ড. সুবোধ অনেকক্ষণ ধরে মৃত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছেন।তার মাথার মাঝে কেমন যেন একটা ভয়ংকর চিরচিরে ব্যাথা উকি দিয়ে গেলো।বহুক্ষণ ধরে আনমনা হয়ে উনি মেয়েটার চোখ দেখছেন যে চোখে কোন ভয় নেই, কোন বাচার আকুতি নেই। হঠাৎ করে কেউ যদি মেয়েটাকে দেখে তাহলে অবশ্যই সে ধাক্কা খাবে।ধাক্কা খাওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করছি।মেয়েটার সারা মুখমন্ডলে কোথাও মৃত্যুর ছাপ নেই, বরং মনে হচ্ছে সে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে কোন এক সসীম মায়াবী প্রান্তরে।কিন্তু তবুও কি যেন একটা আছে, ভয়ংকর কিছু যা বাধ্য করে আমাদের বুঝতে যে মেয়েটা মৃত।সুবোধবাবু অসম্ভব বিস্মিত হলেন মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে।অতিরিক্ত বিস্মিত হলে মানুষের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে এটা কি পাঠক জানেন?
সুবোধবাবু বহু চিন্তা করেও বুঝতে পারছেন না এত রাতে তার বাড়ির আঙ্গিনায় এভাবে একটা মৃত মেয়ে পড়ে আছে কেন?লাশটা এলোই বা কোথা থেকে?২৫শে আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষ রাত, কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আকাশে অনেক অনেক তারা।কেন যেন তার মনে হচ্ছে আকাশটা লাল হয়ে আছে।এর মাঝে এভাবে একটা মৃত তরুনী মেয়ের লাশ যে কারো বুকে কাপন ধরিয়ে দিতে যথেষ্ট।সুবোধবাবু তার কেরানী আসলাম আলীকে চিৎকার করে ডাক দিলেন।কিন্তু গলা থেকে একটা ধাতব জন্তুর মত কন্ঠ বের হয়ে এলো।আসলাম আলী যে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তা অধ্যাপর সাহেব দেখেননি বোধ করি।আসলাম আলী কঠিন স্বরে বললো, “জ্বী স্যার”?
সুবোধবাবু আরেকটি ধাক্কা খেলেন, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “আসলাম লাশটি কিভাবে এখানে এলো”?
আসলাম মিনমিন করে বললো, “স্যার আমি জানিনা।লাশটা কি ফেলে দিয়ে আসবো পাশের পুকুরে?শুধু শুধু ঝামেলা নিবেন না কাধে।মানুষজন পরে কটু কথা বলবে।ওই দেখেন মেয়ের শাড়ির অনেকটা কিন্তু ছেড়া।ছি ছি”!
সুবোধ বাবু মাথা নেড়ে শান্ত স্বরে বললেন, “যাও মাওলানা সাহেবকে ডেকে নিয়ে আসো।রহমত সাহেবকে খবর দাও।করুণাময় এই তরুনীর আত্নাকে শান্তি দিক”।
আসলাম তার মুখের খোচা খোচা দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে হেটে চলে গেলো।এতো রাতে মাওলানা সাহেবের বাসায় যাওয়াটা একটু ঝামেলার।গহীন বনের মধ্য দিয়ে হেটে যেতে হয় পুরো রাস্তা।সে বুঝে পায়না এতো জায়গা থাকতে ঈমাম সাহেব কেন এমন গহীন অরণ্যে থাকে।মনে মনে সে ঈমাম সাহেবকে দুটো গালি দিলো।
রহমত সাহেব সদরে থাকে, সে এই গ্রামের বিশিষ্ট মুরুব্বী।কোন রকম সমস্যা হলেই তাকে জানানো হয়।রহমত সাহেবের একটাই বদ অভ্যাস।প্রতি বছরে এক বিশেষ দিনে উনি ভয়ংকর মদ্যপান করেন এবং চিৎকার করে বলেন, “ওরে মনে লীলাখেলা চলেরে, বাদ্য কাহা হ্যায়”! বেশ কয়েকটি বিয়েও করেছেন তিনি।আশ্চর্য্য ব্যাপার হলো তার সব বউদের মাঝে অস্বাভাবিক মিল মহব্বত আছে।আসলাম আলীর ছোট মাথায় এই ব্যাপারটা আসেনা।সে নিজের একটা বউই ঠিকমত চালাতে পারেনা, এই বদমাইশ ব্যাটা এতোগুলা বউ একসাথে ফিট করে রাখলো কি করে?
