somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অচেনা দিগন্ত (পর্ব-৩)

১৮ ই মার্চ, ২০২৫ দুপুর ২:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গভীর যান্ত্রিক গর্জন ধীরে ধীরে জমতে থাকল, যেন বিশাল কোনো জেট ইঞ্জিন সক্রিয় হচ্ছে। ক্রাফ্টের চারপাশে আলো ঝলসে উঠল, হালকা মেঘের মতো ঘনিয়ে এল তরঙ্গায়িত আলোর আস্তরণ। মুহূর্তের মধ্যেই সবকিছু এক তীক্ষ্ণ শব্দে চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেল। শূন্যতা নেমে এল, যেন পৃথিবীর সমস্ত শব্দ একসঙ্গে গিলে নিয়েছে এই অদৃশ্য শক্তি।

হঠাৎ করেই ড. নায়লা অনুভব করল, সে আর পৃথিবীতে নেই। বুক ধক করে উঠল। গভীর শ্বাস নিয়ে সে চারপাশে তাকাল।

"আলিজা..." তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, "সবকিছু ঠিক আছে তো?"

আলিজার শান্ত, নির্বিকার কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হল, "হ্যাঁ, সব সিস্টেম স্বাভাবিক। আপনি সফলভাবে ট্রান্সপোর্ট সম্পন্ন করেছেন।"

নায়লা একটু দম নিল। সে বেঁচে আছে। সম্পূর্ণ অক্ষত।

তার ক্রাফ্ট এখন ভেসে আছে, ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার ওপরে, অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি প্রোপালশন সিস্টেমের শক্তিতে। নিচের পৃথিবীটা যেন একইসাথে পরিচিত আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ড. নায়লা ধীরে ধীরে তার ক্রাফ্টটিকে আরও নিচে নামাল। নতুন এই পৃথিবীটাকে যত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল, ততই তার শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল। উপরের দিক থেকে দেখলে মনে হচ্ছিল, পুরো ভূমিটাই যেন এক রহস্যময় ছকের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে।

নীচের পৃথিবীটা পরিচিত হয়েও অচেনা। কোথাও সবুজ গহীন জঙ্গল, কোথাও ধূসর পাথুরে সমভূমি, আবার কোথাও বিশাল মরুভূমির বিস্তার, যেখানে বাতাসের সাথে মিলেমিশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধূসর ধোঁয়া, যেন অতীতে কোনো ভয়ংকর কিছু এখানে ঘটেছিল। এই ধোঁয়া শুধু মরুভূমির বালুকণা নয়, এতে একধরনের অদৃশ্য শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, যা এক অজানা ভাষায় ফিসফিস করে চলে।

দূরে, বিশাল এক নদী তার চওড়া বুক উজাড় করে বয়ে চলেছে, কিন্তু এর রং স্বাভাবিক নীল নয়, বরং গাঢ় বেগুনি আর রক্তিম আভা মিশ্রিত, যেন এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো অতিপ্রাকৃত রহস্য। নদীর পানি ধীর গতিতে প্রবাহিত হলেও মাঝে মাঝে তাতে বিদ্যুতের ঝলক দেখা যায়, যেন এটি সাধারণ জলধারা নয়, বরং কোনো অজ্ঞাতশক্তির বাহক।

"এই নদী কী ধরনের?" নায়লা ফিসফিস করে বলল।

"পর্যবেক্ষণ চলছে," আলিজা উত্তর দিল। "এই পানিতে উচ্চ মাত্রার অজানা শক্তি রয়েছে, যা বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত। তবে এই শক্তির উৎস এখনও অজানা।"

নায়লা শিহরিত হল। এটি যেন এক মৃত সভ্যতার রক্তধারা, যেখানে একসময় শক্তির অপার রহস্য লুকিয়ে ছিল।

