somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"গোসল শেষে এ মাঠে দাঁড়িয়ে সে নামাজও আদায় করতো। আর যখন দু’হাত তুলে দোয়া করতো, তখন যেন সবকিছু ভুলে যেত হুমায়ূন।”

২৬ শে জুলাই, ২০১২ সকাল ৭:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আলতাফুর রহমান। বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। বয়সের ভারে খানিকটা নুঁয়ে পড়েছেন। মাথার চুল আর মুখের সবক’টি দাঁড়ি পেকে ধবধবে সাদা। গাঁয়েও জড়িয়ে এসেছেন সাদা পাঞ্জাবী। সবকিছুর মধ্যেও তাঁর চেহারায় মলিনতার ছাপ স্পষ্ট। কেমন যেন নিরব, নিস্তব্ধ।

তিনি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ আহমেদের সহোদর। সদ্য প্রয়াত জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের চাচা। নেত্রকোণার যে গ্রামটি নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ স্বপ্ন বুনে যেতেন, সে গ্রামেই থাকেন তিনি। জীবনভর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করে কাটিয়ে দিয়েছেন। অবসর গ্রহণের পর তাঁর সময় কাটতো হুমায়ূন আহমেদের লেখা বইগুলো পড়েই।

কুতুবপুর গ্রামে হুমায়ূন আহমেদের পিতৃ নিবাস আর দশটি গ্রাম্য বাড়ির মতোই। বাড়ির সামনে বড় পুকুর, তারপর উঠোন। পুকুরের পাড়ে ঠিক রাস্তার পাশ ঘেঁষে হুমায়ূন আহমেদের দাদা আর দাদির কবর। বাড়িতে প্রবেশ মুখের পাশেই রয়েছে বিশাল কয়েকটি গাছ।

“হুমায়ূন মৃত্যুর আগেই বুঝতে পেরেছিল- সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। নুহাশপল্লীতে আমার সঙ্গে শেষবারের দেখায় বলেছিল, আর যদি কোনোদিন দেখা না হয়, আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন কাক্কু।” কথাটা শেষ করার আগেই চোখ ছলছল করে উঠলো আলতাফ আহমেদের। অস্পষ্ট হয়ে এলো মুখের শব্দ। আপনমনে খানিকটা কেঁদে নিয়ে তারপর বললেন, “আমাদের অত্যন্ত আদরের ছিল হুমায়ূন। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও সে আমাদের খোঁজখবর সবসময়ই রাখতো। বাড়িতে এলে আগে আমার সঙ্গে দেখা করে তারপর অন্য কাজ করতো।”

আলতাফ আহমেদ জানালেন প্রিয় ভাতুষ্পুত্র হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিময় অনেক কথা। বললেন, “বাড়ির সামনের এই স্কুলটা হুমায়ূন আহমেদের একটা স্বপ্ন ছিল। সে সবসময় বলতো, এই স্কুল একদিন বিশ্ববিদ্যালয় হবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্নটা পুরণ হওয়ার আগেই চলে গেল। আমার তো বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।”

“আমার খুব মনে পড়ে, স্কুল তৈরির প্রথম দিকটায় সে এসে স্কুল মাঠেই পানি এনে গোসল করতো। মাঠের ঘাসগুলো তার খুব প্রিয় ছিল। গোসল শেষে এ মাঠে দাঁড়িয়ে সে নামাজও আদায় করতো। আর যখন দু’হাত তুলে দোয়া করতো, তখন যেন সবকিছু ভুলে যেত হুমায়ূন।”


সন্তানতুল্য হুমায়ূন আহমেদের কথা বলতে বলতে চাচা আলতাফ আহমেদ অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন কখনো কখনো। আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতেন। ভাবনার ছেদ পড়লে আবার বলতেন, “সে তো আমাদের গর্ব। সারাদেশের মতো এই এলাকার এমন কোনো মানুষ নেই যে, হুমায়ূনকে নিয়ে গর্ব করে না। তার মৃত্যুর পর তো এই গ্রামের মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কারো মুখে যেন কোনো কথা নেই।”

হুমায়ূনের স্বপ্ন ছিল এখানে একটি হাসপাতাল করবে। গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতাল তৈরি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমার সঙ্গে আলোচনাও করতো। এখানে সে ৩৩ কাঠা জমি কিনেছে। এই জমিতেই স্কুল গড়ে তুলেছে। পাশে একটি পার্ক এবং সেটির সঙ্গে হাসপাতাল নির্মাণ করার অনেক পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু সব পরিকল্পনাই ভেস্তে গেল।”