নীলচে ভোরের আলো সুবোধ বাবুর আঙ্গিনায় যখন দুষ্টু খেলায় মগ্ন তখন রহমত আলী সহ গ্রামের আরো কিছু মুরুব্বী গভীর চিন্তায় পড়ে আছে।মাওলানা সাহেব হঠাৎ করে সবার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বললেন, “আমি জানাজা পড়ায় দিতে চাই দ্রুত।বেগানা মহিলার লাশ এভাবে এতক্ষণ ফালায় রাখা ঠিক না”।
রহমত আলী হাসিমুখে বললেন, “ওহে মূর্খ মাওলানা এইটা যে মুসলমানের লাশ কেডায় কয়েছে”?
সুবোধবাবু নিজে থেকে এবার বললেন, “মেয়েটার গলায় একটা তাবিজ আছে।তাছাড়া হিন্দু ধর্মের হলে শাখা থাকতো হাতে।এই বয়সের একটা মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ারও কথা ছিলো।কিন্তু মেয়েটার মাথায় কোন সিদুর নেই।আপনারা অনুগ্রহপূর্বক মেয়েটাকে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।এভাবে তাকে অপমান করবেন না আর”।
মাওলানা সাহেব একঘন্টার মাঝে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করে ফেললেন।কবর দিয়ে যখন সুবোধবাবুর কাছে ফিরে এলেন তখন অধ্যাপক সাহেব একটা বিশাল বই নিয়ে পড়ছেন।হালকা কাশি দিয়ে ঈমাম সাহেব ঘরে ঢুকলেন। সুবোধবাবু তখন নিবিড় মনোযোগ দিয়ে জীবনতত্ত্ব নিয়ে একটা বই পড়ছিলেন।ঈমাম সাহেব মৃদু হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এত বইপত্র কি পড়েন”?
সুবোধবাবু বই হাতে নিয়েই বললেন, “আমি পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছি।কিন্তু আজকাল প্রাণ রহস্য নিয়ে পড়াশোনা করেও বেশ আগ্রহ পাই।হাতে যে বইটা তা হলো ডারউইনের বিবর্তনবাদ।মানব জাতির বিবর্তন ও প্রাণতত্ত্ব নিয়ে বইটায় খুব চমৎকার আলোচনা আছে।আপনি চাইলে একদিন বইটার সারসংক্ষেপ আপনাকে শুনাবো”।
ঈমাম সাহেব আত্নতুষ্টি নিয়ে সুবোধবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জনাব।আপনার থেকে জ্ঞানের অনেক আলো পাই বলেই বারবার ছুটে আসি।সেদিন আমাকে আপনি নিউটন সাহেবের কি যেন সূত্র বুঝিয়েছেন তা আমি আমার মক্তবের ছেলেপেলেকে বুঝিয়ে বললাম।মনে খুব শান্তি পেয়েছি।এখন একটা খোয়াইশ নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম”।
সুবোধ বাবু ভ্রু কুঞ্চিত করে ঈমাম সাহেবকে বললেন, “বলে ফেলুনতো কি উপকার হয় আপনার আমার দ্বারা”।
ঈমাম সাহেব মাথার টুপি খুলে ফু দিয়ে ঝেড়ে বললেন, “আমার বাসায় একদিন আপনাকে নিয়ে যেতে চাই।আপনাকে নিজ হাতে কিছু রান্না করে খাওয়ানোর বাসনা বহুদিনের।কিন্তু বলি বলি করেও বলা হয়নি।আমার দাওয়াত কবুল করলে অশেষ মেহেরবাণী হবে”।
সুবোধবাবু হাসিমুখে বললেন “অবশ্যি যাবো, আমি যতদূর জানি আপনার রান্নার হাত অনেক ভালো।সবাই বেশ প্রশংসা করে।যেদিন বলবেন সেদিনই যাবো”।
গভীর রাতে সুবোধবাবু যখন ঘুমিয়ে পরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ঠিক সে সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো।কালরাতের মৃত মেয়েটা সুবোধ বাবুর পড়ার টেবিলের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সুবোধ বাবু প্রথমে দেখেও না দেখার ভান করলেন।কিন্তু একটু পর যখন মেয়েটার চোখে তার চোখ পড়লো, উনি ভয়ংকর ধাক্কা খেলেন। এই চোখ তো মৃত মানুষের চোখ নয়।জ্বলজ্বলে সেই ভালোবাসাময় চোখের দিকে তাকিয়ে উনি ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার জন্য কি করতে পারি”?