নায়লা ক্রাফ্টের জানালা দিয়ে দূরের বিশাল পিরামিডগুলোর দিকে তাকাল। এরা শুধু স্থাপনা নয়, বরং যুগের পর যুগ ধরে এক রহস্যময় শক্তির পাহারাদার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটি পিরামিডের গায়ে খোদাই করা আছে বিশাল অজানা চিত্রলিপি—কোনো মানুষ, পশু বা দৈত্যের সংমিশ্রণ। কিছু মূর্তি ছিল দৈত্যাকার, তাদের মুখ বিকৃত, চোখের কোটরে যেন এক চিরন্তন শূন্যতা। মনে হচ্ছিল, এসব পাথরের ভাস্কর্য শুধুই শিল্পকর্ম নয়, বরং তারা কিছু পাহারা দিচ্ছে—অথবা কিছু আবদ্ধ করে রেখেছে।

এই বিশাল স্থাপনাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাথরের মূর্তিগুলোর চোখ ছিল অদ্ভুত। এগুলো প্রাণহীন পাথরের চেয়ে অনেক বেশি কিছু। মনে হচ্ছিল, তারা তাকিয়ে আছে, পর্যবেক্ষণ করছে। হালকা বাতাস বইতে থাকলেও কোথাও কোনো শব্দ নেই, যেন এই পৃথিবী প্রাণবিহীন, অথচ একই সঙ্গে অতিমাত্রায় সচেতন।

"আলিজা, কোনো প্রাণের অস্তিত্ব শনাক্ত করতে পারছ?" নায়লা ফিসফিস করে বলল, যেন সে নিজেই কাউকে বিরক্ত না করে ফেলে।

"হ্যাঁ, কিন্তু এরা আমাদের মতো জৈবিক নয়," আলিজার কণ্ঠস্বর সামান্য ভারী হয়ে গেল। "তারা এখানে আছে, কিন্তু স্থির—যেন আমাদের অপেক্ষায়।"

নায়লার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল।

হঠাৎ করেই নায়লা অনুভব করল, চারপাশের পরিবেশ শুধুমাত্র তার চোখে ধরা পড়ছে না—সে এটি অনুভব করতে পারছে! প্রথমে সে ভেবেছিল, এটি তার কল্পনা। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, তার চারপাশের প্রতিটি কণা, প্রতিটি পাথর, প্রতিটি ছায়া—এরা তার উপস্থিতি অনুভব করছে এবং সাড়া দিচ্ছে!

তার চোখ বন্ধ করলেও সে দেখতে পাচ্ছিল। অনুভব করতে পারছিল, মন্দিরগুলোর ভেতরে কিছু আটকে আছে, যা শত শত বছর ধরে মুক্তির অপেক্ষায়। কোথাও কোনো দৃশ্যমান প্রাণী নেই, কিন্তু এক অদৃশ্য উপস্থিতির শীতল শ্বাস সে অনুভব করতে পারছিল।

তার ভেতর একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।

"আমাকে ফিরে যেতে হবে..." সে বিড়বিড় করে বলল। "এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।"

"আপনি নিশ্চিত?" আলিজার কণ্ঠস্বর একইরকম নিরাসক্ত, কিন্তু কোথাও যেন একটা সন্দেহের ছোঁয়া ছিল।

নায়লা নিজেকে জোর করল।

"হ্যাঁ, আমি ফিরে যাচ্ছি!"

সে দ্রুত ক্রাফ্টের কন্ট্রোল প্যানেলে হাত রাখল, রিটার্ন কমান্ড দিতে যাবে—ঠিক তখনই...

একটা ফিসফিসানি ভেসে এল, সরাসরি তার মনের ভেতরে।

সে হতভম্ব হয়ে গেল। এ কিসের শব্দ?

