অনেক অনেক দিন আগের কথা, এক রাজ্যের রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, সেনাপতিপুত্র ও কোটালপুত্র সমবয়সী ছিল। তারা ছোট্ট থেকেই একসাথে বড় হয়েছে। এখন তারা মধ্য কৈশোরে। একদিন সন্ধ্যায় রাজবাড়ীর পিছনে,পদ্মদিঘির পাড়ে বসে চার বন্ধুতে গল্প করছিল। রাজপুত্র বলল, "নাঃ জীবনটা বড্ড একঘেয়ে হয়ে পড়ছে! সেই সকাল থেকে উঠে গুরুমশায়ের কাছে পড়তে বসা, তারপর শরীরচর্চা, তারপর স্নান করে খাওয়া-দাওয়া, ইত্যাদি, ইত্যাদি। নতুন কিছুই করার নেই।" সেই শুনে বাকি তিনজনই দুঃখের সাথে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। এদের মধ্যে মণ্ত্রীপুত্রের মাথা বেশ পরিষ্কার। একটু ভেবে বলল,"চল না, সবাই মিলে শিকারে যাই। বেশ বড়দের মত কাজ হবে। আমি বাবার কাছে শুনেছি; তিনি যখন রাজামশায়ের সাথে শিকারে যান, খুব মজা হয়! রোজ চড়ুইভাতি! তাছাড়া কত কি শিকার হয়। কিরে সেনাপতিপুত্র - গেল বার আমার বাবা যখন বাঘটা একাই তরোয়ালের এক কোপে মারল তখন তোর বাবাও তো ছিল। তোর কাছে গল্প করেনি?"
সেনাপতিপুত্র পড়ে গেল অস্বস্তিতে। তার বাবা, দেশের সেরা বীর, উপস্থিত থাকতে বাঘ মেরেছে একজন কূটনীতিক!!! এটা হজম করা বেশ কষ্টকর। তাকে বিব্রত দেখে কোটালপুত্র তাড়াতাড়ি বলে উঠল, "আচ্ছা, তোমরা কি বাঘ শিকারের পরিকল্পনায় আছো? তাহলে খেয়াল রেখো আমাদের এখনো অস্ত্রশিক্ষা শেষ হয়নি। গুরুদেব অনুমতি দেবেন না। সর্বোপরি আমাদের নিজস্ব কোনো অস্ত্র বহন করার অধিকার নেই।" মন্ত্রীপুত্র বাকিদের দিকে চোখ ঠেরে বলল,"ধুর... গুরুদেবের অনুমতির কি আমরা তোয়াক্কা করি ?! নাকি অস্ত্র যোগাড় করা কোনো ব্যাপার হল ? আরে ভুলে যাস না; আমরা রাজপুত্রের সাথে আছি। কোনো রামা-শ্যামা নয়।
রাজপুত্রও সাথে সাথে সায় দিয়ে বলল, "আলবৎ।"
সব ঠিক হয়ে গেল, পরের দিন সক্কাল সক্কাল চারবন্ধু নিজের নিজের বাবার তরোয়াল কোমরে এঁটে; বাবারই ঘোড়ায় চেপে, বেরিয়ে পড়ল জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। দিনটা ছিল রবিবার তাই খেলাধুলার দিন। কেউ খেয়াল করল না।
চার বন্ধুতে গল্প করতে করতে অচিরেই বনের ধারে এসে উপস্থিত হল। কোটালপুত্র বলল, "বাবার তরোয়ালটা বেশ ভারী কিন্তু! বাঘ এলে এটা তোলার আগেই তো আমাদের খেয়ে ফেলবে!" এই শুনে বাকি বন্ধুরা এমনভাবে ওর দিকে তাকালো যেন ওর মত ভিতু আর দুর্বল আর কেউ হয় না।
তোমাদের চুপি চুপি বলে রাখি আসলে সবাই-ই বেশ ভয় পেয়েছিল। কিন্তু মুখে কেউ স্বীকার করছিল না, এই যা। আর এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয় পেয়েছিল রাজপুত্র আর তাই আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল স্বাভাবিক থাকার।
যাই হোক, চারবন্ধুতে মিলে ঢুকে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। কিছুটা যাবার পরই বড় বড় গাছগুলো যেন ওদের চারদিকে ঘনিয়ে এল। গহীন বন। আলো আঁধারিতে চারদিক আবছায়া। কোত্থাও কোনো জন্তু বা পাখির দেখা নেই, কোনো আওয়াজ নেই। মাঝে মাঝে কোথা থেকে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ফলে গাছের পাতায় শর্-শর্ শব্দ। বেশ গা ছমছম পরিবেশ।
চলতে চলতে হঠাৎ সামনে কিছুটা খোলা জায়গার পর বেশ ঘন ঝোপঝাড় ছিল। সেই ঝোপের মধ্যে দেখে কি - একটা বিরাট সিংহ গলা বার করে ডাইনে-বাঁয়ে মাথা দোলাচ্ছে। মুখটা কালো আর চারদিকে হলুদ কেশর ফুলে ফুলে আছে। চারজনেই শিউরে উঠল, আগে সিংহ না দেখলেও - ঠিক যেমনটি ছবির বইয়ে দেখেছে, তেমনটি!
থমকে দাঁড়ালো সবাই। ভয় সবাই পেয়েছে, তবে রাজপুত্র একটু বেশি ভয় পেয়েছে। সবাই কিছুটা ধাতস্থ হলে পর মন্ত্রীপুত্র আড়চোখে তাকালো রাজপুত্রর দিকে। দেখে কি, সে ঘোড়ার পিঠে বসে, কিন্ত চোখ দুটো বন্ধ! রাজপুত্র ভয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে!! কি আর করা, মন্ত্রীপুত্র ইশারায় বাকিদেরকে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তে বলল।
এবার চিন্তা, কি করে সিংহটাকে মারা যায়। তরোয়াল নিয়ে তো মারতে যাওয়া দারুণ বোকামো। মন্ত্রীপুত্র বলল, "তীর-ধনুকই সেরা অস্ত্র হবে। কি বল তোমরা?" সেনাপতিপুত্র বলল, "ঠিক।" কোটালপুত্রও বলল, "ঠিক।" এখন কথা হল, তীর-ধনুক পাওয়া যায় কোথায়? রাজধানী ছেড়ে আসার সময় তো একথাটা কারো মনে ছিল না! এখন উপায়? সেনাপতিপুত্রই উপায় বলল, "চলো কিছু মোটা দেখে গাছের ডাল ভেঙে নিই। তারপর কিছু ছোট কিন্তু সোজা কাঠিও গাছ থেকে ভাঙতে হবে।"
(পরিচ্ছেদ ২)