পরিচ্ছেদ ১
পরিচ্ছেদ ২
পরিচ্ছেদ ৩
মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র, কোটালপুত্র এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। রাজপুত্র বলে কথা! সিংহের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠা খুব একটা সাধারণ ব্যপার তো নয়!! কি করে বসে কে জানে?
আড়ামোড়া ভাঙতে গিয়ে রাজপুত্র বোধকরি একটু বেশি শব্দ করেই হাই তুলেছিল, সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীপুত্র হাঁ হাঁ করে উঠে মুখে আঙুল রেখে ইশারায় চুপ করতে বলল। রাজপুত্র থতমত খেয়ে গেল। অবিশ্যি তার সামলে উঠতে বেশি সময় লাগল না। তার মনে পড়ে গেল তারা রাজপ্রাসাদে নেই। জঙ্গলে শিকার করতে একা একা এসেছে। আরও মনে পড়ল সামনে সিংহ দেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আবার ঘুমিয়ে পড়বে কিনা ভাবতে ভাবতেই মন্ত্রীপুত্র বলল, "কুমার, এই আপনার ধনুর্বাণ। সিংহ শিকারের সম্মান আপনারই পাওয়া উচিত। মাত্র তিনটি তীরই আমরা বানিয়ে উঠতে পেরেছি। তাই আপনার জন্য রেখে দিয়েছিলাম।"
রাজপুত্র সবই বুঝল। মনে মনে ভাবল, "কি সব বন্ধু জুটেছে আমার! গাছে তুলে মই কেড়ে নিতে চায়? আমার জন্য নাকি তীর রেখে দিয়েছে! যত্তসব!! প্রত্যেকের হাতে ধনুক দেখতে পাচ্ছি। সবাই চেষ্টা করে পারেনি, তাই এখন আমাকে এ সব বলে ভোলাচ্ছে।"
রাজপুত্র আরও ভেবে দেখল যে এখন তার শাঁখের করাতের মত অবস্থা। তীর না ছুঁড়লে একদিকে যেমন সবাই ভিতু বলবে; অন্যদিকে তীর ছুঁড়েও যদি সিংহ না মরে তাহলেও সবাই মনে মনে হাসবে। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিল তীর ছোঁড়াটাই ভাল। যদি তাতে সিংহটা মরে তো কোনো কথাই নেই, আর যদি ব্যর্থতাও আসে, তাহলেও কেউ সামনা-সামনি কিছু বলতে পারবে না কারণ ওরাও পারে নি।
যেই ভাবা সেই কাজ। রাজপুত্র খুব সাবধানে লক্ষ্যস্থির করে তীর ছুঁড়ল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা সিংহের মাথার বাদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। আবার তীর ছোঁড়া হল, এবার তীর অল্পের জন্য সিংহের মাথার ডানদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। সর্বশেষ তীর। টানটান উত্তেজনা। সবার মনেই কি হয় কি হয় ভাব। মন্ত্রীপুত্র তো চোখই বন্দ্ধ করে ফেলল।
ধনুকের টংকার শব্দের প্রায় সাথে সাথেই নিকটে একটা আওয়াজ পাওয়া গেল - ঝুপুস!
মন্ত্রীপুত্র তাকিয়ে দেখে সিংহটকে তো আর ঝোপের আড়ালে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না! বাকিদের দিকে তাকিয়ে দেখল সবার মুখেই অনাবিল উত্তেজনা। রাজপুত্র লক্ষ্যভেদ করেছে!!! রাজপুত্র এটা বুঝতে পেরেই সিংহ যেখানে ছিল সেই ঝোপের দিকে ঘোড়া ছোটাল। একটু পরেই রাজপুত্র ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য।
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর... ঝোপের আড়াল থেকে প্রথমে সিংহের মাথা ও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজপুত্রকে দেখা গেল। রাজপুত্র সিংহের মাথা হাতে করে দোলাতে দোলাতে ঝোপ থেকে বিজয়গর্বে বেরিয়ে এল।
তিন বন্ধুতে ছুট্টে গিয়ে হৈ হৈ জুড়ে দিল। মন্ত্রীপুত্র বলে, "কুমারের কি অসাধারণ টিপ। আমি আগেই জানতাম।" সেনাপতি পুত্র বলল,"কি চমৎকার টিপ, এই না হলে রাজপুত্র!" কোটালপুত্র বলল, "সিংহের মাথা হাতে দোলাচ্ছে কি সহজে! যেন ফুলের মত হালকা!" সবাই আনন্দে গদগদ।
বিকেলও হয়ে এসেছিল। তাই চার বন্ধুতেই ফেরার পথ ধরল।
* * *
রাজপুরীর বারদুয়ারির কাছাকাছি পৌঁছাতেই প্রহরী রাজবাড়ির অন্তঃপুরে খবর পৌঁছে দিল। এদিকে রাজবাড়ির অন্তঃপুরে তো হুলুস্থুল কান্ড সারাদিন রাজকুমারের কোনো খবর নেই। রাণিমা দুপুরের পর থেকে আর কিছু খাননি। রাজা মশাই দুপুর থেকে দরবারে ঠায় বসে। সঙ্গে মন্ত্রীমশাই, সেনাপতি ও কোটাল। চার দিকে পাইক, বরকন্দাজ, গুপ্তচর ইত্যাদি পাঠানো হয়েছে। কোনো খবর আসেনি। ইতিমধ্যে দ্বারী এসে খবর দিল, "মহারাজ রাজপুত্র ও তাঁর বন্ধুরা ঘোড়ায় চড়ে আসছেন।" শুনেই কোটাল বলল, "আসুক ব্যাটা আজকে! এই বল্লমের লাঠি যদি আজ আমার ছেলের পিঠে না ভেঙেছি তো আমার নাম নেই।" সেনাপতিও বলে উঠল, "কালকেই আমি ছেলেকে সেনাবাহিনীতে ঢুকিয়ে নিচ্ছি। তারপর তিন মাসের প্রশিক্ষণ হবে ভুষন্ডীর মাঠে। তখন বোঝা যাবে কত বড় তালেবর হয়েছে ছেলে।" রাজা মশাই কিছু না বলে রাগে গুম মেরে বসে রইলেন। মন্ত্রী বললেন, "এখন মাথা গরম করার সময় নয়। বরং বুঝিয়ে বলাই ভালো। হাজারহোক ছেলেরা এখন বড় হচ্ছে। কি করতে কি করে বসে, ঠিক কি?"
