আমার শিশুকন্যা অপনা মেলবোর্নে যে স্কুলে পড়ে, তার কর্মকাণ্ড মূলধারার স্কুলের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। বিভিন্ন কাজে সক্রিয় অংশগ্রহনের জন্য অভিভাবকদের হাজিরা দিতে হয়। প্রতিদিনই তার নোটবুকে কোন না কোন নোটিস থাকে। ক'দিন আগে জানিয়েছিল, মঙ্গলবার স্কুলের অলিম্পিক। গতকাল খাতায় লিখে দিল স্কুল অলিম্পিকে ওকে নীল রঙের পোশাকে স্কুলে পাঠাতে। ওদের ক্লাস, অর্থাৎ ফোর বি'র রং ঠিক করা হয়েছে নীল। তাই আজ সকালে ওকে স্কুলের জ্যাকেট আর ট্র্যাকপ্যান্টের সঙ্গে নীল জামা, নীল মোজা আর ছোট্ট চুলে নীল রিবন বেঁধে পাঠালাম। আমরা, মানে বাচ্চাদের বাবামায়েরা নির্ধারিত সময়ে স্কুলের বিশাল মাল্টিপারপাস ভবনটাতে গেলাম।
দুদিকে কাঁচের দেয়ালঘেরা বিশাল হলরুমটাতে দেয়াল ঘেঁষে রাখা চেয়ারগুলোতে আমরা বসি। দরজা দিয়ে সারবেঁধে ঢোকে স্কুলের খুদে অলিম্পিয়ানরা। ওই দেড়ঘন্টায় ফোর বি, ফাইভ বি, সিক্স এ, বি- এই চারটি ক্লাসের খেলা। এখানে বলে রাখি, এরা ক্লাস ফোর-ফাইভ-সিক্স নয়; স্কুলের প্রথম বর্ষের পাঁচবছর বয়সী বাচ্চা সবাই। এদের সবারই কিছু না কিছু বিকাশগত সমস্যা আছে; এই স্কুলটি একটি বিশেষ অটিস্টিক স্কুল। মানসিক বিকাশের ধরণের ওপর নির্ভর করে তাদেরকে ওয়ান এ থেকে সিক্স বি পর্যন্ত বিভিন্ন ক্লাসে রাখা হয়েছে। প্রতি ক্লাসে ছ'জন করে বাচ্চা, তিনজন করে টিচার। প্রত্যেক টিচারের হাত ধরে আছে দুজন করে শিশু।
এরপর খেলা। হাল্কা মজার ইভেন্ট সব, হারজিতের কিছু নেই। একেক ক্লাস একেক ব্লকে রাখা ক্রীড়াসামগ্রী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তিনধাপ মই বেয়ে বারের ওপর সোজা হেঁটে আবার নেমে ঢালু একটা সারফেইসে গড়াগড়ি দেয়া হল জিমন্যাস্টিকস। ছয় ইঞ্চি উচ্চতার ক'খানা হার্ডল একজন একজন করে পেরোলেই হল। রিলে দৌড়ের পার্টনাররা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে; বন্ধুর হাতে ব্যাটন দিয়ে তার হাতটা ধরেই আবার ফিরতি দৌড়। অক্ষর বা নম্বর লেখা ছোট্ট কুশন ছুঁড়ে বক্সে ফেলার নাম শর্টপুট। স্টাইরোফোমের নুডলটা ছুঁড়লেই জ্যাভলিন থ্রো। ট্র্যাম্পোলিনে এক এক করে ঝাঁপানো। টিচারদের নিখুঁত নজরদারীতে কেউই কোন ইভেন্ট মিস করছেনা, শরীরে কোথাও চোট পাচ্ছেনা।
প্রতিযোগিতার লড়াই নেই, শুধুই অংশগ্রহণ। তারপরও শিশুদের সবার জন্য সেটা খুব উপভোগ্য হচ্ছেনা। এরা সেই দুর্ভাগার দল, যাদের মস্তিষ্ক অনুদ্ঘাটিত কোন বিচিত্র কারণে খুব সাধারণ কিছু কিছু বিষয়ও ধারণ করতে অক্ষম। কারও সমস্যা অক্ষর-রঙ-আকৃতি চেনায়। কেউ অচেনা মানুষ সহ্য করতে পারেনা। কেউ বা আই কন্ট্যাক্টে অক্ষম; সরাসরি কারো দিকে তাকাতে পারে না। নানান রকম ফোবিয়া আছে কারো কারো। ভয়ার্ত মুখের দেবশিশু