়। আমার বাসার বুয়াটা বলল, আনোয়ার সাহেব নাকি প্রায়ই ঝগড়া করতেন ভাবীর সাথে। এমনকি গায়েও হাত তুলেছিলেন। তাই আমি ভাবছিলাম, ঐদিনেও কি উনি এরকম কিছু করেছিলেন নাকি?
খালাম্মা কিছু বলেন না। মুখ নামিয়ে নেন।
- যদি বলতে না চান, তো থাক। কিন্তু ডাক্তারের কাছে কিছু লুকানো উচিত না। উনার যদি এমনিতেই এরকম হয়, তাহলে একরকম চিকিৎসা আর যদি কোনো আঘাত বা মানসিক কারণে এটা হয়, তাহলে সেটার চিকিৎসাও তো করা লাগবে। আর আনোয়ার সাহেবকেওতো এমনি এমনি ছেড়ে দিতে পারি না।
- আসলে নিজের মেয়ের কথা, কিভাবে বলি। আনোয়ারের সাথে ওর সম্পর্কটা সত্যিই ভালো না। শুরু থেকেই একটু সমস্যা ছিল। কারণ দিবার আরেকটা ছেলেকে পছন্দ ছিল। ছেলেটা মারা যাওয়ায় আমরা একরকম জোর করেই আনোয়ারের সাথে ওর বিয়ে দেই। আমরা ভেবেছিলাম আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। কারণ আনোয়ার দিবাকে আগে থেকেই পছন্দ করত। কিন্তু হল না। যখন শুনলাম বাচ্চা হবে, তখন ভাবলাম এবার নিশ্চয়ই সব ঠিক হবে। কিন্তু হল উল্টোটা। ওদের ঝগড়া চরমে উঠল। আনোয়ার নাকি বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল, তাই দিবা আমাদের কাছে এসে থাকতে চাইল। আনোয়ার দিল না। শেষে অনেক কাহিনী করে আমি আসলাম। আমি আসায় ঝগড়া কমল কিন্তু বন্ধ হল না।
- আনোয়ার সাহেব কি ভাবীর গায়ে হাত তুলছে কখনো?
- আমার সামনে না। তবে একবার থাপ্পড় মারছিল বলে শুনছিলাম। আর কখনো শুনিনি।
- কিছু মনে করবেন না। আনোয়ার সাহেব নাকি সন্দেহ করতেন যে, বাচ্চাটা উনার না। এমন সন্দেহ করার কি কোনো যৌক্তিকতা আছে?
- কই নাতো। এরকম কিছু না। বাচ্চা হবে শুনে, ও তো দিবার চেয়েও খুশি। দিবা যে ছেলেটাকে পছন্দ করত, সে তো মারাই গেছে। ও ছাড়া আর কোনো ছেলের সাথেই দিবার ঘনিষ্টতা ছিল না।
- হুম, অ্যাকসিডেন্টটা যেদিন হল, ঐদিনও কি উনারা ঝগড়া করেছিলেন?
- না। যে রাতে দিবার এটা হল, তার আগের দিন বিকেলে ওরা খুব ঝগড়া করে। দিবাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাগ করে আনোয়ার বাইরে চলে যায়। টাকাও দিয়ে যায়নি। পরে দিবা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে একাই ডাক্তার দেখায় আসে। আনোয়ার ফেরে রাত বারোটার পর। ফিরে আবার ঝগড়া। পরদিন অবশ্য আনোয়ার স্যরি বলে মাফ চায়। প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওষুধ টশুধ সব কিনে এনে দেয়। সারা দিনই খুব ভালো থাকে। দিবাও পুরো নর্মাল। দেখে ভাবসিলাম ওদের সব বোধহয় এবার ঠিক হবে। কিন্তু আর হল কই? ঐদিন রাতেই অ্যাকসিডেন্টটা হল।
- আচ্ছা রাতে কি কিছু হয়েছিল? মানে উনারাতো এক রুমেই ছিলেন। আনোয়ার সাহেব ঐদিন কি ভাবীকে কিছু করেছিলেন?