দ্বারী দ্বিতীয়বার ফিরে এল, "মহারাজ, খবর এসেছে কুমার মৃগয়ায় গেছিলেন। সিংহ শিকার করে সিংহের মাথা নিয়ে ফিরেছেন।"
মুহূর্তের মধ্যে দরবারের সবাই দারুণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। রাজা আদেশ করলেন,"অন্তঃপুরে খবর পাঠাও রাজকুমারকে বীরের অভ্যর্থনা দিতে হবে।" কোটাল বলল,"নাঃ ছোঁড়াটার সাহস আছে!" সেনাপতি বলল,"জাত চেনাচ্ছে, বুঝলে হে!" মন্ত্রী বলল, "গোটা সিংহ না এনে শুধু মাথা আনতে গেল কেন!" রাজা মন্ত্রীর দিকে করুণার চোখে চাইলেন কিছু বললেন না। ভাবখানা এই যে কি হবে এই অর্বাচিনের মত প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে।
যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ কুমার সদলে দরবার কক্ষে প্রবেশ করল। অনেক হৈ চৈয়ের মধ্যে দিয়ে বীর বরণও সাঙ্গ হল একসময়। সবাই যে যার জায়গায় গুছিয়ে বসেছে। এইবার সবার মধ্যে উশখুশ, সিংহের মাথাটা দেখতে হবে তো নাকি?! কে প্রসঙ্গটা তুলবে তাই নিয়ে হল সমস্যা। শেষ পর্যন্ত রাজাই সমাধান করলেন, "কুমার তোমার বীর কীর্তি কোথায়?" রাজকুমার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,"মানে?" মন্ত্রী অপ্রতিভ স্বরে বললেন,"মানে ঐ সিংহের মাথাটা..." মন্ত্রীপুত্র ভীষণ অসন্তুষ্ট স্বরে বলল,"বাবা!! তুমি কি দেখতে পারছ না? নাকি অবিশ্বাস করছ?"
গোটা রাজসভা যখন অস্থির হয়ে উঠেছে, ঠিক সেই সময় রাজপুত্র নিজের হাতে ধরা মাথাটা তুলে ধরে সবাইকে বলল, "এই সেই সিংহের মাথা।"
একটা পালক পড়লেও বোধহয় বিকট আওয়াজ হত। রাজসভা বিশ্ময়ে হতবাক! বলে কি রাজকুমার!! মশকরা করছে কি?!! কৈ নাতো, মুখ-চোখ দেখে তো তা মনে হচ্ছে না!
মন্ত্রীমশাই হাসি চাপতে না পেরে একটু কেশে উঠলেন। ব্যস, যেন বারুদে আগুন পড়ল। সভাস্থ সমস্ত পাত্র-মিত্র-অমাত্য বিকট শব্দে হাসতে শুরু করল।
এরপর আর কি, রাজপুত্রদের শিক্ষাগুরুর মাথা মুড়িয়ে, ঘোল ঢেলে, উল্টো গাধার পিঠে চাপিয়ে রাজ্য থেকে দূর করে দেওয়া হল। রাজামশাই ছেলেদের জন্য নতুন গুরুর সন্ধান শুরু করলেন। শর্ত একটাই সে যেন প্রাণীবিজ্ঞানে দিগ্গজ হয়।
তোমাদের চুপিচুপি বলে রাখি আসল কথাটা। রাজকুমারেরা সিংহ ভেবে একটা বড় সূর্যমুখী ফুল শিকার করেছিল।
আমার কথাটি ফুরালো
নটে গাছটি মুড়ালো...