পৃথিবী জুড়ে করোনা ভাইরাসের সাথে আজ যে বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তাতে এদ্দিন পর্যন্ত মানুষ ব্যক্তিগত লড়াইয়ে সাফল্য পেলেও (মৃত্যুহার গড়ে মাত্র ১-২%) সামগ্রিক ভাবে কোনঠাসা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অবশেষে মনে হচ্ছে একটা লড়াই করার জায়গা তৈরী হচ্ছে। একটা পাল্টা মার দেবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। আজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ৭৬ টি গবেষণাগারে এই ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে রোগের প্রতিষেধক বানাবার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। হ্যাঁ প্রতিযোগিতাই, আর তার মহান দিকটি যেমন, কে আগে মানবজাতির উদ্ধারকর্তা হতে পারে তার আগ্রহ (কারণ সত্যি বলতে ঈশ্বরের উপর আস্থায় কোথায় যেন টোল পড়েছে। দুর্বল মানব হৃদয়ে যে ঈশ্বরবিশ্বাস এতদিন মানসিক শক্তি যোগাতো, সেখানে যেন কিছুটা হতাশার সঞ্চার হয়েছে।), যা বিশ্বজোড়া খ্যাতির সাথে সাথে নোবেল পুরষ্কারও এনে দিতে পারে; তেমনি, অন্যদিকে আছে বিপুল অর্থলাভের সুনিশ্চিত আশ্বাস। এর মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সারা গিলবার্টের দলটির কর্মকান্ড নিয়েই কিছু তথ্য শেয়ার করছি।
প্রথমে আমরা দেখবো, vaccine বানানোর প্রচলিত পদ্ধতি। সাধারণতঃ যে কোনো vaccine-এর ক্ষেত্রে, human trial বা clinical trial-এর শুরু থেকে তাকে বাজারজাত করতে অন্ততঃ দেড় থেকে ২বছর সময় লাগে। এই সময়টায় কিন্তু vaccine বানানোর মূল প্রক্রিয়াটা ধরা হচ্ছে না। মানে, গবেষক অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় নানান রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় test tube-এ যে vaccine যোগ্য বস্তুটি খুঁজে পান ও সেটি বিভিন্ন মনুষ্যেতর প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে আশানুরূপ ফল পাওয়া অবধি চক্রবৎ যে পরিশ্রম করে যান সেটা এই হিসাবের বাইরে। তাই, WHO-এর ২০শে এপ্রিলের হিসাবে মাত্র ৬টি গবেষণাগার ঐ clinical trial শুরু করেছে বা করতে চলেছে (৩টি চিনা, ২টি মার্কিন ও ১টি ব্রিটিশ)।
Clinical trial কিভাবে হয়?
এর মূলতঃ তিনটি পর্যায়, এবং আগের পর্যায়ে সাফল্য পেলে তবেই ছাড়পত্র মেলে পরের পর্যায়ের-
১) প্রতিষেধকটি মানবদেহে নিরাপদ কিনা সেটি পরীক্ষা করা হয় খুবই ছোট (৩০-৮০ জন) স্বেচ্ছাসেবক দলের মধ্যে।
২) প্রতিষেধকটি মানবদেহে কতটা কার্যকরী দেখতে অপেক্ষাকৃত বড় স্বেচ্ছাসেবী দলের (কয়েক শত) সাধারণতঃ অর্ধেককে প্রতিষেধকটি দেওয়া হয় ও বাকি অর্ধেককে placebo দেওয়া হয়। কর্কট রোগের মত ঝুঁকির রোগের ক্ষেত্রে অবশ্য placebo দেওয়া যায় না। তারপর সকল স্বেচ্ছাসেবীকে রোগের সংস্পর্শে আনার চেষ্টা করা হয়, কৃত্রিম বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।
৩) এই পর্যায়ে বিভিন্ন বৈচিত্র্যে, যেমন, ভৌগলিক, আর্থ-সামাজিক, বয়স ও জাতি ভেদে প্রতিষেধকটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা স্বভাবতঃই আরও বহুগুণ হয়।
এর পরই এটি বাজারজাত করা যায়। আর এই তিনটি পর্যায় সাধারণতঃ পার করতে দেড় থেকে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগে।
অক্সফোর্ডের জেনার গবেষণাগারের প্রতিষেধক