- নাহ। আমি আসার পর থেকে দিবা আমার সাথেই ঘুমাত। সে রাতেও ছিল। সারাদিন দুজন হাসি খুশি। ঐ বাসায় আসার পর সেদিনই প্রথম আমি টেনশন ছাড়া ঘুমাতে যাই। হঠাৎ তিনটার দিকে দিবার গোঙ্গানিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি পেইন উঠেছে, আমি গিয়ে আনোয়ারকে ডেকে তুলি। পরে ও গিয়ে তোমাকে ডেকে আনে।
- ওহ! আচ্ছা। তাহলেতো ব্যাপারটায় আনোয়ার সাহেবের কোন হাতই নেই।
- না নেই। বৌএর সাথে ঝগড়া করলেও নিজের বাচ্চার ক্ষতি কি কেউ করতে পারে? ও তো খুব ভেঙ্গে পড়েছে। সারাদিন হাসপাতাল ছেড়ে যায়নি। খায়ওনি কিছু।
- কি বলেন। তাহলেতো উনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।
- সেটাইতো। আমি অনেক বললাম শুনল না। তুমি দেখতো বাবা, ওকে কিছু মুখে দেওয়াতে পারো নাকি।
- ঠিক আছে খালাম্মা। আমি দেখছি।
হাসপাতালের ওয়েটিং রুম থেকে আনোয়ার সাহেবকে জোর করে ধরে নিয়ে গেলাম খাওয়াতে। হোটেলে গিয়েও না খাওয়ার জন্য গাইগুই করতে লাগলেন।
- আরে ভাই খাবেন না কেন? আলসার হয়ে যাবেতো।
- নারে ভাই। ওসব কিছু হবে না। না খেয়ে দিন পার করে আমার অভ্যাস আছে। এতদিনে যখন কিছু হয়নি, আর হবেও না।
- আচ্ছা বাদ দেন। না হলেতো ভালো। কিন্তু আপনি এমন করলে ভাবীকে স্বান্তনা দেবে কে? আপনারতো শুধু মন খারাপ। আর উনার শরীরের কি অবস্থা একবার ভাবেনতো?
- আর শরীর.......
আনোয়ার সাহেব চুপ করে গেলেন। একবার ভাবলাম উনাদের সমস্যাটা নিয়ে আলাপ করি। সমস্যাটা উনাদের একান্ত ব্যক্তিগত ভেবে সেই চিন্তা বাদ দিলাম। ঝামেলা উনারা নিজেরাই মিটাবেন। এই ঝামেলার সংশ্লিষ্টতায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে আমি ভুমিকা রাখতে পারতাম এবং আমি আমার যথাসাধ্য করেছি। এই ভেবে মাথা থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেললাম।
৩.
সপ্তাহখানেক পর। সাপ্তাহিক ছুটির দিন।
ধোয়ার জন্য একগাদা কাপড় নিয়ে পকেট চেক করছি। ট্রাউজারের পকেটে হাত দিয়ে দেখি কি যেন খচখচ করে। বের করে দেখি কাল রাতের ওষুধের পাতাটা। তাড়াহুড়ায় পকেটে ঢুকায় ফেলসিলাম। এক পাতা Misoprostol. আলসারের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। পুরো পাতাটাই খালি। নামটা পড়ে পকেটের মত মনটাও কেমন খচখচ করে উঠল। কিন্তু কাপড় ধোয়ার তাড়ায় সেটাকে আর পাত্তা দিলাম না। পাতাটা ফেলে দিলাম।
কাপড় ধুচ্ছি, হঠাৎ কোন কারণ ছাড়াই হঠাৎ মাথার ভিতর কেউ যেন বলে দিয়ে গেল, আরে Misoprostol তো একটা অ্যাবরটিফিসেন্ট। অ্যাবরটিফিসেন্ট হল এমন ওষুধ যা অ্যাবরশন ঘটায়। মূহূর্তেই কাপড় ধোয়া মাথায় উঠল।
