চলচিত্রকার হিসাবে কুবরিক ‘ভিডি ওয়েল’ । চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা সৃজনশীল ও প্রভাবশালী নির্মাতা । তাকে বলা হয় চলচ্চিত্রের ঈশ্বর । কুবরিক তার সিনেমার সেটে সর্বব্যাপী, সর্বত্রচারী, সর্বগত এবং সর্বনিয়ন্তা- চূড়ান্ত পারফেকশনিস্ট । চলচ্চিত্রে যুগান্তকারী কৌশলের উদ্ভাবক । তার মুভিগুলোর অন্যতন বৈশিষ্ট্য হল খুব কাছ থেকে নেয়া ক্লোজ-আপে অভিনেতার অঙ্গভঙ্গি ও আবেগের স্পষ্ট প্রকাশ । ছবিতে তিনি জুম লেন্স আর ক্লাসিকাল মিউজিক এর সার্থক প্রয়োগ করেছেন । একই শট ১১৮ বার নিয়ে তিনি রেকর্ড করেছেন । কুবরিকের চলচ্চিত্রের অধিকাংশই বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যকর্মের চিত্ররূপ । তার অধিকাংশ সিনেমাকেই নির্দিষ্ট কোন জেনারে স্পেসিফাই করা কঠিন ।
তার চলচ্চিত্রে সমাজ-সচেতনতা এবং সভ্যতার অবক্ষয় মূর্ত হয়ে উঠেছে। সিনেমার থিম মাথায় আসার পর কুবরিক গবেষণায় লেগে যেতেন । সিনেমা বানাতে প্রায় ৪-৫ বছর লাগতো ।তার সিনেমার প্রায় প্রতিটি চরিত্রই সমাজের একটা বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব করতো । তাকে বলা যায় একজন সার্থক এক্সপ্রেশনিস্ট এবং সুররিয়ালিষ্ট । চরিত্রগুলোর সমাজ বাস্তবতাকে তিনি এস্কেপ করতেন, চরিত্রগুলোকে তিনি কাল্পনিক রুপ প্রদান করতেন নিজের মনের মত করে । আর একজন সচেতন ওপ্টিমিষ্ট হিসাবে এই আইরোনিক পেসিমিজম সৃষ্টির উদ্দেশ্য থাকতো চরিত্রগুলোকে বিদ্রুপ করা । যাতে তাদেরকে দেখে করূণা হয়, উপহাস করতে ইচ্ছে হয় । পার্ভাটিজম ও ভায়োলেন্স এর নান্দনিকায়ন তার মুভির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
তার ১৩ সৃষ্টির মাঝে আমি দেখেছি 'পাথস অব গ্লোরি', 'স্পার্টাকাস', 'ললিতা', ড. স্ট্রেঞ্জলাভ অর: হাও আই লার্নড টু স্টপ ওরিয়িং অ্যান্ড লাভ দ্য বম, '২০০১: এ স্পেস ওডেসি', 'এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ', 'ফুল মেটাল জ্যাকেট' ও 'আইস ওয়াইড শাট' । 'এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ' এর টিনএজ হুলিগান আলেক্স ডি লার্জ আমার ভাষ্যমতে তার সৃষ্ট সেরা চরিত্র আলেক্সজেন্ডার কোহেন আলেক্স ডি লার্জ চরিত্রটি সম্পর্কে বলেছিলেন ‘seeking idle de-contextualized violence as entertainment as an escape from the emptiness of their dystopian society’ ।
মার্টিন স্করসেজিঃ
"You talkin' to me? You talkin' to me? You talkin' to me? Then who the hell else are you talking... you talking to me? Well I'm the only one here. Who the fuck do you think you're talking to? Oh yeah? OK."