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর কুতুবপুর গ্রামের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে আলতাফ আহমেদ বলেন, “আমরা কাউকে খবর দেইনি। সবাই খবর পেয়ে বাড়িতে ভিড় করেছে। আশে পাশের অনেকগুলো গ্রাম থেকে দলে দলে লোকজন ছুটে এসেছে। সবাই শোকে কাতর হয়ে পড়েছিল। লোকজন হুমায়ূনের জন্য নিজ থেকেই দোয়া করেছে। আমরা কাউকে বলিনি, তবুও সবাই ঘরে ঘরে হুমায়ূনের জন্য কোরআন খতম করেছে। একটু খোঁজ নিলেই দেখবেন, পুরো রমজান জুড়ে হুমায়ূনের জন্য সবাই দোয়া করবে।”

“দেশবাসী হুমায়ূনের মর্যাদা দিয়েছে। সব মানুষের সম্মান সে পেয়েছে। এর চেয়ে বেশি আর কিছু পাওয়ার নেই আমাদের। মিডিয়া আর মানুষজন হুমায়ূনের জন্য যা করেছে, তা বলে কোনোদিন শেষ করা যাবে না।” কথা শেষ না করতেই আবার কেঁদে ফেললেন চাচা আলতাফ।

হুমায়ূন আহমেদকে কুতুবপুরে কবর দেওয়ার ইচ্ছা ছিল বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, “আমি ভাবিকে (হুমায়ূনের মা আয়েশা ফয়েজ) বলেছি হুমায়ূনকে তার দাদা-দাদির পাশে কবর দিতে। কিন্তু ভাবি আর জাফরের ইচ্ছা ছিল বুদ্ধিজীবী কবরে দাফন করার জন্য। এলাকার মানুষজনও হুমায়ূনের লাশ গ্রামে দাফন করার জন্য খুব উঠে পড়ে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবার সিদ্ধান্তে তার প্রিয় জায়গা নুহাশপল্লীতে দাফন করা হয়েছে। যেখানেই দাফন হোক না কেনো, সে যেন ভালো থাকে।”

বুধবার বিকেলে ঘরের সামনে মেঝেতে বসেই কথা বললেন আলতাফ আহমেদ। চারপাশ তখনও ভীড় করে রেখেছে গ্রামের মানুষজন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও ঘরে ফিরছে না কেউই। হুমায়ূন আহমেদ নেই, তাতে কি? তাকে নিয়ে কথায় তো যোগ দিতে পারছে। কুতুবপুরের মানুষের কাছে এটাই যেন এখন একমাত্র সান্তনা।
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্লোগান কোলাজঃ

লিখেছেন জুল ভার্ন, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:৩৬

জুলাইয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শ্লোগান কোলাজঃ

* ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’
* ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’
* ‘নাটক কম করো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আসসালামু আলাইকুম। ইদ মোবারক।

লিখেছেন রাজীব নুর, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সকাল ১১:১৯



ঈদ এখন এক নিরানন্দময় উপলক্ষ্য।
কিতাবে আছে ধনী-গরীব অবিভাজনের কথা বরং এদিন আরো প্রকটতা নিয়ে প্রস্ফুটিত হয় বিভেদরেখা কেননা আমরা আমাদের রাষ্ট্র- সমাজব্যবস্থা ও জনগণকে সেভাবে দিয়েছি ঘিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঈদের শুভেচ্ছা: দূর থেকে হৃদয়ের কাছ

লিখেছেন আমিই সাইফুল, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:০৩

আসসালামু আলাইকুম,
আজ ঈদের দিন। চারদিকে উৎসবের আমেজ, হাসি-খুশি, নতুন জামা আর মিষ্টি মুখের আদান-প্রদান। আমি ইউরোপে আমার পরিবারের সাথে এই আনন্দের মুহূর্ত কাটাচ্ছি। কিন্তু আমার হৃদয়ের একটা কোণে একটা ফাঁকা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ও মোর রমজানেরও রোজার শেষে......

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪০


বাংলা গানের ভাণ্ডারে কাজী নজরুল ইসলাম এক অনন্য নাম। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইসলামী সংগীতের এক শক্তিশালী ধারা তৈরি করেছেন। তারই লেখা কালজয়ী গজল "ও মোর রমজানেরও রোজার শেষে এলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেই যে আমার নানা রঙের ঈদগুলি ......

লিখেছেন অপ্‌সরা, ৩০ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪২


পেছনে ফিরে তাকালে আমি সবার প্রথমে যে ঈদটার কথা স্মরন করতে পারি সেই ঈদটায় আমি পরেছিলাম আমব্রেলা কাট নীলচে বলবল রং একটা জামা এবং জামাটা বানিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×