এটা কি দিবা ভাবীর ওষুধ? এই ওষুধ খেলে আবরশনতো হবেই।
অনেকগুলো প্রশ্ন জমে গেল মনে। কাপড়গুলো ধুয়েই ছুটলাম হাসপাতালে। ভাবীর প্রেসক্রিপশনগুলো চেক করলাম। সেখানে এই ওষুধের নাম নেই। থাকার কথাও না। কোন ডাক্তার এক্সট্রিম কন্ডিশন ছাড়া কোন প্রেগন্যান্ট মহিলাকে কখনোই এই ওষুধ দেবেন না।
ভাবীর মাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম এই ওষুধ উনারও না।
তার মানে এই ওষুধ ভাবীকে আনোয়ার সাহেবই এনে দিয়েছেন। কারণ যে রাতে ভাবীর আবরশন হয়, সেদিন আনোয়ার সাহেবই ভাবীর সব ওষুধ কিনে এনেছিলেন। অর্থাৎ আনোয়ার সাহেব সম্পূর্ণ অমূলক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে নিজের সন্তানকে হত্যা করেছেন।
আনোয়ার সাহেবকে ধরতে হবে। ফোন দিলাম, দেখি বন্ধ। শুনলাম উনি কোথায় কেউ নাকি জানে না। উনার বাসার লোকজনও না।
কি আর করা। অপেক্ষায় রইলাম দেখা হওয়ার। বাসা যখন এক বিল্ডিঙে, আশা করি দেখা আরেকবার হবেই।
কয়েকদিন পর কলেজ থেকে বাসায় ফিরছি। লিফট নষ্ট। তিনতলায় উঠে দেখি আনোয়ার সাহেবের বাসায় তালা নেই। তার মানে উনারা বাসায় ফিরেছেন। দেরি করতে মন চাইল না, ঠিক করলাম তখুনি সব জিজ্ঞেস করব। বাইরে ঠিক দরজার সামনে ময়লার বালতি। অনেকদিন পর বোধহয় সব পরিষ্কার করা হল। বালতি ময়লায় উপচে পড়ছে। পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে বেল টিপলাম। ভাবীর মা দরজা খুললেন। আনোয়ার সাহেব নেই। বললাম ভাবী হলেও চলবে। আমাকে বসার ঘরে বসিয়ে ভাবীকে ডাকতে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ভাবী এলেন। শুয়ে ছিলেন সম্ভবত। মুখে রঙ ফিরেছে। সালাম দিয়ে বললাম,
- স্যরি ভাবী এই অবস্থায় আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।
- না না। সেদিন রাতে আপনি না থাকলে কি যে হত! যাই হোক, আপনি কি জরুরী কিছু বলবেন? তাহলে আপনার ভাইকে বললে ভালো হয়, কারণ আমি আজ চলে যাবো। ফিরব কবে জানিনা।
- না, ভাইকে না। আপনাকেই বলব।
- বলুন।
- আপনি বসেন। আমার বলতে একটু সময় লাগবে।
নিতান্ত অনিচ্ছাতেও উনি বসলেন।
- বলুন এখন কি বলতে চান।
- কাজটা কেন করলেন?
- কোন কাজটা?
- অ্যাবরশনটা। নিজের সন্তানকে হত্যা করলেন? কিভাবে পারলেন!
- মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন?
- আপনি আপনার সন্তানকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছেন।
- মি. পিয়াস, হাসপাতালে কি আপনার উপর খুব চাপ যাচ্ছে? আজেবাজে বকছেন। আপনি নিজে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। ম্যানুয়াল আবরশনের কোন চিহ্ন কি আপনি দেখেছিলেন?
