পরিচ্ছেদ-১
টানটান উত্তেজনা। বেচারা হাতিটা প্রথমে খেয়াল করেনি। যতক্ষণে খেয়াল করল; ততক্ষণে রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে একেবারে ঘাড়ের উপর এসে পড়ল।
মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র আর কোটালপুত্র রাজপুত্রের ঠিক পিছু পিছুই আসছিল। তারা রূদ্ধশ্বাসে দেখল রাজপুত্র বীর বিক্রমে তার বর্শা ছুঁড়ে দিল হাতিটার দিকে। কিন্তু চলন্ত ঘোড়ার পিঠের থেকে অপটু হাতে ছোঁড়ার জন্য বর্শাটা ডান্ডার মত গিয়ে পড়ল হাতিটার মাথায়। হাতি একটা অস্ফুটে গাঁক মত শব্দ করে সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। রাজপুত্র এত জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল যে সময় মত ঘোড়া থামাতে পারল না। হাতির গায়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। গোটা দুয়েক ডিগবাজী খেয়ে তবে থামল। কিন্তু রাজপু্ত্র একটুও না দমে, পূর্ণ উদ্দমে তলোয়ার তুলে হাতির উপর হামলা করল। এলোপাথাড়ি তরোয়াল চলতে লাগলো। নিমেষে হাতির ভবলীলা সাঙ্গ হল। ইতিমধ্যে মন্ত্রীপুত্ররা এসে পড়েছিল তারাও তাদের বিক্রম দেখালো।
খানিক পরে চার বন্ধু মিলে মাটিতে ছড়িয়ে বসে হাঁফাতে লাগলো।
প্রথম কথা বলল সেনাপতিপুত্র, "যাক একটা শিকারের মত শিকার হল। এবার আর কেউ আমাদের দুয়ো দিতে পারবে না।" কোটালপুত্র বলল, "সবই ঠিক আছে, খালি হাতিটা কোনো রকম লড়াই করল না। তাহলে ব্যাপারটা আরো জমত।" বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্রের চাউনি দেখে একেবারে গুটিয়ে গেল। মন্ত্রীপুত্র তাড়াতাড়ি অবস্থা স্বাভাবিক করতে কোটালপুত্রকে বলল,"রাজপুরীতে খবরটা দাও গিয়ে। সেখান থেকে লোকজন আসুক; হাতিটা নিয়ে যেতে হবে তো।" কোটালপুত্রও পালিয়ে বাঁচল।
রাজপুরীতে কোটালপুত্র পৌঁছাতে চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে গেল। এতক্ষণ সবাই চিন্তায় ছিল যে ছেলেগুলো গেল কোথায়। এখন চিন্তা থেকে মুক্তি পেয়ে সবাই আনন্দ করতে লাগলো। খালি রাজপুত্র হাতি শিকার করেছে শুনে রাজামশাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "আবার!!"
