আইরার শ্বাস প্রায় থেমে যাচ্ছিল। পিঠে লাগানো দেয়ালের ঠাণ্ডা কাঁপুনি তার গায়ে শিরশির করে বেড়াল। শত্রু সৈন্যদের পায়ের শব্দ যত কাছে আসছিল, তাদের হাসির নিষ্ঠুরতা ততই তার মুঠোয় চাপা ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে দিল। সে বাবার দেওয়া লকেটটি বুকে চেপে ধরল—এই ক্ষুদ্র ধাতব টুকরোই তাকে মনে করিয়ে দিত, সে একা নয়।
“একটা বাচ্চা! হেডকোয়ার্টার এত ভয় পেয়েছে একটা বাচ্চার জন্য?” একজন সৈন্য ফিসফিস করে বলল।
আইরা চোখ বুজে মুখ গুঁজে রইল। বাবা... তুমি বলেছিলে ওই রোবটটা আমার পাশে থাকবে... তার মনে পড়ে গেল, সেই পুরনো রোবটটি কীভাবে তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করত, কীভাবে মাঝে মাঝে তার হাতে ভাঙা প্লাস্টিকের ফুল গুঁজে দিত—যেন যান্ত্রিক হাতেও স্নেহ লুকিয়ে আছে।
“বাচ্চা না, জেনারেলের মেয়ে,” অন্যজন জবাব দিল। “ওকে ধরতে পারলে তোর বোনাস ট্রিপল হবে, বুঝলি নাকি?”
ঠিক সেই মুহূর্তে, অন্ধকারে এক বিকট শব্দ—যেন লোহার বুকে বজ্রপাত! আইরা চমকে চোখ খুলতেই দেখল, সৈন্যরা পিছিয়ে যাচ্ছে।
“শালা! এটা আবার কী?”
রোবটটি সামনে এগিয়ে এল। তার মরিচা ধরা শরীরে গুলির দাগগুলো দেখে আইরার চোখে জল এসে গেল—সবটা তার জন্যই। রোবটের চোখের লাল আলো আজ একটু নরম, যেন অন্ধকারে জ্বলা একটি মোমবাতি।
“ওল্ড মডেল,” একজন সৈন্য ঠাট্টা করে হেসে উঠল। “বস্তির জংধরা রোবট ! কী করবি তুই, বুড়ো শালা?”
রোবটের গলার আওয়াজ যেন দূরের গর্জন, কিন্তু কথা শুধু আইরার জন্য: “ভয় পেয়ো না, ছোট্টটি। আমি আছি।”
“হাহ! গুলি কর এই মরচে ধরা টিনের কৌটাকে!”
শত্রুদের ট্যাঙ্কের মেশিনগান থেকে গুলির বৃষ্টি নামল। ট্যাং-ট্যাং-ট্যাং-ট্যাং! রোবটের ভারী লোহার বুকপ্লেটে গুলি আঘাত করে স্ফুলিঙ্গ ছড়াল। আইরা দুই হাতে কান চেপে চিৎকার করে উঠল, “ওদের থামাও!” রোবটটি ঝাঁপ দিয়ে সামনে এগোতেই ট্যাঙ্কের মূল কামান গুড়ুম! শব্দে আঘাত করল। বিস্ফোরণের ধাক্কায় রোবটের পুরো শরীর বাতাসে উড়ে গিয়ে পিছনের ইটের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ল। দেয়ালের প্লাস্টার খসে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে গেল।
“এবার নিশ্চয় মরেছে?” একজন সৈন্য চেঁচিয়ে উঠল।
তার বুকের প্লেটে গভীর দাগ, কিন্তু সে মাথা নাড়ল, “ক্ষতি... সামান্য।” রোবটটি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। ট্যাঙ্ক আবার গর্জে উঠল। রোবট দৌড়ে পাশ কাটাল, কিন্তু এবার নিশানা করল ট্যাঙ্কের উপরের কংক্রিটের বারান্দা। তার ডান হাতের গ্যfটলিং গানের মাজল ঘুরতে আরম্ভ করল, গিরররররর শব্দে মুহুর্তের মধ্যে অনেকগুলি বুলেট ছুটে গেল। গুলির চোটে বারান্দার সাপোর্ট বিম ভেঙে গেল। গড়গড় শব্দে বিশাল কংক্রিটের স্ল্যাব ট্যাঙ্কের উপর আছড়ে পড়তেই, ট্যাঙ্কের কামানের নল বেঁকে গেল—নিষ্ক্রিয়!
