জন্মদিন বলতে মানুষজন সচরাচর যে অর্থ বোঝে সেই অর্থে আজ প্রাপ্তির জন্মদিন না। তবে আমার কাছে আজকের দিনটাই ওর জন্মদিন কারন এই দিনেই ও প্রথম আমার ঘর আলো করে এসেছিল। এখনো সেই দিনগুলো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।
অন্যান্য বারের মতো সেবারো ট্যুর শেষে বাড়ি ফিরছিলাম। বাসে জানালার পাশের সিটটাই ছিল আমার। সিট খুঁজতে গিয়ে দেখি সেখানে বছর ৪-৫ এর একটা ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে বসে আছে। কিছুটা অবাক হলাম।
“মা, তুমি কি এখানে বসেছো?”
“হুমম।”
“একা কেন তুমি? তোমার আব্বু-আম্মু কই?”
মেয়েটা চুপ করে মাথা নিচু করে বসেছিল। কিছুটা অবাক হলাম আমি। পাশে বসে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
“তোমার সাথে কেউ নেই?”
মাথা ঢুলিয়ে মেয়েটা আমাদের সামনের সিটের এক মহিলাকে দেখালো। মহিলাটার কোলে ২-৩ বছরের একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা অবিরাম কেঁদে চলেছে, “আমি আপুর কাছে যাবো। আপুর কাছে যাবো“ বলে। কিন্তু মহিলা কিছুতেই তাকে আসতে দিচ্ছে না। বিস্ময়ের আর সীমা রইলো না আমার।
“তোমার বোন?”
“হুমম।“
“ও তো কাঁদছে তোমার কাছে আসার জন্য। যাচ্ছো না কেন? ঐখানে তো সিট খালি আছে।“
“ঐখানে মামা বসবে”, বলে মেয়েটা আমার দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। সেই দৃষ্টির মাঝে এমন একটা শূন্যতা ছিল আমি পারলাম না সহ্য করতে। একপ্রকার বাধ্য হলাম চোখ সরিয়ে নিতে। পুরো ঘটনাটা ভীষন ঝাপসা মনে হচ্ছিল।
“কি নাম তোমার?”
“বাঁধন।“
কিছুক্ষণ পর মেয়েটার মামা বাসে উঠলো। আরেকদফা বিস্মিত হওয়ার পালা।
“আদনান।“
“আররে ঈপ্সিতা যে!!! কেমন আছিস?”
“ভালো। তুই?”
“হুমম...ভালোই। এইখানে???”
“হ্যাঁ। অফিসের ট্যুরে এসছিলাম।“
“ও...আয় পরিচয় করিয়ে দেই। সিথি, আমার ওয়াইফ।“
সিথির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। কারন একটু আগের দেখা ঘটনার রেশ এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। আমার দেখাদেখি সিথিও পালটা হাসি ফিরিয়ে দিল।
“আর আমাদের মেয়ে সূচনা।“
“অনেক সুইট”, বলে গালটা টেনে দিলাম। বাস এরই মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে।
“তারপর তোদের কি খবর?”
“এই তো চলছে। দুজনেই জব নিয়ে আছি। আর প্রিয়তী আম্মুর কাছে থাকে।
তারপর ভাগনিকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বুঝি?“
কথাটা শোনামাত্রই দুজনের মুখ যেন চুপসে গেল। “কি রে?”