- বুঝেছি। আপনি বলবেন না। আচ্ছা আগে আমারটা শুনুন। তারপর নাহয় বলবেন।
- বলুন।
- আপনার মা এবং কাজের বুয়ার কাছ থেকে আমি জানতে পারি যে, আনোয়ার সাহেবের সাথে আপনার সম্পর্কটা ভালো না। ইভেন উনি আপনার গায়ে হাত পর্্যআন্ত তুলেছেন। এটা সহ উনার আরো আচরন প্রমাণ করে যে, উনি সম্ভবত বাচ্চাটাকে চাচ্ছেন না। সে জন্য আমার ধারণা ছিল যে, ঐদিন রাতেও উনি আপনাকে শারীরিক ভাবে কিছু করেছেন ফলে আপনার আবরশন হয়ে যায়। কিন্তু ঐরাতে আপনারা একসাথেই ছিলেন না। তাই আমি এটা নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি। কিন্তু সমস্যা বাধল আজ সকালে। যে রাতে আপনার আবরশন হয়, সে রাতে ভুল ক্রমে আমি আপনার রুম থেকে Misoprostol এর খালি একটা পাতা নিয়ে যাই। এই ওষুধটা আলসারের ঝুকিপূর্ণ মানুষদের ট্রিটমেন্টে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ওষুধটারই আরেকটা কাজ আছে। কাজটা হল এটা গর্ভাবস্থায় জরায়ুর সঙ্কোচন শুরু করতে পারে। সরাসরি বললে, অ্যাবরশনের কাজে এটা ব্যবহৃত হয়। আনোয়ার সাহেবের আলসার নেই। ঐ ওষুধগুলো আপনার মায়ের ও না। কিন্তু ওষুধের পাতাটা খালি। কেউ নিশ্চয়ই এমনি এমনি ওষুধ ফেলে দেয় না। তার মানে কেউ খেয়েছে। উনারা যখন খাননি তার মানে ওষুধগুলো আপনি খেয়েছেন। আমার ধারণা ছিল আনোয়ার সাহেব আপনাকে ওষুধগুলো এনে দিয়েছেন কারণ আপনার মা বলেছেন আপনার আবরশনের আগেরদিন উনিই আপনাকে সব ওষুধ কিনে এনে দেন। যেহেতু আনোয়ার সাহেব সন্তান চাচ্ছেন না, তাই সরাসরি কিছু না করে টেকনিক্যালি আপনার অ্যাবরশন করিয়ে ফেলেন।
- আপনার ধারনাতো ঠিকই আছে। আপনি আমাকে কেন দোষী করছেন?
- কারণ এই কাগজটা।
আমি পকেট থেকে একটা দোমড়ানো কাগজ বের করলাম। ওটা দেখেই ভাবীর মুখ শক্ত হয়ে গেল।
- আমি এটা ময়লা ফেলার বালতিতে পেয়েছি। এখানে অ্যাবরশন করতে পারে এমন অনেকগুলো ওষুধের নাম লেখা আছে। এর মধ্যে Misoprostol এর উপর গোল দাগ দেয়া। তাছাড়া এটার ডোজ, বাজারে কি নামে পাওয়া যায় আরো টুকিটাকি লেখা। দেখলেই বোঝা যায় যে, কেউ এই ওষুধটা নিয়ে খোঁজ খবর করেছে। সম্ভবত ইন্টারনেট থেকে। এবং সেই কেউ টা আপনি।
- কিভাবে বুঝছেন যে এটা আমার লেখা? আনোয়ারের ও হতে পারে। আপনি কি আমার লেখা চেনেন?
- না চিনি না। আনোয়ার সাহেবেরটাও চিনি না। চেনার দরকারও নেই। কারণ লেখার ফাকে, সম্ভবত আনমনেই, আপনি নিজের নামও লিখেছেন।
বলে নাম লেখা জায়গাটা আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম। ভাবীর মুখের রঙ আবার সরে গেছে। সোজা হয়ে বসে ছিলেন এতক্ষন, এখন হেলান দিয়ে বসলেন।
- আপনার খারাপ লাগলে নাহয় থাক। সুযোগ হলে পরে শুনব নাহয়।
- নাহ, সবই যখন জানেন, তখন বাকিটুকও শুনুন। এইটুক আর বাদ থাকে কেন?
- আপনার কষ্ট না হলে বলুন।
- আমার আর নতুন করে কষ্ট কি? এই জীবনে যত ধরণের কষ্ট পাওয়া সম্ভব সবই আমি পেয়েছি।
বলতে বলতে গলা ধরে আসে ভাবীর। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার শুরু করেন,
- আনোয়ারকে বিয়ে করার আগে আমি আরেকজনকে ভালবাসতাম। অসম্ভব রকমের ভালবাসতাম। আমার সাথেই ভার্সিটিতে পড়ত। আর আনোয়ার হল আমাদের পাড়ার সিনিয়র ভাই। ও ও আমাকে পছন্দ করত। কিন্তু আমি ওকে না করে দিয়েছিলাম। পড়াশোনা শেষ করার পর যখন মা বাবা আমার বিয়ে দেবেনই, তখনও রায়হান মানে আমি যাকে পছন্দ করতাম, বেকার। আর আনোয়ার এলেকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর ছেলে। নিজেও প্রায় প্রতিষ্ঠিত। প্রথম প্রস্তাবটাও ওদের বাসা থেকে আসে। বাবা মা আপত্তি করার কারণ দেখেননি, কিন্তু আমি বেকে বসায় পরে বাদ দেন। রায়হানের ব্যাপারেও উনাদের রাজি করিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন..
