সেই রাজপুত্র আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের তোমাদের মনে আছে তো? সেই যে চার বন্ধু, যারা সিংহ শিকার করতে গিয়ে সূর্যমুখী ফুল শিকার করে এনেছিল! সেই ঘটনার পরে রাজামশাইের কড়া নির্দেশ ছিল, আর কোনো রকম বেচাল চলবে না। এবার থেকে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে যাতে সেরকম লোক হাসানোর মত ঘটনা আর না ঘটে।
কিন্তু তোমরা তো জানো; লেখাপড়া যে তাদের একটুও ভালো লাগে না। অগত্যা আবার একদিন চার বন্ধুতে মিলে পরিকল্পনা করতে বসল এবার কি করা যায়। সবাই একবাক্যে একমত হল যে এবার একদম নিশ্চয় করে একটা সত্যিকারের শিকার করতেই হবে। গতবারের ঘটনার পর প্রাণীবিদ্যায় এখন সবাই বেশ দিগ্গজ - বাঘ, সিংহ, হাতি, হরিণ এখন আর গুলিয়ে যাবে না।
সমস্যা হল, আগের বারের দুর্ঘটনার পরে এই চারমূর্তির চলাফেরায় অনেক বাধা-নিষেধ এসেছে। এখন তারা চাইলেই চট করে বেরিয়ে পড়তে পারবে না। রাজা মশাই আর লোক হাসাতে চান না। তাই মন্ত্রীপুত্র বলল, "আমাদের গোপনে ও সাবধানে কাজ করতে হবে। না হলে প্রাসাদের বাইরেই বেরোতে পারবো না।" পরিকল্পনা অনুযায়ী এবার সবাই তরোয়াল, বর্শা আর তীর ধনুক সাথে নিয়েই বেরোবে। কারণ ওরা জানে সত্যিকারের শিকার ওদের অস্ত্র তৈরীর জন্য বসে থাকবে না। চুপিসাড়ে ও অতর্কিতে আক্রমণ করলেই একমাত্র শিকার করা সম্ভব।
যাইহোক এক দিন ভোর ভোর অস্ত্রাগার থেকে প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিজের নিজের ঘোড়া নিয়ে চার বন্ধুতে চুপি চুপি পথে বেরিয়ে পড়ল। দিনটা কাজের দিন হওয়ায় ঐ ভোরে যে কয়েকজন জেগে ছিল রাজপুরীতে তারা নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত ছিল। কেউ লক্ষ্য করল না। অচিরেই চার বন্ধুতে ঘোড়া চালিয়ে পৌঁছে গেল সেই জঙ্গলের ধারে।
জঙ্গলে ঢুকে এদিক চায় কোনো শিকার দেখা যায় না। ওদিক চায় কোনো শিকারের দেখা মেলে না। কয়েকটা কাঠবিড়ালি আর গিরগিটি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়া গেল না। শুধু শুধু হয়রানিই সার হল! আবার এদিকে সেনাপতিপু্ত্র বলল, "না ভাই, শিকারের মত শিকারই করব। সবাইকে যাতে গর্ব করে দেখাতে পারি! মারি তো গন্ডার, লুঠিতো ভান্ডার। ওসব কাঠবিড়ালি বা গিরগিটি মেরে হাত গন্ধ করতে পারলাম না।" বাকিদের মুখ-চোখ দেখে বোঝা গেল সেনাপতিপুত্র যেন সবার মনের কথাই বলল।
কিন্তু, এদিকে শিকার পাবে কি করে!? সব শিকার তো রাজামশাই নিজেই মৃগয়ায় বারবার এসে মেরে সাবাড় করে দিয়েছেন। আজকাল তিনিও আর এদিকে আসেন না। রাজপুরীর সবচেয়ে কাছের জঙ্গল হবার দরুনই এই অবস্থা। অথচ সেই খবর কুমারেরা কেউই জানত না।
এমনি ভাবে জঙ্গলের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে দেখে কি, আস্তে আস্তে বনের গাছপালা ফাঁকা হয়ে আসছে। সামনে এক বিরাট মাঠ। কোটালপুত্র বলল, "আমরা কি তেপান্তরের মাঠে এসে পড়লাম?" সেনাপতিপুত্র কটমট করে তার দিকে চেয়ে বলল,"তুই কি হাঁদা রে!! তেপান্তরের মাঠ কি আমাদের রাজ্যির ঠিক পাশে বলে তোর মনে হয়! একটা শিকারের দেখা নেই, তার মধ্যে - যত্তসব!"