মেয়েটা ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, “জল খাবো”।
সুবোধ বাবুর বয়স ৫৩ বছর, তার জ্ঞান হবার পর থেকে এমন অদ্ভুত কিছু কখনো সে দেখেনি জানেনি।তার প্রচন্ড মাথা ধরে গেলো, এবং হঠাৎ করে সে বুঝতে পারলো সে জ্ঞান হারাতে যাচ্ছে।কিছু বোঝার আগেই সে কখন তার প্রিয় আরাম কেদারা থেকে পড়ে গেলো, নিজেও বুঝতে পারলোনা।রাত তিনটায় যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন চারদিকে অন্ধকার।ঘরের কুপিবাতি কখন নিভে গেছে কে জানে।ঘরের জানালাটা খোলা আর সেই খোলা জানালা দিয়ে হুহু করে বাতাস ধেয়ে আসছে।সুবোধবাবু চোখ মেলেই দেখলেন সেই মেয়েটা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।উনি ব্যাপারটা শান্তভাবে নেয়ার চেষ্টা করলেন।পদার্থবিদ্যার সূত্র অনুযায়ী একই বস্তু কখনো একই সাথে দুটি অবস্থানে বিরাজ করতে পারেনা।যাকে গতকাল ভোর সকালে কবর দিয়ে আসা হয়েছে সে কি করে এখন তার পাশে আছে সে পদার্থবিদ্যার হাজার সূত্র দিয়েও বুঝতে পারলেননা।আচ্ছা এমন কি হতে পারে যে আরেকটি মেয়ে যে দেখতে হুবহু কালকের তরুনীর মত এখন তার সামনে বসে আছে?এসব ভাবতে ভাবতে উনি উঠে বসলেন।মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে জানতে চাচ্ছিনা।এত রাতে এভাবে আমার গৃহে আপনাকে দেখলে আমার এবং আপনার কারো জন্য ভালো হবেনা তা কি বুঝতে পারছেন”?
মেয়েটা গম্ভীর হয়ে বললো, “আপনি ছাড়া আমাকে আর কেউ দেখতে পাবেনা।আপনি যে এতোটা ভীতু তা কিন্তু আমি আগেই বুঝেছিলাম।কাল আমার লাশ দেখে এভাবে চিৎকার করলেন কেন”?