রবার্ট ডি নিরো ডাইলোক টা আমার খুব ফেভারিট । ট্যাক্সি ড্রাইভারের একটা জনপ্রিয় ডাইলোক ।
'ট্যাক্সি ড্রাইভার', 'রেজিং বুল', 'গুডফেলাস', 'এজ অফ ইনোসেন্স', 'দ্যা ডিপার্টেড', 'ক্যাসিনো' এই মুভির লিষ্ট যার সৃষ্টি তিনি মার্টিন স্করসেজি । তার মুভিতে বিপথগানী কিছু চরিত্রের ক্রেইজিনেস, টেনশন আর কনফ্লিক্ট মুর্ত হয়েছে যেখানে তারা মুক্তির পথের খোঁজে ছুটে বেড়ায় । তার সিনেমার বাস্তবে ছুটে বেড়ানো প্রচণ্ডভাবে অস্তিত্বশীল সাধারণ চরিত্রগুলো অসাধারন হয়ে উঠে । সহিংস এবং বেদনাদায়ক পথকেই শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন । মুভির শেষে দেখা যায় চরিত্রগুলো যেই অসীমে ছিল সেই অসীমেই রয়ে গেছে । ট্যাক্সি ড্রাইভারের ট্রাভিস বিকেল আমার দেখা অন্যতম অবসেশনাল চরিত্র । রবার্ট ডি নিরো স্করসেজির আটটি মুভিতে অভিনয় করেছেন । ইগোইজম, বাস্তব-সংগতি, ইমোশন আর স্যালভেশন এই চারের সম্মিলনে গড়ে উঠে তার ফিল্ম গুলো ।
কুয়েন্টিন টরেন্টিনোঃ
কোয়েন্টিন জেরোম টরেন্টিনো!! "কিউ" তার ডাকনাম!!
ভায়োলেন্স বা সহিংসতাকে নান্দনিকায়্নের মাধ্যমে তিনি নৈসর্গ্যিক রূপ দিয়েছেন । আর্টিস্ট অভ এক্সট্রিম ভালোলেন্স এর ভাষ্যমতে “Violence is one of the most fun things to watch.”। ভায়োলেন্সকে এক্সপ্রেসিভ আর্ট হিসাবে স্পষ্ট রুপায়ন করেছেন যা অবয়বগত ভাবেই মাধুর্যমণ্ডিত । তার অফবিটের এবং সাটিয়ারিক্যাল মুভিগুলোতে ক্রোনলজিক্যাল অর্ডারের কিছু ঘটনা স্তরবিচ্ছেদ ঘটিয়ে উপস্থাপন করার টেকনিক তিনি আপ্লাই করেন । পাল্প ফিকশন, রিজর্ভার ডগ্স, ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড্স, ফ্রম ডাস্ক টিল ডউন, জ্যাকি ব্রাউন মুভি গুলো তার স্বকীয়তায় ভাস্বর
ম্যাগপাই এমন একটা পাখি যে কিনা তার খাবার সংগ্রহ কিংবা আবাশ নির্মানে অত্যন্ত সাহসীকতার পরিচয় দেয় । এখান থেকে কিছু খড়কুটো তো আরেক জায়গা থেকে কোন উজ্জ্বল বস্তু অথবা কোন পতঙ্গের শুটকিট সবই সে প্রয়োজনে ব্যবহার করে । টরেন্টিনো কে কালচারাল ম্যাগপাই বলা যায় । । তার মুভির আরেকটি বিশেষত্ব হল পপ মিউজিকের ইউস এবং লংসিকোয়েন্স ও অবশ্যই এক্সেপশনাল, বুদ্ধিদীপ্ত ও সার্প ডাইলোগ, যেমন ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড্স এ ব্রাড পিট এর ডাইলোক ‘আই থিঙ্ক দিস মাইট যাষ্ট বি মাই বেষ্ট মাষ্টারপিস’ আমাকে প্রচন্ড ফেসিনেট করেছিল।
বার্নাডো বেরতোলুচ্চিঃ
‘This is something that I dream about: to live films, to arrive at the point at which one can live for films, can think cinematographically, eat cinematographically, sleep cinematographically, as a poet, a painter, lives, eats, sleeps painting’
– বার্নাডো বেরতোলুচ্চি
ছোট বেলা থেকেই তাই ইচ্ছা ছিল বাবার মত কবি হবেন । পরবর্তিতে তিনি একজন এক্সপ্রেশনিষ্ট ফিল্মমেকার হিসাবে আবির্ভুত হন । অবশ্য তিনি কবিতাও লিখেন । তার মুভি গুলো তার সুররিয়ালিষ্ বা সিম্বলিষ্ট বা মেটারিয়ালিষ্ট আউটলুকের পরিচয় দেয় । যেমন, লাষ্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিসে গ্রে গোল্ডেন লাইটিং জেন আর পল এর রিলেশনশিপ এর সিম্বোলিক এক্সপ্রেশন । লাইটিং, এডিটিং, কালার এর ব্যবহার, ক্যামেরার মুভ প্রভৃতি প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতা এই ইটালিয়ান পরিচালকের