যাইহোক, সেপাই-সান্ত্রী লোক-লস্করের বন্দোবস্ত হল। অচিরেই চার বন্ধু তাদের শিকারসহ শোভাযাত্রা করে রাজপুরীতে হাজির হল। সক্কলে দেখে বলল, "নাহ জব্বর শিকার করেছে বটে রাজপুত্ররা! আর ওদের হেলাফেলা করা যাবে না।"
শুধু রাজামশাই আর সেনাপতি মশাই উশখুস করছিলেন। তবে আগের বারের বেইজ্জতির কথাটা মনে ছিল বলে চুপ করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। রাজমাহুত খবর পেয়েছিল রাজবাড়িতে এখন বিরাট উৎসব হচ্ছে। বেশি কিছু শোনেনি। বিনা পয়সায় খাবার দাবারের লোভে সেও এসে হাজির হল রাজদরবারে। এসে তো হাতির মাথা দেখেই সে বিকট ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, "হায় হায় মহারাজ, রাজকুমারের হাতিটাকে কে এভাবে হত্যা করল?!! এত ভাল শান্ত হাতি আর একটাও পাওয়া যাবে না!" কোটাল সাত-তাড়াতাড়ি কোনো ক্রমে রাজমাহুতের মুখ-টুখ চেপে তাকে রাজদরবার থেকে বার করে নিয়ে যাওয়ায় আর বড় রকমের গোলমাল হয়নি।
পরে আমি মাহুতের কাছ থেকে আসল খবরটা শুনি। তোমাদের বলছি কাউকে বোলো না যেন।
কয়েক মাস আগে রাজপুত্র ও তার বয়স্যদের সহবত শিক্ষাগুরু রাজার কাছে দরবার করেছিল যে, অন্ততঃ রাজপুত্রের জন্য একটা হাতির বন্দোবস্ত করা হোক। রাজকীয় আদব-কায়দার জন্য হাতির পিঠে চড়তে হবে। রাজামশাই সেদিন অন্তঃপুরে এসে রাণীমাকে যখন এই প্রস্তাব জানালেন সঙ্গে সঙ্গে রাণীমা হাঁউমাঁউ করে কেঁদে-কেটে অস্থির। সারা অন্দরমহল জানলো রাজামশাই রাণীমাকে আবার শাসন করেছেন। রাজামশাই তো প্রচন্ড অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। সেটা যতটা না রাণীমার চিন্তার জন্য; তার থেকে বোধকরি অনেক বেশি এই দাস-দাসীরা কি ভাবল সে কথা চিন্তা করে। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হল যে একটা কমবয়সি আর শান্ত-শিষ্ট, সোজা কথায় চূড়ান্ত ভিতু হাতির বন্দোবস্ত করতে হবে। অনেক খুঁজে, এরকম একটা হাতি পাওয়া গেল বটে; কিন্তু হাতির মালিক ছিল মহা সেয়ানা। সুযোগ বুঝে বহুমূল্যে বিক্রি করল সেই হাতি।
রাজমাহুত জানালো এক মাস সময় লাগবে হাতিকে রাজকীয় সহবত শেখাতে। সুতরাং, মাসখানেক পরে এক শুভদিন দেখে রাজকুমারের হাতি চড়ার শিক্ষা শুরু হল। রাজকীয় হাতি বলে কথা; তার ধড়াচূড়ার আয়োজনই বিরাট - পিঠের দু'পাশ দিয়ে লাল মখমলের ঝালর প্রায় মাটিতে লুটাচ্ছে, পিঠের উপর প্রকান্ড সেগুন কাঠের হাওদা। তার গায়ে সোনার কারুকাজ, মাথার উপর রূপার চন্দ্রাতপ। হাতির পিঠের হাওদায় রাজপুত্র সরাসরি এসে বসত রাজবাড়ির দোতালার বারান্দা থেকে। ওরই ফাঁকে হাতি রাজকুমারকে দেখেছিল ও চিনেছিল। কিন্তু রাজকুমার হাতিকে দেখে থাকলেও চিনতে পারেনি।
ফলে রাজ বাড়ির পিছনের জঙ্গলের ধারে যখন সেই হাতিটা ঘাস খাচ্ছিল তখন রাজকুমার যখন হুড়মুড়িয়ে বল্লম উঁচিয়ে তেড়ে গেল; হাতি গেল ভীষণ ভড়কে। আর সেই ভয়েই হোক বা বল্লমের বাড়ি খেয়েই হোক, ভিরমি খেয়ে মুচ্ছো গেল। এদিকে রাজকুমার চিনতে পারেনি বলেই...
*****
রাজপুত্রদের দূর দেশে গুরুকুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজগুরুও সেই সঙ্গে গিয়েছেন। রাজামশাই খুব ভালভাবে রাজগুরুকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রাজপুত্ররা বড় হয়ে দায়িত্ববান না হওয়া পর্যন্ত যেন আর এদিকে না আসে। নইলে রাজগুরুকে হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হবে।