ভাইরাস নানান ধরণের হয়। যাঁরা ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের ভিরোলজিস্ট (virologist) বলা হয়। অক্সফোর্ডের সারা গিলবার্টের গবেষক দলটি সেই সকল মুষ্ঠিমেয় ভিরোলজিস্টের মধ্যে পড়েন, যাঁরা ফ্লু (flu) জাতীয় ভাইরাস নিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করে আসছেন। ফ্লু জাতীয় ভাইরাসের বেশ কয়েকটি প্রকারভেদ আছে। ষেমন সাধারণ সর্দি-জ্বর থেকে শুরু করে সোয়াইন ফ্লু (swine flu), বার্ড ফ্লু (bard flu), মায় ইবোলা পর্যন্ত এই জাতীয় ভাইরাস। আর হ্যাঁ, এই ভাইরাস গোষ্ঠির নবতম সদস্য হল করোনা ভাইরাস। (বেশি কচকচিতে না গিয়ে বলে রাখি করোনা ভাইরাস আর ফ্লু ভাইরাস বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে মিল শুধু তারা উভয়েই RNA ভাইরাস; ঠিক ভাই-ভাই নয়।) দুঃখজনক হলেও ফ্লু ভাইরাসের বিষয়ে গবেষণা খুব বেশি জায়গায় হত না। কারণ, এ জিনিস স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্ব পেত না এইডস বা অন্যান্য ভাইরাসের কাছে। সারা গিলবার্টের মত বিজ্ঞানীরা তাই আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভীষণ মূল্যবান হয়ে উঠেছেন। সারা অনেকদিন ধরেই সর্বজনীন ফ্লু প্রতিষেধক (Universal Flu Vaccine) বানানোর চেষ্টা করছিলেন। তাঁর দল ChAdOx1 নামে অন্য একটি ফ্লু ভাইরাস থেকে একটি সম্ভাব্য প্রতিষেধক বানিয়েছিলেন কয়েক বছর আগে। সেটি ২০১০ সালেই ইবোলা ও সার্স (Severe Acute Respiratory Syndrome বা SARS) ভাইরাসের বিরূদ্ধে বিভিন্ন গবেষণাগারে পশুর শরীরে সন্তোষজনক সাফল্য পেয়েছে। এমনকি আগের পরীক্ষার সময়ই এই ওষুধটি ৩৫০জন মানুষের শরীরে clinical trial এর প্রথম পর্যায় বা phase 1 সফলভাবে করা ছিল। ফলে, অক্সফোর্ডের এই গবেষক দলটি ঐ ওষুধটির দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা এখন সরাসরি শুরু পরে দিতে পেরেছেন। এ কাজে ওঁরা ১০০০ এরও বেশি স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্য পাচ্ছেন। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী এই গবেষণায় রেসাস (rhesus macaque) বাঁদরের উপর এই প্রতিষেধক অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে।
এবার আমার নিজস্ব কিছু মতামত ভাগ করে নিতে চাই। প্রথমেই বলে রাখি আমি ভিরোলজিস্ট তো নই-ই এমনকি ডাক্তারও নই। আমি এই লেখাটার অনুপ্রেরণা পেলাম। কারণ, চারদিকে দেখছি এই প্রতিষেধক নিয়ে এক অসাধারণ আগ্রহ তদুপরি উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে। দেখছি লোকে, প্রচুর আশা নিয়ে বসে আছে যে প্রতিষেধক আর কয়েকদিনের মধ্যেই বেরিয়ে যাবে। আর সাথে সাথে গোটা বিশ্বে সেই ওষুধও খুব দ্রুত ও প্রচুল পরিমানে পাওয়া যাবে।
এই মানসিকতাটা খুবই স্বাভাবিক। আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন মন অস্থির হ্ওয়াটা স্বাভাবিক। আমরা মানুষ, শ্রেষ্ঠ প্রাণী; বাকি সকল প্রাণীর দন্ডমুন্ডের কর্তা। আজ সেই মানুষই এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর কাছে ১০ গোল খেয়ে ভয়ে কাঁপছে (কাছাকাছি উপমা হল ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের জার্মানীর কাছে ৭ গোল খাবার যন্ত্রণা।)
একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখা যাক এই প্রতিষেধকের সম্ভাবনা। আমি শুধু মাত্র আমার অন্তর্জাল ঢুঁড়ে পাওয়া বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও কিছু বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করে নিম্নোক্ত পয়েন্ট গুলি বলছি, -
