০১.
শেষ রাত্রে লন্ঠনের টিমটিমে আলোর নিচে আমরা পাঁচজন রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলাম। আমি,ডেভিড,শান্তনু,লুকো শি আর ফ্র্যান্কেনস্টাইন। আমরা কথা বলছিলাম কিছু সাংকেতিক ধ্বনি ও ইশারার মাধ্যমে যার অর্থ কেবল আমরাই বুঝতে সক্ষম। আমাদের ঠোঁটের আগায় জানালার কার্নিশের মৃত বাদুড়ের মত ঝুলে থাকা পৈশাচিক ক্রূর হাসিই বলে দিচ্ছিল উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমরা যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত। অত্যন্ত গোপনীয় ও স্পর্শকাতর এই বৈঠকের সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তার সব ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছিল। আমাদের বৈঠকের ঘরটি ছিল কঠোর ও নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মোড়ানো। এমনকি ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে একটি ছোট পিঁপড়েও যেন ঢুকতে না পারে আমরা তা নিশ্চিত করেছিলাম। যে গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভারটি আমাদের কাঁধে এসে পড়েছে আমরা তা সফলভাবে সমাপ্ত করতে বদ্ধপরিকর ছিলাম এবং এধরনের একটি কাজে নিজেদের নিযুক্ত করতে পেরে মনে মনে গর্ব অনুভব করছিলাম। আমরা জানতাম যে আমরা বিশেষ কেউ এবং পৃথিবীর ভবিষ্যত ইতিহাস আমাদের হাতেই রচিত হতে চলেছে। সুতরাং আমরা তার সাথে কোনো ধরনের সমঝোতা করতে প্রস্তুত ছিলাম না।
০২.
বাইরে তখন রাতশেষের ভূতুড়ে অন্ধকার আকাশের এক কোণে অস্পষ্ট একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা দিচ্ছে মাত্র। আমরা তাকে পকেটে পুরে নিয়ে দ্রুত হাতে আমাদের ছড়ানো ছিটানো অস্ত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলাম এবং নিজেদের শেষ মুহূর্তের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে নিচ্ছিলাম। ডেভিড ছিল আমাদের ন্যারেটরের ভূমিকায়। সে গোটা পরিকল্পনার ছকটি আমাদের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুংখানুপুংখ ভাবে বুঝিয়ে একটুখানি দম নিল । তারপর ইশারায় আমাকে কিছু বলার ইঙ্গিত দিল। আমি প্রায় জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে হাত থেকে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম এবং সতর্ক দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশটায় চোখ বুলিয়ে নিলাম। অবশেষে আমার বাকি চার সঙ্গীর দিকে একটি অর্থপূর্ণ হাসি নিক্ষেপ করে বললাম, "প্রিয় সঙ্গীগণ, আপনাদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন এই বিশেষ কাজে নিজেদের সহযোগীতার হাত নির্দ্বিধায় বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। আশা করি আমাদের অভিযান সফল হবে এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হব আমরাই।" কথা শেষ হওয়ামাত্র আমার সঙ্গীরা হর্ষধ্বনি করে উঠলো এবং শেষবারের মত আমরা হাত মিলিয়ে একে অপরের সাথে করমর্দন করে নিলাম। অতঃপর নিখুঁত ছক কাটা পরিকল্পনা অনুসারে রাতের আঁধার মিলিয়ে যাবার পূর্বেই আমরা যে যার নির্দিষ্ট অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে আমাদের কাঙ্খিত অভিযান বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
০৩.
পৃথিবীর মাটিতে ঈশ্বরের আগমনী বার্তা শোনা যাচ্ছিল বহুদিন ধরেই। সর্বশেষ জানতে পাওয়া গেল, মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়েছে ঈশ্বরের বীজ। এই সংবাদকে পৃথিবীবাসী গ্রহণ করেছিল ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্ন মাত্রায়। একদল ছিল ভীত,একদল আনন্দে উদ্বেল আর সবচেয়ে বেশিসংখ্যক সংশয়াবিষ্ট। তারা ঘন কুয়াশার চাদরের ভেতর ভেসে ভেসে সাঁতার কাটছিল সন্তর্পনে। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেছিল কুয়াশার জাল কেটে দিয়ে কোনো এক সকালে ছদ্মবেশহীন সূর্যের আলোতে চোখ মেলার। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দলটি ছিল ক্রুদ্ধ। তারা জানত, ঈশ্বরের আগমনে তাদের অস্তিত্ব হবে সংকটাপন্ন। যে গোল কমলালেবুকে তারা এতকাল ধরে হাতের তেলোয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে করেছে আপন সাম্রাজ্যের বিস্তার তার নিয়ন্ত্রণ তারা হারাবে চিরতরে এবং তাদের ঘূণে ধরা মাত্স্যন্যায়ী সাম্রাজ্যের হবে অবশ্যম্ভাবী পতন। সুতরাং তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে আসন্ন সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে থাকলো এবং গোপনে সবার অলক্ষ্যে সুকৌশলে জন্মমূহুর্তেই ঈশ্বরকে হত্যা করে পৃথিবীতে নিজেদের স্থান চিরস্থায়ীভাবে সুরক্ষিত করার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা আঁটতে লাগলো। পৃথিবীবাসী এই ভয়ানক ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারল না। তারা রোজকার মত কর্মব্যস্ত দিনের যাবতীয় ক্লান্তির শেষে অবসাদ ঝেড়ে ফেলে পরবর্তী কোনো প্রত্যুষে তাদের ত্রাণকর্তার আবির্ভাবের সুখস্বপ্ন মনে নিয়ে বিছানায় গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সুখনিদ্রায় ঢলে পড়ল।
০৪.