আবারো ভাবীর গলা ধরে আসে। সামলে নিয়ে বলেন
- একদিন রোড অ্যাকসিডেন্টে রায়হান মারা যায়। আমি আর এই জীবনে বিয়ে করব না বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু বাবা মার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্্যান্ত রাজি হই। আনোয়ারের প্রতি আমার কোনো রাগ ছিল না। এমনকি বিয়ের সময় ভেবেছিলাম, পারি আর না পারি, অন্তত চেষ্টা করব ওকে ভালবাসার। কিন্তু বাসর রাতেই ও আমাকে গর্ব করে বলল, রায়হান নাকি অ্যাকসিডেন্ট করেনি, আনোয়ারই ওকে মেরেছে। আনোয়ার যা চায়, তা কেউ আপোষে না দিলে, ও নাকি এভাবেই কেড়ে নেয়। বলুন, এই কথা আমি কি করে সহ্য করি? ঐ মূহুর্ত থেকে আনোয়ারের চে ঘৃণ্য জীব আর কিছু ছিল না। বুঝলাম ও আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি। রায়হানকে হারিয়ে ও শুধু জিততে চেয়েছিল। জয় হয়ে গেছে, তাই আমার গুরুত্বও আর ওর কাছে নেই। বাবা মার মুখ চেয়ে সেটাও মেনে নিতে রাজি ছিলাম।
কিন্তু ও প্রতি কথায় রায়হানকে টেনে আনত। আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে রায়হানকে ডেকে ডেকে নিজের বিজয়গাথা বর্ণনা করত। এমনকি আমাকে আদর করার পরও রায়হানকে জড়িয়ে নানা আজেবাজে কথা বলত। প্রথম দিকে দাতে দাত চেপে সব সহ্য করতাম। একসময় আর পারলাম না। আমিও জবাব দেওয়া শুরু করলাম। সবাইকে বলে দেব হুমকি দেওয়ার পর ও আমাদের পাড়া ছেড়ে আমাকে নিয়ে এখানে চলে আসে। বাচ্চাটাকে মারার কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু আমি কনসিভ করার পর থেকেই আনোয়ার আরো বাড়াবাড়ি শুরু করে। বাচ্চাটা নাকি ওর বিজয়ের মাইলফলক। প্রায়ই রায়হানের নাম ধরে ডেকে ডেকে বলত, ‘কি মি. রায়হান ভালোইতো প্রেম করসেন ৫ বছর, কিছুতো করতে পারলেন না। দেখেন এক বছরের মাঝেই আমার কেরামতি।’ এগুলো ছাড়াও আরো অনেক কথা যেগুলো আমি মুখে আনতে পারব না। যত দিন যায় আমার বাচ্চাটার প্রতি ততই ঘৃণা বাড়তে থাকে। আমি বুঝতে পারি, একে দুনিয়ায় আনলে, আমাদের ঝামেলা আরো বাড়বে। আনোয়ারকে তাই আবরশনের হুমকি দেই। তখন ও আমাকে থাপ্পড় মারে। আমার কথায় ভয় পেয়ে দ্রুত মাকে নিয়ে আসে। নিজেও সারাক্ষন আমাকে চোখে চোখে রাখত। কোথাও বেরুতেও দিত না। কিন্তু আমি তখনও ডিটারমাইন্ড যে আমি আবরশন করবই। অন্তত এই ক্ষেত্রে আমি আনোয়ারকে কিছুতেই জিততে দেব না। সেদিন সুযোগ পেয়ে গেলাম। ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে ওষুধ কিনে আনলাম। নিজে থেকে ডাক্তার দেখিয়ে আসায় আনোয়ার ভেবেছিল, আমি বোধহয় আবরশনের প্লান বাদ দিয়েছি। তাই ও খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু ওর হাসি মুখ আমার সহ্য হয়নি। তাই ঐদিন রাতেই শোয়ার সময় পুরো পাতাটাই খালি করে দেই।