# প্রথমেই যে জিনিসটা আমাদের মনে রাখতে হবে, ভাইরাসের প্রতিষেধক উদ্ভাবন, অন্যান্য যে কোনো উদ্ভাবনের মতই অসংখ্য ব্যর্থতার কাহিনী। এই clinical trial-এর যে কোনো পর্যায়ে সেই ব্যর্থতা আসতে পারে যাতে পুরো প্রক্রিয়াটাই আবার গোড়া থেকে শুরু করার প্রয়োজন হতে পারে। ফলে একটি পর্যায়ে সাফল্যের একমাত্র মানে হচ্ছে পরের পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু করা।
# আর একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে, যদি সত্যিই একটি প্রতিষেধক আমরা পেয়েও যাই সেই প্রতিষেধকের সাফল্যের হার ১০০% নাও হতে পারে। সেটাও অবশ্যই ফেলনা নয়। ভাইরাসের সাথে এই অসম যুদ্ধে বন্দুক না হোক অন্ততঃ একটা খন্তা তো পাওয়া যাবে। হাজার হোক, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।
# বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই বাকিদের এই দৌড়ে খানিকটা এগিয়ে আছে। প্রথমতঃ তাদের ChAdOx1 (উচ্চারণটা হল চ্যাডক্স১) এর প্রাথমিক উপযোগিতা অনুরূপ ভাইরাসের উপর পরীক্ষা সন্তোষজনক। দ্বিতীয়তঃ তারা আগেই clinical trial-এর প্রথম পর্যায় পাশ করেছিল বলে সরাসরি দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করতে পেরেছে।
# এটাও মনে রাখতে হবে এখনো অবধি অক্সফোর্ডের গবেষক দলটি কোনো প্রতিষেধকই বাজারজাত করতে পারেননি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, তাঁরা অনেক গবেষণা করেছেন, অনেক মূল্যবান জ্ঞান অর্জন করেছেন, কিন্তু আজ অবধি মানুষের জন্য একটি প্রতিষেধকও বাজারে পাওয়া যায় না, যেটা এঁদের আবিষ্কার। তাই এটা একটা দারুণ সুযোগ তাঁদের কাছে কিছু করে দেখানোর।
# ChAdOx1 রেসাস বানরের শরীরে সাফল্য পেয়েছে এটা সুসংবাদ। কিন্তু উল্লসিত হবার কিছু নেই। বানর আর মানুষ এক নয়।
# দেড়-দু বছরের কাজকে ৪-৫ মাসে নামানোর চেষ্টা চলছে। প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি হবে না ঠিকই। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, বাস্তববুদ্ধি অনুসারে সাফল্যের সম্ভাবনা খুবই কম। তাই অগস্ট/সেপ্টেম্বরে যদি প্রতিষেধক নাও পাওয়া যায় তাতে হতাশ হবার কিছু নেই। বিখ্যাত উদ্ভাবক টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি উদ্ভাবন করার সময়ের বিপুল প্রতিবন্ধকতার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “I have not failed. I've just found 10,000 ways that won't work.” ("আমি ব্যর্থ হইনি। আমি ১০,০০০ উপায় জেনেছি মাত্র যা কাজ করবে না।") তাই সাময়িক ভাবে ব্যর্থ হলেও ঐ ব্যর্থতালব্ধ জ্ঞান শেষ পর্যন্ত প্রতিষেধক আবিষ্কারে সাহায্য করবেই।
# আর একটা তেতো কথাও মাথায় রাখতে হবে। প্রতিষেধক বেরোলেও সেটার সহজ লভ্যতাটা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। রাতারাতি ৬০০০ কোটি মানুষের জন্য ওষুধ তৈরী করা মুখের কথা নয়। শুধু তাই নয়, এই প্রতিষেধকের দাম কত হবে কেউ জানে না। সাধারণের আয়ত্বে না হলে, আরেক সমস্যা হবে। আশা করা যায়, বিভিন্ন দেশের সরকার এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে, মানবিক কারণে যদি নাও হয়, অন্ততঃ সস্তায় জনপ্রিয়তা তো পাওয়া যাবে।
# সবশেষে বলি, মহামারী বা অতিমারী চিরকালই সমুদ্রের ঢেউয়ের মত এসেছে। প্রাচীন কালে মানুষের লড়াই করার কিছু ছিল না তাই অজস্র প্রাণ গেছে। আজকে একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের প্রভুত উন্নতি আমাদের একটা হাল্কা আশার সন্ধান দিচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতি তো আমরা জানি, মানুষ আগেও টিঁকে গেছে, আজও টিঁকে যাবে। যোগ্যতমের উদবর্তন হচ্ছে (natural selection) তাই না হয় হবে কি আর করা যাবে!
কিছু তথ্যসূত্র:-
https://www.youtube.com/watch?v=F-S_Pqt1A_I
https://www.youtube.com/watch?v=4pjvVj7N3H0
http://www.ox.ac.uk/news/2020-04-23-oxford-covid-19-vaccine-begins-human-trial-stage
https://www.who.int/blueprint/priority-diseases/key-action/novel-coronavirus-landscape-ncov.pdf
http://www.euvaccine.eu/vaccines-diseases/vaccines/stages-development