সামনের মাঠটা কিন্তু সত্যিই বিশাল। বড় বড় ঘাসে ঢাকা। ঘাস এতো বড়, যে ঘোড়ায় চড়া সত্বেও ওদের মাথা আর কাঁধের কিছু অংশই ঘাসের ওপরে ছিল। ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেই চিত্তির। পুরো ঘাসের জঙ্গলে ঢাকা পড়ে যাবে। সবাই ঘোড়ায় চড়ে বেশ কিছুটা যাবার পরে মন্ত্রীপুত্র বলল, "দূরে ওটা কি দেখা যায়।" সেনাপতিপুত্র বলল, "আরে এতো একটা হাতি!" একথা শুনে সবাই ভীষণ উত্তেজিত। সারাদিনের ঘোরাঘুরি এবার হয়ত সার্থক হবে। রাজপুত্র সাবধানী গলায় বলল, "ঠিক দেখেছ?" কোটালপুত্রের এদের মধ্যে সবচে্যে তীক্ষ্ণ নজর। একটু ভাল করে দেখে সোল্লাসে বলল, "একদম ঠিক। এ একটা হাতিই-ই! তবে একটু ছোট মনে হচ্ছে না?"
"কি যে বল দূর থেকে কোনো জিনিস ছোটোই লাগে।" রাজপুত্রের আগ্রহ এই সব ছেঁদো কথায় আর বাঁধা যাবে না। ব্যস আর কোনো দ্বিধা নেই। এটা হাতি এবং জ্যান্ত, ঘাস না কি যেন খাচ্ছে।
রাজপুত্রের চোখ চক্ চক্ করে উঠল। "ভাই সব, আমি-ই এই হাতিটা শিকার করব। তোমরা কেউ এর মধ্যে আসবে না। আগের বারের অপমানের শোধ আমায় তুলতেই হবে। বলে আমি কিনা কল্পনাপ্রবণ!!" সবাই বুঝল এখন আর রাজপুত্রকে রোখা যাবে না। তাই সবাই মিলে রাজপুত্রকে সাহস দিতে লাগল। হাজার হোক, হাতি তো আর ছোট্ট চড়ুই পাখি নয়! মন্ত্রীপুত্র বলল, " ঠিক আছে। তুমিই শিকার করবে। কিন্তু আগে আমাদের একটা পরিকল্পনা করে নিতে হবে।"
"কিসের কল্পনা?" - কোটালপুত্র একটু দূরে থাকায় মন্ত্রীপুত্রের কথা ঠিক শুনতে পায়নি। রাজপুত্র অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি হানে তার দিকে। সেনাপতিপুত্র বলে, "বোঝো ঠ্যালা, এরকম কানে খাটো লোক নিয়ে, আমরা চলেছি লম্বকর্ণের শিকারে। ওরে হতভাগা তোর যেটা কল্পনা মনে হল; আমাদের কাছে সেটা পরিকল্পনা, মন্ত্রণা, সলা-পরামর্শ, আলোচনা, ইত্যাদি।"
মন্ত্রীপুত্র বলল, "তোমরা শান্ত হবে একটু?!!"
সবাই চুপ করলে পর মন্ত্রীপুত্র বলল, "এটা সবচেয়ে বড় প্রাণী। সামান্য তীর ধনুকে কিস্যু হবে না। বর্শা ব্যবহার করতে হবে। তাও সেটা ঠিক ঠাক মারতে পারলেই একমাত্র কাজ হবে। তারপর হাতি কাবু হলে তখন তলোয়ার নিয়ে আক্রমণ করা যাবে। কুমার তুমি বলছো একাই মারবে; আমার মনে হয় সেটা বোকামি হবে। হাতি বিরাট প্রাণী। একা চেষ্টা করলে... " কথা শেয না করতে দিয়ে রাজপুত্র ঝাঁজিয়ে উঠলো, "আমি একাই মারবো হাতি! তাতে যদি আমার বিপদের সম্ভাবনার কথা বলে তুমি ভয় দেখাও; তাতেও আমি ডরাই না। এই তলোয়ারের এক কোপে যদি না ওর ভবলীলা সাঙ্গ করেছি তো আমার নাম বদলে দিও তোমরা!!" এ কথার পর আর কোনো কথা থাকতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ঠিক হল যে, রাজপুত্রের কোনো সমস্যা দেখলে বাকিরা বর্শা নিয়ে যুগপত আক্রমণ করবে। এই বার সবাই গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল, যতটা সম্ভব হাতিটার কাছাকাছি যাওয়া যায়। ঘোড়া থেকে নেমে পড়েছে সবাই।
রাজপুত্র আগে আগে; বাকি সব পিছনে পিছনে। কিছুটা যাবার পর দেখা গেল ঘাসের বন পাতলা হয়ে আসছে। আর আড়াল থাকে না। রাজপুত্র থামলেন, "আর তো আড়াল থাকছে না; আমি ঘোড়ায় চেপে ঝটিকা আক্রমণে যাই। তাতে হাতিটা যদি থতমত খেয়ে যায় তো সেই সুযোগে আঘাত হানা যাবে।" পাকা যুক্তি। সেই মত রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে বসলেন। তিন বন্ধু শিরদাঁড়া টান করে তৈরি হয়ে নিল। চরম মুহুর্ত এসে গেছে।
রাজপুত্র জোরে শ্বাস টেনে এক পলকের জন্য চোখ বুজে মায়ের চরণদুটি স্মরণ করে নিল। তারপর, হা, রে, রে, রে, করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল হাতিটাকে লক্ষ্য করে।
শেষ পরিচ্ছেদ
১. ০১ লা নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:১১ ১