“নাহ। বছর দুয়েক আগে ভাইয়া রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। এরপর থেকে আপু মেন্টালি ডিস্টার্বড। ট্রিটমেন্ট চলছে। বাবা-মার বয়স হয়েছে। তার উপর আপুকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। বাঁধনকে দেখার মতো বলতে গেলে কেউ নেই। তাই আমাদের কাছেই থাকে ও।“
বুঝতে আর বাকি রইলো না যে মামা-মামীর সংসারেও ওকে দেখার মতো কেউ নেই।
সেদিন আসার পথে অনেক কথা হয়েছিল বাঁধনের সাথে। কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে মেয়েটা আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ওর ছোট্ট কোমল হাতগুলো দুহাতে ধরে বসেছিলাম আমি।
এরপর থেকেই প্রায় সময়ই অবসর পেলেই আমি ছুটে যেতাম বাঁধনের কাছে। আমার ছোট্ট প্রিয়তীও ওর জন্যে পাগল ছিল। এই বাচ্চা মেয়েটা কেন যে আমাকে এতো টানতো আমি আজোও জানিনা। একদিন ঝোঁকের বশেই আদনানের কাছে বাঁধনকে চেয়ে বসলাম। সেদিন আদনান শুধু একটা কথাই বলেছিল।
“ঐ বাচ্চা মেয়েটার মা থেকেও নেই। শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি এখানে আসার পর ও ভালো থাকার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা পায়নি। গত দুবছরে ঐ ছোট্ট মেয়েটার মুখে আমি এক চিলতে হাসিও দেখিনি। কিন্তু তোকে দেখলেই ওর চোখে মুখে যে খুশির ঝলক বয়ে যায় তা আমার চোখ এড়ায়নি। জানি এটা আমাদের অপারগতা। তুই ওকে নিয়ে যাবি তোর কাছে? ওকে আর কেউ ভালো রাখতে পারবেনা তুই ছাড়া।“
সেদিনই আমি বাঁধনকে নিয়ে এসেছিলাম আমার কাছে। অঞ্জনের পক্ষ থেকে কোন বাঁধা ছিল না। ও কখনোই আমার কোন কাজে বাঁধা দিতনা। সেদিনও দেয়নি। তাছাড়া আমার মতো অঞ্জনকেও যেন বশ করে ফেলেছিল মেয়েটা। আর সেই থেকেই ও হয়ে গেলো আমার প্রাপ্তি।
এরপরে বছরের পর বছর গড়িয়েছে। একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে আমার দুই নয়নের মনি আর ভারী হয়েছে আমাদের বয়সের পাল্লা।
প্রায় দুবছর হয়ে এলো অঞ্জন চলে গেছে। প্রিয়তী অস্ট্রেলিয়ায় স্যাটেল্ড হয়েছে। আর প্রাপ্তি আছে ওর চাকরি আর সংসার নিয়ে। কিন্তু তার মাঝেও প্রতিদিন অফিস শেষে এসে আমার সাথে দেখা করে যায়। এখনো সেই ছোট্টবেলার মতো পাগলীটাই রয়ে গেছে মেয়েটা। আমাকে না দেখে থাকতেই পারে না।
“সেকি!! তুমি এখনো বাইরে বসে আছো?? ঠান্ডা লাগবে তো...”
“এতো শাসন করিস কেন?”
“সেটাই...আমি শাসন করবো কেন? শাসন করার কে আমি?”
“প্রাপ্তি!!”
“সন্ধ্যে হয়ে এলো। এখনো সাঁঝবাতি দাওনি?”
“আমার সাঁঝবাতি তো তুইই। আর কিসের বাতি লাগবেরে?”
“মাঝে মাঝে কি যে বলোনা তুমি মামনি!!”
প্রাপ্তি গিয়ে অন্ধকার বাড়িটাতে আলো জ্বেলে দেয়। আমি খাটে গিয়ে বসি।
“জানো মামনি, আজ প্রিয়তী ফোন দিয়েছিল।“
“কি বলেছে? এবারও ছুটি পায়নি। তাই তো?”
প্রাপ্তি এসে আমার পায়ের কাছে বসে। “তোমার খুব কষ্ট হয়। তাই না মামনি?”
“কষ্ট হবে কেন?”
“এই যে এতোদিন হয়ে গেলো প্রিয়তী তোমার কাছে আসেনা।“
“যে থাকতে চায়না তাকে কি ধরে রাখা যায়? আর তুই তো আছিসই। মন খারাপ হবে কেন তাহলে?”
আজ আবারোও এক অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে ও তাকায় আমার দিকে। নাহ, আজ সেই দৃষ্টিতে কোন শূন্যতা নেই, আছে প্রাপ্তির অপার আনন্দ।
“আজ থাকবি আমার কাছে?”
মৃদু মাথা ঢুলিয়ে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে আমার ছোট্ট মেয়েটা, শক্ত করে ধরে রাখে আমার হাতদুটো......
বইমেলা ও ভালোবাসা দিবসের ই-সংকলন "সৃজন"-২য় সংখ্যায় প্রকাশিত।