শব্দটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হল—একটি প্রাচীন ভাষার বয়ে চলা শব্দরাশি, যার অর্থ সে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু অনুভব করছিল। এই ভাষা অদ্ভুত, গা শিউরে ওঠার মতো, যেন বহু পুরোনো কিছু তাকে ডেকে নিচ্ছে, তার কৌতূহলকে ধীরে ধীরে ছিনিয়ে নিচ্ছে।

তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। আতঙ্কের সাথে একই সাথে প্রবল কৌতূহল তার মধ্যে কাজ করতে লাগল।

নায়লা চোখ বন্ধ করল, গভীর শ্বাস নিল।

তার মনে একটা দ্বিধা কাজ করছিল।

যদি সত্যিই ফিরে যায়? তাহলে হয়তো সে সবচেয়ে বড় রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও কিছুই জানতে পারবে না!

এখানে কিছু আছে। কিছু বিশাল, কিছু ভয়ংকর, কিছু অজানা।

এবং এই অজানা তাকে ফিরে যেতে দিচ্ছে না।


সে চোখ খুলল, হাত নামিয়ে নিল কন্ট্রোল থেকে।

"আলিজা, আমি এখানেই থাকছি।"

"আপনার সিদ্ধান্ত নথিভুক্ত করা হল, ড. নায়লা।"

ক্রাফ্টের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন মহাবিশ্ব নিজেই তার সিদ্ধান্তকে শূন্যে লিখে রাখল।

নায়লা জানত, সে এমন এক জায়গায় প্রবেশ করেছে যেখান থেকে ফিরে আসার পথও হয়তো তার নিয়ন্ত্রণে নেই।

তবু, সে রইল।

এই পৃথিবী তাকে ডাকছে—একটি অতল গভীর রহস্যের দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আহত আততায়ী

লিখেছেন রাজীব নুর, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ সকাল ১০:৩০



সভ্য নগরের মানুষ যেনবা বনমানুষ।
মানুষকে মানে না মানুষ;
আর মানুষের হানাহানি দেখে হাসে বনের মানুষ।

পথে না বেরোলে জানতামই না-
কতটা রপ্ত করেছি আমরা অবজ্ঞা অবহেলা ও পরচর্চা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ টাকার চাল ইতিহাসের সেরা দাম (এখন ৮৫), এই দামে ওনাদের চোখে পানি আসেনা৷

লিখেছেন আহসানের ব্লগ, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ১২:০৭

আমার বাবা সরকারি চাকরী করছে, একাই বিশাল যৌথ ফ্যামিলি চালাইসে৷ যার ফলে প্রচুর ঋণ হইসে৷ কিন্তু কোনোদিন চুরি করেন নাই৷ গ্রামীন ব্যাংক থেকে বাবা ১০ হাজার টাকা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস ওয়ান ম্যান আর্মি!!!!!

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ দুপুর ২:৩২

ইন্টারিম সরকারে প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর একের পর এর চমক দিয়ে যাচ্ছেন ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস। ভঙ্গুর, মেরুদন্ডহীন শাসন ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু, গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি চলে যাওয়া একটি দেশের দায়িত্ব কাঁধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফ্রিল্যান্সারদের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ আটকে রাখার ষড়যন্ত্র: পেপ্যাল চালু না করার পেছনে কাদের হাত?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭

ফ্রিল্যান্সারদের রক্ত-ঘামে অর্জিত অর্থ আটকে রাখার ষড়যন্ত্র: পেপ্যাল চালু না করার পেছনে কাদের হাত?

পেপ্যাল লোগোটি বিবিসি ওয়েব পেইজ থেকে সংগৃহিত।

ভূমিকা

বিশ্বের প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমবাজারে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীরা এখন এক অনস্বীকার্য শক্তি। আপওয়ার্ক,... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতীয় সার্কাস দল!!

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১০ ই এপ্রিল, ২০২৫ রাত ৮:১৫

আওয়ামিলীগ আমলে আওয়ামি মন্ত্রী এম্পিরা বিনোদনবঞ্চিত :( এই দেশের জনগনকে বিনোদিত করত তাদের বিভিন্ন মন্তব্যের দ্বারা। এখন এই স্থান একছত্রভাবে দখল করেছে বিএনপি !! দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদেরই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×