সুবোধ বাবু আবার জ্ঞান হারালেন।তার জ্ঞান ফিরলো যখন তখন চারদিকে মধ্যদুপুরের সূর্য।উনি ঠিক করলেন আজ আর স্কুলে যাবেন না।কিছুক্ষণ গীতা পাঠ করে মনটাকে শান্ত করার প্রাণপন চেষ্টা করলেন। মন শান্ত হলো এবং বিকালে তিনি চমৎকার একটা ঘুম দিলেন।সন্ধ্যারাতে যখন ঘুম ভাঙ্গলো, তখন আসলাম সুবোধবাবুর পাশে বসে আছে।আসলামের বসার ভঙ্গিটা অনেকটা মহাত্না গান্ধীর মত।মাথাটা ন্যাড়া করে হাতে একটা লাঠি ধরিয়ে দিলেই হবে।আসলাম সুবোধবাবুকে জাগ্রত হতে দেখে বিছানা থেকে উঠে বসলো।আসলামের চোখে পানি দেখে সুবোধবাবু ভ্রু কুঞ্চিত করলেন।আসলামকে বললেন, “আমার আলমারীর উপরে কিছু টাকা আছে নিয়ে যাও”।
আসলাম চোখ মুছতে মুছতে বললো, “স্যার টাকা লাগবেনা আর।আমার মেয়েটা মারা যাওয়ার আগে আপনাকে দেখতে চাইছিলো।আমারে বলে, বড়আব্বু কই?আমি কিছু বলতে পারিনাই।আপনারে দৌড় দিয়ে ডাকতে যাবার আগেই আজরাঈল সাহেব কাজ সেরে ফেলছেন।স্যার একবার চলেন, মেয়েটার মাথায় একটু হাত দেবেন।আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করতাছি তাই দাফন দেইনাই”।
সুবোধবাবু গায়ে একটা শাল জড়িয়ে শীতল আবহাওয়ায় বের হয়ে গেলেন।শরতে এমন ঠান্ডা পরতে তো কখনো দেখেননি।আসলামের মেয়েটার নাম সুমি।সুবোধবাবু সুমির মাথায় হাত বুলালেন।ঈশ্বরকে মনে মনে জিজ্ঞেস করলেন, “ভগবান তোমাতে সবার আশ্রয় যদি রয়, ধরিত্রী বানাইলে কেন”?তার চোখের পাতা বারবার ঘোলাটে ভারী হয়ে যাচ্ছে।এই মেয়েটাকে কি তিনি আরো অনেক আগে কোথাও দেখেছেন?কেন যেন মেয়েটাকে তার লিয়েনা এর মত লাগছে।তার আদরের মেয়ে লিয়েনা।সুবোধবাবুর আশেপাশে হঠাৎ করে কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেলো।তিনি মনে মনে বললেন, “মামণিরা তোমরা যেখানেই থাকো অনেক ভালো থাকো।ভগবান তোমাদের ছোট্ট দেহ রবিকরের গাথুনীতে বেধে রাখুক, স্বর্গ সঞ্চালিত হোক প্রতিটি মনে”।
গভীর রাতে যখন সুবোধবাবু ঘরে পৌছালেন, সারা ঘরে কেমন একটা বদ্ধ হাওয়া।তার খাটে বসে ছিল সেই তরুনী মেয়েটা, কিন্তু আজ মনে হলো মেয়েটার মনটা বেশ বিষন্ন।সুবোধবাবু নিজের অজান্তেই বললেন, “মা আপনার মনটা খারাপ কেন”?
তরুনী মেয়েটা বললো, “আপনি আমার একটা উপকার করবেন?একটু কষ্ট হবে, তবুও বলছি”।
সুবোধবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তিনি কি সম্পূর্ণ মানসিক রোগী হয়ে গেছেন? রাত বিরেতে এক মৃত তরুনী তার কাছে এসে সাহায্য চাচ্ছে।তিনি হতাশ হয়ে বললেন, “আমি তো মা কারো উপকার করার সামর্থ্য রাখিনা।ভগবান চাইলে হবে।তুমি কি চাচ্ছো, বলো দেখি কিছু করতে পারি কিনা”।
তরুনী মেয়েটি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, “একটা ঠিকানা দিচ্ছি।সেখানে যেতে হবে।সেখানে গেলে আপনি একটা ছোট্ট ছেলে আর তার বাবাকে পাবেন।আমার তাদেরকে কিছু কথা বলা দরকার।আপনি আমার হয়ে তাদেরকে বলবেন”?