ছোট্ট হাতের সবটুকু শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরেছে তার টিচারের হাত, মুখ লুকিয়ে চোখ বুঁজে এগিয়ে চলছে কোনোমতে । দূরত্বের অনুমানে বিভ্রান্ত শিশু ছ'ইঞ্চির হার্ডলটা পেরোতেও ঠেকে যাচ্ছে প্রতিপদে। হাতের ব্যাটন রিলে'র সঙ্গীর দিকে এগিয়ে দিতে হবে, শুধু সেটুকু বুঝতেই বড় কষ্ট হচ্ছে কারো। তবু সবাই ওয়েল ডান; সবার জন্যই হাততালি, ফ্যান্টাস্টিক পারফর্ম্যান্স।
"ওয়ান" লেখা একটাই ভিক্টরি স্ট্যান্ড; একে একে সবাই সেটায় দাঁড়িয়ে "গোল্ড মেডেল" পরে নিল গলায়। হাইপারঅ্যাকটিভ কয়েকজন টিভিতে দেখা অলিম্পিক-বিজয়ীর ভঙ্গিতে মেডেলে চুমু খেল; ধারাভাষ্যকারকে কয়েকজন ইন্টারভিউও দিল। আমার কন্যাকে প্রশ্ন করা হল সে ফার্স্ট হয়ে গোল্ড নাকি সেকেন্ড হয়ে সিলভার মেডেল চায়। সে গম্ভীর মুখে জানালো, সেকেন্ড ওয়ান।
অলিম্পিকের পাট চুকলে যার যার ঘরে ফেরার তোড়জোড়। ড্রাইভওয়েতে আমরা কয়েকজন, কিছুক্ষণ দাঁড়াই। নিকোলাসের সদালাপী ল্যাটিন আমেরিকান বাবামা; ডেভিডের সহজসরল ভিয়েতনামী বাবা; থমাস-জেমস জমজদের অসম্ভব রূপবতী ইটালিয়ান মা; অপনার বাংলাদেশী মা। ওদের সবার শুকনো মুখে বিষণ্ণ হাসি; আয়না ছাড়াই বলে দিতে পারি আমাকে দেখেও ওরা ঠিক তাই ভাবছে। আমরা আমাদের দেবশিশুদের কথা বলি। কেউ পড়তে শিখলোনা এখনও; কেউ সেটা পারে তো কারো সঙ্গে কথা বলতে পারেনা; অপ্রকৃতস্থ চাহনি- আচরণে অস্বস্তির যোগান দিচ্ছে কেউ; খুব সাধারণ রেসপন্স-কগনিশন ব্যাপারগুলোই আবার কারো নেই... ... ... ওদের প্রত্যেকের দুটো করে বয়স, দ্বিতীয়টি "বুদ্ধিবৃত্তিক"; কবে দুটো বয়সের ব্যবধান কমে একটু স্বস্তিকর পর্যায়ে আসবে? তিন বছর পর এই স্কুলটা ওদের আর রাখবেনা, কোথায় যাবে ওরা? ডে কেয়ারে অচ্ছ্যুত... মূলধারার কোনো স্কুল ওদের নিতে চায়না... কোনমতে কোথাও একটু ঠাঁই জুটলে বুলিং আর র্যাগিংয়ের নিশ্চিত নিয়মিত শিকার... কোথায় যাব আমরা? আর তারও পরের... আরো অনেক, অনেক পরের জীবনে, যখন আমরা থাকবোনা, ওরা তখন কীভাবে থাকবে? কেমন হবে সে জীবন... ?
শীতের বিষণ্ণ আলোয় মুখগুলো ক্লান্ত দেখায়; হাসিগুলো ক্রমশ বিষণ্ণতর হয় । এ দেশেই ওরা অসীম শূণ্যে সূক্ষ তারের ওপর হাঁটছে, আমার জন্য নিজদেশে কী অপেক্ষা করে আছে! কুমারের মা, শিখপত্নী কিরণ, গলার পবিত্র লকেটটা কপালে ছোঁয়ায়। তাকে দেখেই হয়তোবা; জেমসের মা গ্যাবি দীর্ঘশ্বাসে টেনে টেনে বলে- জিইসাআআস... । আশা আর প্রার্থনায়, আশাভঙ্গ আর হতাশায়- আমরা আবার বাইরের পৃথিবীতে পা রাখি। যে পৃথিবী মানেই প্রতিযোগিতা। যেখানে জয় যোগ্যতমের । দেবশিশু এখানে চিরশিশু থাকেনা, আঁকড়ে ধরার মতো হাত এখানে কেবলই হারিয়ে যায়। ছয় ইঞ্চি হার্ডলের একক রেইসের অলিম্পিক এই পৃথিবীর নয়।