মুভির অন্যতম স্টাইল । তার মুভি যেন মাইক্রোষ্কোপের নিচে রাখা মানুষের আত্মা । সেক্স আর পলিটিক্স তার মুভির সবচেয়ে উল্লেখ্য থিম । ‘কনফ্রন্টিষ্ট’ ফেসিষ্ট আইডোলজির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ । লাষ্ট ট্যাঙ্গো ইন প্যারিস, ড্রিমার্স সহ অন্যান্য মুভিতে তিনি মানব জীবনে সেক্সুয়াল রিলেশনের সাইকোলজি ফুটিয়ে তুলেছেন । সমাজের বিভিন্নরকম যৌন সম্পর্কগুলো তিনি আইস্থেথিক্যালি ও রিয়েলিষ্টিক অ্যাটমোস্ফিয়ারে উপস্থাপন করেছেন ।
তিনি ইনসেস্ট মত বিতর্কিত বিষয়ও এসেছে তার মুভিতে । তাকে বলা যায় মাস্টার অভ ভয়ারিজম। ড্রিমার্স সিনেমায় তিনি নিজেই বলেছেন, “চলচ্চিত্রকার মানে ভয়ারিস্ট, ক্যামেরা হল তার গোপন বাইনোকুলার”। তবে এই ভয়ারিজমের আড়ালে তিনি জটিল মনস্তত্ত্বের ছাপ রেখেছেন । তার বায়োগ্রাফিক্যাল মুভি দ্যি লাষ্ট ইম্পেরর এনে দিয়েছিল নয়টি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ।
আলফ্রেড হিচককঃ
শৈশবে দুষ্টুমির জন্য হিচককের বাবা স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে প্রায়ই চিঠি দিয়ে পাঠাতেন যেন হিচকককে ১০ মিনিটের জন্য আটকে রাখা হয় । বড় হয়ে তিনি হলেন মাস্টার অব সাসপেন্স এবং রহস্যের জাদুকর । সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারধর্মী ছবির এই কিংবদন্তী দর্শকদের নিয়ে পিয়ানোর মতো খেলতে ভালোবাসতেন । চলচ্চিত্র ইতিহাসে তাকেই প্রথম থ্রিলার কিংবা ভৌতিক ছবির সফল ও আধুনিক রূপকার ধরা হয় । আজও তার মুভি গুলো দর্শক, সমালোচকদের চিন্তার খোরাক জোগায় । হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়া মুভি গুলোর আবেদন আজও বিন্দুমাত্র কমেনি । তার মুভিতে ক্যামেরার মুভমেন্ট এমন যেভাবে দর্শক ভয়ারিষ্টিক চাহুনিতে উপভোগ করে থ্রিলিং সব মোমেন্ট গুলো । আমার দেখা হিচককের মুভি গুলো হল সাইকোলজিক্যাল বিষয়ক চলচ্চিত্র ‘সাইকো’, মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার ‘রেবেকা’, ‘দ্য বার্ডস’, সাসপেন্সধর্মী গোয়েন্দা চলচ্চিত্র ‘নর্থ বাই নর্থওয়েস্ট’, ‘ভার্টিগো’, ‘দ্য ম্যান হু নিউ টু মাচ’, ‘রেয়ার উইন্ডো’, ‘স্ট্রেঞ্জার্স অফ এ ট্রেইন’, ‘রোপ’, ‘স্পেলবাউন্ড’, ‘নটরিয়াস’, ‘লাইফবোট’, ‘শ্যাডো অফ এ ডাউট’ । 'দ্য মোমেন্ট অব সাইকো' উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয় 'সাইকো'। উপন্যাসের লেখক মন্তব্য করেছিলেন, 'যে কোনো আমেরিকান থ্রিলারধর্মী ছবির জন্য এর প্রতিটি উত্তেজক দৃশ্য একেকটি নির্দেশনা হয়ে থাকবে। এটা ছবির জগতটা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে।' গোসলখানার ৪৫ সেকেন্ড ব্যাপ্তির সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দর্শকদের চিরকাল আতঙ্কিত করবে । হিচককের মুভির এন্ডিংয়ে টুইষ্ট অবশসম্ভাবী । ভীতি, ফ্যান্টাসি, হিউমার আর বুদ্ধিদীপ্ততা এই চারের কম্বিনেশনে প্লটগুলো মেইনলি মার্ডার, অপরাধ, ভায়োলেন্স উপর বেস করে নির্মিত । ফিল্ম মেকিয়ের অনেক টেকনিক্যাল বিষয় হিচকক আবিস্কৃত ।
এছাডা ফেদরিকো ফেলোনি, ক্রিস্টোফার নোলান, আব্বাস কিয়ারোস্তামি, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, ফ্রাংক কাপরা, রোমান পোলানস্কি মুভিগুলো হাতের কাছে পেলে আমি মিস করি না !!!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৩ ভোর ৬:২২