পরেরটুকু তো আপনি জানেনই।
ভাবী চুপ করে গেলেন। দুচোখ বেয়ে অবশ্য জল ঝরছে। আমিও বলার মত কিছু না পেয়ে চুপ করেই থাকলাম।
- আপনার কাছে কি কি মনে হয় আমি খুব বড় অপরাধ করেছি? আমার মনে হয় না। একটা শিশুকে অনিশ্চিত পৃথিবিতে না এনে তাকে নিশ্চিত নিয়তির দিকে ঠেলে দিয়ে আমি ভুল করিনি। দুনিয়ার আলো দেখলেও শিশুটা মায়ের ভালোবাসা পেত না, বাবার স্নেহ পেত না। আমাদের প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে একদিন ঠিকই খুন হয়ে যেত। এরচে এটাই ভালো হয়েছে।
আমি তাও চুপ।
- আপনি কি করতে চান? আমাকে পুলিশে দেবেন? দিতে পারেন। আমি আমার জীবনের সবচে ভালবাসার মানুষটিকে হারিয়েছি। আমার কলিজার টুকরা আমার সন্তানকে নিজ হাতে মেরেছি। জীবনে আমার আর কিছু হারাবার নেই।
- না আমি কিছুই করব না। কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, সেটা বিচারের মত জ্ঞান স্রষ্টা আমাদের দেননি। আপনার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে সেটা করেছেন। আমি সেটা বিচার করতে চাচ্ছিনা। আমি একজন কৌতুহলী মানুষ। কৌতূহল মিটাতে পেরেই আমি সন্তুষ্ট।
- আপনাকে একটা অনুরোধ করি।
- বলুন।
- আনোয়ারকে প্লীজ এসব বলবেন না। ওর ধারণা রায়হানের অভিশাপেই এটা হয়েছে। ভালোমতই ওর শিক্ষা হয়েছে। কে জানে, হয়ত একদিন আমরাও আবার নতুন করে সব শুরু করতে পারব।
একথা আমাকে না বললেও অবশ্য আমি আনোয়ার সাহেবকে কিছু বলতাম না। তারপরও ভাবীকে কথা দিয়ে, ভাবীর মায়ের ভাত খাওয়ার নিমন্ত্রণকে এড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। এরপর আর উনাদের সাথে দেখা হয়নি।
- কেন? উনারা শেষ পর্্য ন্ত আবার শুরু করতে পেরেছিলেন কিনা খোজ নেননি?
প্রশ্নটা ডিবি অফিসার রফিক সাহেবের। আমার অফিসে বসে গল্প হচ্ছিল। রফিক সাহেব এসেছেন এক গর্ভবতী মহিলার লাশ নিয়ে। হাজব্যাণ্ড মেরেছে। সে কারণে অ্যাবরশন, তা থেকে মৃত্যু। এসব নিয়েই গল্প করতে করতে উনাকে কাহিনীটা শোনালাম।
- উনারা ঐ বাসা ছেড়ে দিয়েছেন। আর কথা হয়নি।
- হুম।
- আপনি যার লাশ নিয়ে এসেছেন, এরা অশিক্ষিত মানুষ। না বুঝে প্রবৃত্তির বশেই অনেক কিছু করে বসে। কিন্তু সমাজের উচুতলায় বাস করা এই সভ্য মানুষদের এমন আচরণকে আপনি কি বলবেন?
- সভ্য আচরণই বলব, কারণ জয়ের নেশায় সব মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে আজ আমরা অমানুষ। তাই এই সভ্য সমাজে মানুষদের জায়গা নেই। বিকাশের আগেই মনুষ্যত্বের অ্যাবরশন ঘটছে প্রতিনিয়ত।
হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে আমিও তাতে সায় দেই।