আমার মনে হয় এখানে খানিকটা ভুল বুঝাবুঝি আছে। আমি মূলতঃ ধর্মের আলাদা কোন সংজ্ঞা দিতে চাইনি এখানে। আমি বলতে চাইনি, আমরা অন্য একটি সমন্বয়কারী, ব্যপক অর্থবহ বা অন্য কোন ভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংজ্ঞায়নের জন্য প্রস্তুত। আমি বরং সে বিষয়ে দৃষ্টিক্ষেপ করতে চেয়েছি যে, সমাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একটি প্রকরণ (ক্যাটাগরি) হিশেবে ধর্ম কি করে প্রতিনিয়তই ধারনায়িত হচ্ছে। এবং এরকম এক-একটি ধারনার পেছনে মানুষেরও রয়েছে সুনির্দিষ্ঠ যুক্তি-কাঠামো। মানুষের বিবিধ অভিজ্ঞতা, সংগঠন, কর্মময়তা, বিতর্ক এবং এরকম নানান বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত হয়ে আছে ধর্ম। আর এজন্যই আমি ধর্মকে প্রতিনিয়ত সংজ্ঞায়নের বিষয়টিতে চোখ রাখি। আবার এটি কোন বিমূর্ত ধারনায়নও নয়, যার প্রতি আমার আগ্রহ তৈরী হয়েছে। যারা ধর্মের বিমূর্ত সংজ্ঞা বানায় তারা মূলতঃ ধর্মের সমাজিক ও ঐতিহাসিক সত্যতাকে পাশকাটিয়ে চলে; যার রয়েছে আইনি পরিধি, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা; এবং এমন অন্যান্য। আর তাই মানুষের পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে সঠিক উপাত্ত সমূহ বিবেচনায় ধর্মের সংজ্ঞায়নের পথ খুঁজে নেয়া দরকার। এভাবে মানুষ সমাজিক জীবনের মধ্যেই ধর্মকে চিন্তা করে। প্রবন্ধে এ বিষয়টিই ছিল আমার আলোচ্য।
ধর্মের বংশানুক্রম গ্রন্থে ধর্মের সংজ্ঞায়নে সংস্কৃতির তুল্যমূল্যতা‘র চেয়ে ইতিহাসের তৈয়ার গুলো আমার কাছে বিবেচ্য হয়েছিল, যেটি যেকোন সমাজেই প্রয়োগ সম্ভব।
এরকম একটি বিতর্ক বেশ প্রচলিত আছে যে, ব্যক্তিক পরিসরে ধর্মের সংকোচনের মধ্যদিয়ে পশ্চিমের আধুনিকীকরণ (মডার্নাইজেশন) প্রকল্প‘র চুড়ান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হবে; যদিও ধর্ম নিজেকে জনপরিসরেই উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু আধুনিকায়নের এধারনা একটি অসম্পূর্ণ বা ব্যর্থ প্রকল্পই উৎপাদন করে মাত্র। অথবা সমাজ ঐতিহ্যের শেষ চিহ্ন হিসেবে ধর্ম আধুনিকতার অপ্রতিরোধ্য বিজয়ে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়- এবিষয়ে আপনার অভিমতটি কেমন?
নিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে এটি একটি তত্ত্বই মূলতঃ। কিন্তু এভাবে চিনত্মা করা সঠিকও হবেনা যে, অনেকদিন ধরে যে সত্যটি তৈরী হয়ে আছে, ইতিহাস পরিসমাপ্ত। উনিশ শতকের শুরুর থেকে বিবিধ আলোচনায় এবিষয়টিও পরিষ্কার নয়, কথিত ধর্মের পরিসমাপ্তি কি করে একেবারেই একটি সহজ ব্যপার। এছাড়া লক্ষ্যনীয়, রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার যে ভাবনা মানুষ পোষন করে সেটি কিছু সুনির্দিষ্ট (প্রকরণের) দেশেই কেবল অভিযোজিত হতে পরেছে।
এখানে পশ্চিমের তিনটি রাষ্ট্রের উল্লেখ হতে পারে যেগুলো অন্যদের কাছে উদারনৈতিক, গনতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিশেবে উপস্থাপিত হয়; আর এগুলো হচ্ছে- ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। খুব পরিকল্পিত ভাবে বলি যদি, ফ্রান্স একটি রাষ্ট্র হিশেবে এবং একটি সমাজ হিশেবে ধর্মনিরপেক্ষ। আর ইংলেন্ডে যদিও একটি প্রতিষ্ঠিত ধর্ম রয়েছে, তবুও এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ। এবং যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে একটি নিবিড় ধর্ম-সমাজ, রাষ্ট্র হিশেবে এটি ধর্মনিরপেক্ষ। এছাড়া ধর্ম ও রাজনীতি এখানে নিজস্বতার বাইরে এসে ভিন্ন ভিন্ন সমঝোতার পথ রচনা করে। ফলে এখানে, আলোচ্য তিন সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যেও রয়েছে এবিষয়ে সংবেদনশীলতার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। এক্ষেত্রে মানুষ এমন সব ভুল প্রতিক্রিয়াও করে যা ধর্মনিরপেক্ষতার মূল ভাবনার বিপরীত।