সুবোধবাবু তিনদিন পর পাবনা জেলার নূরপুর গ্রামে রওনা দিলেন।মেয়েটার দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী যখন মীনাক্ষালয়ে পৌছুলেন তখন তার পুরো শরীর জুড়ে ভয়ংকর জ্বর।বাড়ির দরজায় আস্তে করে ধাক্কা দিলেন।অনেকক্ষণ পর খুব বৃদ্ধ একজন বের হয়ে এলেন দরজা খুলে।কারো দিকে না তাকিয়ে সোজাসুজি বললেন, “মজিদ ভেতরে আও বাজান”।
সুবোধবাবু কিছু না বলে ভেতরে ঢুকলেন।বিশাল বড় দালান, মাঝে হিন্দু বাড়ির মত একটা ছোট্ট তুলসী গাছ প্রস্তর দিয়ে বাধানো।একটা ছোট্ট টিমটিমে হ্যাজাক বাতি জ্বলছে উঠোনের দক্ষিণ কোণায়।সুবোধবাবু কাশি দিয়ে বললেন, “আম্মাজী আমি মজিদ না।আমি সৌরভের কাছে এসেছি।আমি তার একজন সুহৃদ, তার সাথে একটু দেখা করতে চাই”।
বৃদ্ধ মঞ্জিলা বেগম পিছন ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললেন, “বাবাজী আমি তার দাদী।তারে তো সকালেই পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।কোতোয়ালীতে তারে আটকায় রাখছে পুলিশ।আমার নাতবউরে নাকি খুন করছে সৌরভ।খুন করলে লাশ কই?ওর চাচায় জমি চায়, আমার নাতি বলিছে যে তার জমিজমার দরকার নাই।সব ওর চাচারে দিয়া দিবুই।কিন্তু আমার হারামী পোলা ফাসায় দিছে।আমার নাতিটা বাবা বিলাত থেকে পড়ায় আনছি।সোনার টুকরা পোলা।ওর বাপ মা কেউ বাইচা নাই।আমি কেমনে এখন বাচি, কেমনে ওর পোলাটারে বাচাই।আমার বাবুরে দেখবা একটু?সারাদিন কিছু খাওয়াইতে পারতাছিনা”।
সুবোধবাবু যখন বাবুর সামনে গেলেন, তখন তার বুকে হঠাৎ করে ধক করে উঠলো গভীর মমতায়।বাবুর গালে তখন অশ্রুজল শুকিয়ে আছে।সুবোধবাবু তার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “বাবা তোমাকে তোমার মা কতটা ভালবাসে তা কি জানো?সে তোমার জন্য ভগবানের সাথে আড়ি নিয়ে ধরনীতে এসে অপেক্ষা করে তোমাকে দেখতে”।
চার বছরের ছোট্ট বাবু তখন এত কিছু মনে হয় না হৃদয়ঙ্গম করতে পারলো, শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে বললো, “মার কাছে নিয়ে যাবে?আমাকে কেউ খেতে দেয়না”।
সুবোধবাবু যখন সদর থানায় পৌছালেন, তখন সৌরভ চুপ করে গরাদের এক কোণে বসে কি যেন গাইছে।সুবোধবাবু যখন তার সাথে দেখা করার অনুমতি পেলেন তখন প্রায় ভোর হয়ে যাচ্ছে।নীলচে ভোরের আলোয় উনি সৌরভকে বললেন, “বাবা তোমার একটা চিঠি আছে”।
বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সুবোধবাবু সৌরভের হাতে ধরিয়ে দিলেন।সৌরভ সুবোধবাবুর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে নিজের কাছে রাখলেন।সুবোধবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “জন ডেনভারের Love Me গানটা শুনেছেন? আমার খুব প্রিয় একটা গান।আজকে বারবার লিরিকসগুলো ভুলে যাচ্ছি।চিঠিটা কি আপনাকে সুমি দিয়েছে?কবে দিয়েছে”?
