তবে বোবা প্রাণিদের জন্য নিরাপদ আশ্রম হলেও বাকশক্তিসম্পন্ন মানুষ নামক ম্যামেলিয়া পরিবারের দ্বিপদী জন্তুটির জন্য এ ক্যাম্পাস চরম বৈরী। মনে আছে, হলে আমার জানালার পাশে প্রায়ই একজোড়া সাদা রংয়ের খরগোশ আসত। দুপুর ২ টা থেকে ৪ টা এরকম সময়ে। কুটকুট করে কচি ঘাস খেয়ে আবার পলায়ন! খালি পেলেই ডাইনিং এর চেয়ার, টেবিল, টিভি রুম, পেপার রুমে শালিক পাখির জমজমাট আড্ডা! বিস্ঠার অত্যাচার স্বত্তেও ওদেরকে কেউ কিছু বলতনা।
ফেলনা শুধু মানুষ!
আমরা ভর্তি হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালের কোন একদিন সা-কা চৌধুরী ছাত্রদলের প্রোগ্রামে অতিথি হয়ে আসেন। যথারীতি ছাত্রলীগ ও বামদল গুলো তা 'প্রতিহত' করতে মাঠে নামে। সন্ধ্যা নামার ঠিক আগে আগে অজ্ঞাতকারণে বিষয়টা লীগ-শিবির মারামারিতে গড়ায়। শিবির ১নং গেটের কাছে কটেজগুলোতে হামলা করে। গুলিতে মারা যায় আমিনুল ইসলাম বকুল (গণিত, ১ম বর্ষ)। ফলাফল- অনির্দিস্ট কাল বন্ধ, হলত্যাগ। ডিসেম্বরের শেষে আবার ক্যাম্পাস চালু হয়। ক্ষমতায় লীগ থাকলেও হলে তারা সেভাবে পজিশন নিতে পারেনি। তাই ফোঁসফাঁস চলছিল ভেতরে ভেতরে। এদিকে শিবিরেরও 'ছেড়ে দিব নাহি সুচাগ্র মেদিনী...' অবস্থান। এপ্রিল ১৯৯৮ র কোন এক প্রহরে শাটল ট্রেন, ট্রাক ভর্তি করে ২-৩ শ ভাড়া করা সন্ত্রাসী নিয়ে ক্যাম্পাস আক্রমন করে ছাত্রলীগ। অতর্কিত এ হামলায় কেউ মারা না গেলেও শিবির ভালো রকম মার খায়। তাদের সেক্রেটারী সহ অনেকেই মারাত্মক জখম হয়। বিতাড়িত হয় শাহজালাল ও শাহআমানত হল থেকে। পরদিন থেকেই এ ২টি হল, ১নং গেট তথা রেলস্টশন ও সংলগ্ন এলাকা এবং কটেজগুলো সহ সমগ্র দক্ষিন ক্যাম্পাস হয়ে যায় 'লীগের এলাকা।' আর সোহরাওয়ার্দী হলের পাশ্বস্থ খাল থেকে এফরহমান, আলাওল হল, ল'ফ্যাকাল্টি, রব হল, ২নং গেট তথা উত্তর ক্যাম্পাস হয়ে যায় 'শিবিরের এলাকা।' সাইন্স, আর্টস, লাইব্রেরী ও রেজিস্টার ভবন 'সবার' এলাকা। তবে এ এলাকার কর্মতৎপরতা সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২ টা। তারপর পদার্থ বা রসায়নের 'ব্যবহারিকে'র চিপায় না পড়লে কেউ ওখানে থাকত না। এ এলাকাতেও ইন্টারেস্টিং একটা সীমানা ছিল। শিবিরের 'টহল' মূলত: রেজিস্টার বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠ আর লীগের টহল ঝুপড়ি, চাকসু ক্যাফেটিরিয়া। শামসুন্নাহার, প্রীতিলতা হল এলাকা সংগত কারণেই ছাত্রলীগ অধ্যুষিত। ক্যাম্পাসের বাইরে ষোলশহর রেলস্টেশন এবং শাটল ট্রেনও ছিল লীগের দখলে। কিছু মাইনর চেন্জ ছাড়া ২০০১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত টানা সাড়ে ৩ বছর এ সীমানা নীতিমালা চবিতে বহাল ছিল!
১৯৯৮-২০০০। শিবির অবরোধ ডাকে। অবরোধ লংঘন করে ক্যাম্পাসের শিক্ষক বাস শহরে যাবার পথে শিবিরের বোমা বা গুলির শিকার হয়। মারা যায় অধ্যাপক নুরুন্নবীর ছেলে মুশফিক (চমেক ছাত্র)। শাহআমানত হলে নিহত হয় জনৈক বহিরাগত যুবক আইয়ুব আলী (ধারনা করা হয় সে ছাত্রলীগের হয়ে হল দখল বজায় রাখতে এখানে আসে)। ছাত্রলীগের বেপরোয়া গুলিবর্ষনে নিহত হয় শিবিরের রহিম (জুলজি) ও মাহমুদ (ইংরেজী)। এর আগে বা পরে অপহরনের পর খুন করা হয় শিবিরের জুবায়ের (অর্থনীতি)কে। ক্যাম্পাসের বাইরে বটতলী রেলস্টেশনে ছাত্রলীগ শাটল ট্রেনের বডিতে মাথা থেতঁলিয়ে শিবির সন্দেহে হত্যা করে ছাত্রইউনিয়নের সন্জয় তলাপাত্রকে (চারুকলা)। এছাড়াও চবি সংক্রান্ত ঘটনায় ছাত্রলীগের জনৈক ঠিকাদার খুন হয় নিকটস্থ মদনহাটে।
৪-বছর মেয়াদী স্নাতক কোর্স পাশ করতে করতে আমাদের চেনাজানা পরিমন্ডলে খুন হয় ৮ জন মানুষ! কি তুচ্ছ এক প্রাণি ছিলাম আমরা!! জানামতে মামলা হয়েছে অনেক। কিন্তু কোন ক্রিমিনালের ১ দিনের জেলও হয়নি। ইনফ্যাক্ট মামলাগুলো অতদুর গড়াওনি হয়তবা!
সময় থেমে থাকেনি। সতীর্থদের লাশের উপর পা মাড়িয়ে আমাদের ডিগ্রী অর্জন, চাকুরী, প্রমোশন সবই হয়েছে। ছাত্রশিবির, ছাত্রলীগ, সাদা বা হলুদ শিক্ষক, ভিসি, প্রোভিসি, প্রক্টর সবারই জীবন এগিয়ে গেছে যার যার তালে। শুধু অপেক্ষায় অপেক্ষায় সেসব মা'দের চোখ ধূসর হয়ে গিয়েছে- যার বুকের ধন এতকাল পরও স্নাতক হতে পারেনি। সেসব বাবা যারা হয়ত: আত্নভোলা মনে এখনো কৌতুহলী হন- আচ্ছা এতদিন ধরে খোকা টাকা চেয়ে পত্র পাঠায়না কেন?
বি:দ্র: গতকালও চবিতে ২জন ছাত্র নিহত হয়েছে।