উদাহরণ স্বরূপ: এমন সংবেদন প্রতিক্রিয়ার প্রমান মেলে, ফ্রান্সের মুসলিম মেয়েদের সরকারী স্কুলে হিজাব পরিধানের বৈধ অনুমতি দেয়া নিয়ে বিতর্কে। বিষয়টি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের মধ্যে একটি নেতিপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে; যেখানে সরকারী স্কুলে ইয়াহুদিদের ইয়ারমূলকা (ধর্মীয় প্রতীকী টুপি) পরবার বিষয়ে তাদের কোন প্রতিক্রিয়াই নেই। আমি এখানে অনৈতিক অসাম্যর বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছিনা; বরং আমি বলতে চাইছি একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে জনপরিসরে ধর্মীয় প্রতীকের ব্যবহার নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের যে বিবিধ রাজনৈতিক মূল্যায়ন তার প্রকৃত অর্থবোধকতার কথা। অন্যদিকে আমেরিকার কথা যদি বলি; এখানে ধর্ম এবং রাষ্ট্রের মধ্যকার দূর-সম্পর্ক নিরুপনে পরিষ্কার নিয়মনীতি যদিও রয়েছে, কিন্তু তবুও এটি বর্তমান আমেরিকান প্রশাসনে ‘ধর্মভিত্তিক’ (ননসেক্যুলার) রাজনৈতিক কর্মকান্ডকে প্রতিহত করতে অপারগ। যেমন আমরা যেভাবে জানি যে, খৃষ্টানদের অধিকারের বিষয়টি বুশ সরকারের অন্তরবস্তু হিশেবেই আছে। এটি আমেরিকায় অবস্থিত জাইওনিস্ট (ইহুদি স্বরাজের স্বপ্নধারী) সংস্থা সমূহের এন্টি-সেমেটিক একটি জোট, যার রাজনৈতিক ভাবনা হচ্ছে বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর ও শয়তানের মধ্যকার যুদ্ধটি (Armageddon) শুরু করা এবং এই স্বপ্নের সঠিক প্রারম্ভটি ইরাকের সাথে যুদ্ধ দিয়েই এগিয়েছে। এভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ যুদ্ধ সমর্থিত হয়েছে ধর্মীয় কারণ দিয়ে। এখানে আবার বলি, ধর্মের অধিকার নিয়ে কারো বিরোধীতা করবার জন্য আমার এ বক্তব্য নয় (আমি এরূপ আচরনের অবশ্য-বিরোধিতা করে), বরং এ সত্যটি তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য যে একটি সেক্যুলার রাষ্ট্র উপর-উক্ত রকমের পলিটিকস অনায়াসেই খেলতে পারে, যেকোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই।
আর তাই আমার মনে হয়, আমাদের এখন সেই শুরুর প্রশ্ন নিয়ে শুরু করা উচিৎ যে কোনটি আধুনিকতা আর কোনটি নয়; এবং কোন বিষয়টি স্বভাবতঃই একটি উদারনৈতিক আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় সমাজ পরিবর্তনে আধুনিকতার গতিপথটি প্রথমেই বিবেচ্য হওয়া উচিত; যেখানে মানুষের সহাবস্থান চর্চা, পরিবর্তন-প্রকৃতি এবং পূণঃ গ্রহণযোগ্যতা দিয়ে সকল মানিয়ে নেওয়ার বিষয়গুলো সম্পৃক্ত থাকবে। কেননা এই পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিশেবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির জন্ম। আর এজন্যই আধুনিকতা-ধর্মনিরপেক্ষতা‘র প্রসঙ্গ সমূহ নিশ্চিন্ত কোন মামুলি কিস্সা নয়। সকলের জন্য আধুনিকতা একটি অবসম্ভাবী গন্তব্য- এমন চিন্তাকে আমি প্রশ্নাতিত ভাবে মেনে নিতে নারাজ। এমনও একটি চিন্তা আছে যেখানে আধুনিকতাকে ইতিহাসের একটি স্তর হিশেবে বিবেচনা করে, তবে মানুষ এমন সময়ের মধ্যদিয়ে বসবাস করে। আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারিনা, আধুনিকতার মাঝে এমন ধারনাও অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে যে, মানুষ একটি কথিত উদারনৈতিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই প্রত্যাশা করে।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মার্চ, ২০০৯ সকাল ৮:২৬