সুবোধবাবু বললেন, “চিঠিটা পড়ে দেখো।সে তোমার সর্বপ্রকার মঙ্গল কামনা করে”।
গভীর রাতে সৌরভ যখন গানের লিরিকস মনে করতে পারলো, শুধু তখনি চিঠি পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করলো।চিঠিটা খুলে সে পড়লোঃ
“প্রিয়,
লন্ডনের ল স্কুলে তুমি আর আমি যখন একসাথে পড়তাম, তখন আমি প্রায় দিন তোমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কি ভাবতাম জানো?তোমাকে কখনো বলিনি, কিন্তু আমি তোমাকে সাদা তেলাপোকা ভাবতাম।হঠাৎ করে একদিন দেখি তুমি ক্লাসে নাই।পুরো ক্লাস আমি অস্থির হয়ে ছিলাম।ক্লাস শেষে ফ্লোরা আমার কাছে এসে বলেছিলো, আমি কাদছি কেন?আমি তাকে বলেছিলাম, আমি ভালোবাসতে শিখে গেছি মেয়ে।আমি তোমার মত একটা সাদা তেলাপোকাকে ভালোবেসেছিলাম আমার সমস্ত হৃদয় দিয়ে।আমরা বিয়ে করলাম, একত্র হলাম, আমাদের ছোট্ট একটা বাবু হলো।আমরা কত সুখী ছিলাম।তুমি কেন আমাকে তোমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলে সৌরভ?আমার কখনো ইচ্ছা করেনি।হাই স্ট্রিট পার্কের আমাদের ছোট্ট এপার্টমেন্টের আমরা কত সুন্দর জীবন কাটাচ্ছিলাম মনে পড়ে?আচ্ছা এ বছরই তো বাবুকে স্কুলে ভর্তি করানোর কথা।সব শেষ হয়ে গেলো, সবকিছু।
জানো আমি যখন শখ করে তোমার জন্য নীল রঙের শাড়িটা পড়ে ছিলাম হঠাৎ করে কে যেন আমার গলাটা চেপে ধরে।আমি ভেবেছিলাম তুমি।কিন্তু ওটা যে ভালোবাসার হাত ছিলোনা। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম যখন শেষ নিঃশ্বাসটা ত্যাগ করেছিলাম।আমার জন্য না জান, আমি কষ্ট পেয়েছিলাম তোমার জন্য, আমাদের বাবুর জন্য।প্রিয়, আমি জানি তুমি আমার কাছে খুব তাড়াতাড়ি আসবে।অনেক তাড়াতাড়ি।আমাদের বাবুর জন্য তুমি চিন্তা করোনা।যে মহামানব তোমাকে চিঠি দিয়ে গেছে, সেই আমাদের বাবুকে আমাদের স্বপ্ন দিয়ে মানুষ করবে।তুমি দেখো আমাদের বাবু একদিন অনেক বড় হবে।আমি তুমি হয়তো ছুতে পারবোনা ওকে, একটুও আদর করতে পারবোনা।কিন্তু আমরা ঈশ্বরের সাথে প্রতিদিন ঝগড়া করবো, তাকে যন্ত্রণা করবো অনেক অনেক যেন আমাদের সব প্রার্থনার বিনিময়ে হলেও আমাদের বাবুকে কোন কষ্ট না দেয়।
প্রিয় আমি তোমার জন্য প্রতিদিন কষ্ট পাই।শুধু তোমার জন্য আমি ফিরে এসেছি বিশ্বাস করো।তোমার কি মনে পরে যখন আমাদের বাবু হবে, তখন তুমি প্রতিদিন আমার হাত ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে।আমি কত রাত তোমার কাধে মাথা দিয়ে চাদটা দেখেছি।আমার কখনো ঘুম পায়নি।কখনো একটুও না।আমি যে তোমার ভুলভাল সুরে গাওয়া গানগুলো কান পেতে শুনতাম।প্রিয়, যেভাবে থাকি, যেখানেই থাকি আমি তোমার, আর তুমি শুধু আমার।আমি সবকিছু ধ্বংস হওয়ার লক্ষ বছর পরেও তোমার কাধে মাথা দিয়ে ভালোবাসার গান শুনবো”।
সৌরভ বারবার চেষ্টা করেও চোখ থেকে চশমা খুলতে পারলোনা।চশমার কাচ অশ্রুধারায় ভেসে গেছে।সে চিঠিটি আর পড়তে পারছেনা।আলতো করে শুধু বলছে, “আমায় ক্ষমা করো”।
সুবোধ বাবু একা বাস টার্মিনালে দাঁড়িয়ে, আশেপাশে মানুষজন কেউ নেই তেমন।ভোর তখন উঠি উঠি করছে।হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখতে পেলেন সেই তরুনীকে।পাঠক তরুণীর নাম যে সুমি তা আশা করি ধরতে পেরেছেন।সুবোধবাবুর কাছে সুমি কিছু বলতে চায়।সুবোধবাবু বললেন, “মা আমি তোমার কথা রেখেছি।এখন ফিরে যাবো আবার”।
সুমি কান্নাভেজা কন্ঠে বললো, “আপনি একা যায়েন না।আমার একটা কথা রাখবেন, আর একটা মাত্র কথা”।
সুবোধবাবু বললেন, “মা আমি বাবুকে দুদিন পরে এসে নিয়ে যাবো।আমি তাকে নিজের সন্তানের মত মানুষ করবো, তুমি চিন্তা করোনা”।
সুবোধবাবুর মনে হলো সুমি অনেক কাদছে।তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।সুমি নিজে থেকেই বললো, “বাবা আপনি আমার জন্য এত কিছু কেন করলেন”?
সুবোধবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “মা আমি যখন রাশিয়াতে পিএইচডি করছি তখন এক সহপাঠিনীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।আমরা বিয়ে করেছিলাম, আমাদের একটা মেয়েও ছিলো।লিয়েনা নাম রেখেছিলাম আমাদের ছোট্ট মেয়েটার।মা মেয়ে, দুজন একদিন হারিয়ে যায় চিরতরে।আমি একা হয়ে পড়ি।আমার মেয়েটা হয়তো তোমার মত ছিলো, একেবারে তোমার মত।তুমি ভুল ভেবেছিলে, আমি তোমার মৃতদেহ দেখে ভয়ে চিৎকার করিনি।মনে হয়েছিলো, আমার মেয়ে এখানে কি করে এলো”।
সুমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে কাদতে বললো, “আব্বাজী আমার ছেলেটা যেন কোন কষ্ট না পায়, ওকে অনেক ভালোবাসা দিবেন।ওকে একজন মানুষ বানাবেন আপনার মত।ও খেতে চায়না একেবারে, একটু কষ্ট করে হলেও খাওয়াবেন ঠিকমত।আমি আর আপনাকে বিরক্ত করবোনা।আর আমাকে আসতেও দেবেনা ঈশ্বর।আপনি সৌরভের যখন ফাসি হয়ে যাবে তার আগে ওকে এসে বলবেন, আমি ওর জন্য দু হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছি।বাবা আমি যাই”।
সুবোধবাবু খেয়াল করলেন, হঠাৎ করে প্রভাকর তার সমস্ত রূপ নিয়ে তার সামনে হাজির হয়েছে।তিনি মুগ্ধ হয়ে জগতের রূপ আবার দেখলেন।মনে মনে বললেন, “মা তোমার আত্নাকে ঈশ্বর শান্তি দিক, পরম ভালোবাসায় নিজের বুকে আগলে রাখুক”।
২০ বছর পর কোন এক সকালে বাবু এসে সুবোধবাবুর চশমা হাতে নিয়ে তাকে পড়িয়ে দিলেন।তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা আপনি এতো বই পড়েন কেন”?
সুবোধবাবু চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন, “তুমি যেমন অনেক গান শোনো, আমিও অনেক বই পড়ি।এখন পড়ছি, বিগ ব্যাং থিওরী।বারবার পড়ি তবুও ভালো লাগে”।
বাবু হঠাৎ করে সুবোধবাবুর পাশে বসে বললেন, “বাবা আজকে একট বিশেষ দিন মনে আছে”?
সুবোধবাবু বাবুর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “আমি সকালে তোমার বাবা মায়ের গোরে প্রার্থনা করে এসেছি।তাদেরকে তুমি মনে করে কষ্ট পেওনা।তাদের আত্না তাহলে কষ্ট পাবে”।
বাবু সুবোধবাবুর হাতটা ধরে বললেন, “ওরা তো আপনার মাঝে লুকিয়ে আছে বাবা।যে ভালবাসায় আপনি আমাকে মানুষ করেছেন, আমি জানিনা আমাকে এত ভালোবাসা কি তারাও দিতেন”?
সুবোধবাবু ঝাপসা চোখে বললেন, “বাবারে তোমাকে তারা অনেক অনেক ভালোবাসে।তুমি আরো বড় হও, অনেক অনেক বড়।তাদের স্বপনের থেকেও বড়”।
সুবোধবাবু খুব বিচলিত হয়ে পড়লেন।বয়সের জন্য আজকাল প্রায়ই তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।বাবু কি আবার দেখে ফেললো তার ভালোবাসার জল?লজ্জা বড়ই লজ্জা।