হঠাৎ তার চোখের লাল আলো সংকীর্ণ হয়ে এল—স্নাইপার মোড সক্রিয়। ডানে-বায়ে উড়তে থাকা ড্রোনগুলোর দিকে ক্রসহেয়ার লক করতেই, প্যাং-প্যাং-প্যাং! তিনটি ড্রোন আকাশেই ফেটে আগুনের গোলক হয়ে নিচে পড়ল।
“এদিকে!” রোবট আইরার হাত টেনে নিয়ে ছুটল পাশের পরিত্যক্ত ভবনের দিকে। আকাশ থেকে শত্রুর ড্রোনের ঝাঁক গুলি বর্ষণ করছিল। রোবট পিছন ফিরে এক হাত দিয়ে ফট-ফট-ফট! গুলি ছুঁড়ে দুটি ড্রোন ধ্বংস করল, অন্য হাত দিয়ে আইরাকে ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে উপরে তোলা শুরু করল। আইরার শ্বাস ছোট হয়ে আসছিল, তার জামার আস্তিন রোবটের ধাতব আঙুলে আটকে গেল—কিন্তু রোবটের হাতের মৃদু তাপে তার গায়ে এক অদ্ভুত সান্ত্বনা ছড়াল।
“আমি... আর পারছি না,” আইরা কাঁপতে কাঁপতে বলল।
“তুমি পারবে,” রোবটের কণ্ঠে একটু কম্পন, “কারণ আমি তোমার সঙ্গে আছি।”
ছাদের কাছাকাছি পৌঁছাতেই রোবট হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। উপরে,বুলেট প্রুফ ভারী হেলিকপ্টারের পাখা ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু পেছন থেকে ড্রোনের ঝাঁক আরো কাছে চলে আসছে! রোবট আইরাকে ছাদের উপর ঠেলে দিয়েই পিছন ফিরে দাঁড়াল। তার দুই বাহু রূপান্তরিত হয়ে গেল দ্বৈত মেশিনগানে। ড্যাগ-ড্যাগ-ড্যাগ! আগুনের রেখা আকাশ কাঁপিয়ে দিল।
“শীঘ্র উঠে যাও!” রোবট গর্জে উঠল। আইরা হেলিকপ্টারের দরজা ধরতে গিয়েই দেখল, রোবটের পায়ের জোড়া থেকে বিজলী ছিটকাচ্ছে। সে ফিরে তাকাতেই রোবট আরো জোরে চিৎকার করল, “চলে যাও! এখনই!”
শেষ মুহূর্তে রোবট লাফিয়ে হেলিকপ্টারে উঠল। ড্রোনের গুলি গুলিরোধী কাচে টকটক শব্দ করতে লাগল। পাইলট জোরে উড়াল দিতেই আইরা দেখল, রোবটের কাঁধে গভীর ফাটল—ভেতরে নীল আলো ঝিলিক দিচ্ছে।
“তোমার... তোমার ক্ষতি হয়েছে,” আইরার গলা আটকে আসল।
রোবট তার মরচে ধরা হাত দিয়ে আইরার মাথায় স্পর্শ করল, “এগুলো শুধু দেহের ক্ষত। আমার হৃদয়... এখনো অটুট।”
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০২৫ ভোর ৪:১০