আমাদের অভিযানের কেন্দ্রস্থল ছিল নগর থেকে বেশ খানিকটা দূরে লোকালয় ছাড়িয়ে অপেক্ষাকৃত শান্ত ও নির্জন একটি পর্বতঘেরা স্থানে। অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্রে আমরা খবর পেয়েছিলাম সেখানেই একটি গোপন সুরক্ষিত গুহায় আজ সূর্যোদয়ের মুহূর্তে মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হবে তথাকথিত শক্তিধর ঈশ্বর যার আগমনের অপেক্ষায় সারা পৃথিবীবাসী যুগপৎ কৌতুহল ও সংশয় নিয়ে বসে আছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সূর্যোদয়ের পূর্বেই আমরা আমাদের অভিযানস্থলে পৌছে যে যার নির্দিষ্ট অবস্থান নিয়ে নিলাম। শান্তনুর দায়িত্ব ছিল গুহার নিরাপত্তারক্ষীদের হত্যা করে আমাদের ভেতরে প্রবেশের পথ সুগম করা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সে নিখুঁত হস্তে একে একে গুহার প্রবেশদ্বারে পাহারারত সকল নিরাপত্তারক্ষীর শিরোশ্ছেদ করে তাদের মৃতদেহগুলি ছুঁড়ে ফেলে দিল পাহাড়ের খাদে। অতঃপর আমরা সকলে এক এক করে গুহার ভেতরে প্রবেশ করলাম। বিড়ালের মত সাবধানী পা ফেলে গুহার ভেতর কিছুদূর হেঁটে যেতেই অবশেষে আমরা দেখতে পেলাম আমাদের লক্ষ্যবস্তুকে। ঈশ্বরের গর্ভধারিনী মা গুহার এক কোণে একটি উজ্জ্বল আলোকবিচ্ছুরণকারী চাটাইয়ে শুয়ে অকল্পনীয় প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার আর্তচিত্কারে গুহা ভেদ করে সমস্ত পর্বতভূমি ও আকাশ থেকে থেকে কেঁপে উঠছিল। আমরা ভীত হয়ে উঠলাম- পাছে তার আর্তধ্বনি পৌঁছে যায় পৃথিবীবাসীর কানে এবং তারা আসন্ন ঘটনাবলী সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়ে। ডেভিড তাই দ্রুত তার তৈরী একটি বাকশক্তি হরণকারী তিতকুটে তরল পদার্থ এনে জোরপূর্বক তাকে খাইয়ে দিল। লুকো শি দ্রুত হাতে তার হাত পা চারিদিক থেকে শক্ত অচ্ছেদ্য রজ্জু দিয়ে বেঁধে দিল যেন সে আমাদের কার্যকলাপে কোনভাবেই বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম ঈশ্বরের ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্তের।
অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ - যার জন্য আমাদের এতদিনের এত অসহ্য যন্ত্রনাদায়ক প্রতীক্ষা ও পরিকল্পনা। সমগ্র আকাশ বাতাস ও চরাচর কাঁপিয়ে গর্ভধারিণীর সুতীব্র চিত্কারের মাঝে ভূমিষ্ঠ হলো নবজাত ঈশ্বর এবং সুতীক্ষ্ণ ক্রন্দনধ্বনির মাধ্যমে পৃথিবীতে ঘোষণা করলো তার আগমন ধ্বনি। তার জ্যোতির্ময় শরীর থেকে বিচ্ছুরিত তীব্র আলোকচ্ছটায় আমাদের চোখ ঝলসে যাবার উপক্রম হলো। কিছু মুহূর্তের জন্য আমরা অন্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু যে কাজ সম্পন্ন করতে আমরা এসেছিলাম তা অসমাপ্ত রেখে ফিরে যাবার পাত্র আমরা ছিলাম না। সুতরাং সেই অবস্থাতেই আমরা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে আমাদের অস্ত্রশস্ত্র খুঁজে বের করলাম। অবশেষে তীব্র আলোয় আমার চোখ কিছুটা সহনীয় হয়ে এলে আমি দৃঢ়পায়ে আমার লক্ষ্যবস্তুর দিকে অগ্রসর হলাম। অতঃপর আমার হাতের রামদা দিয়ে ক্যাচ করে সদ্য প্রসূতির গর্ভনালীতে প্রচন্ড এক ধারালো কোপ বসিয়ে নিমেষেই মাতৃশরীর থেকে ছিন্ন করে ফেললাম শিশু ঈশ্বরকে এবং তাকে হস্তান্তর করলাম আমার সহযোগী ফ্র্যাঙ্কের হাতে। প্রসূতির জরায়ু থেকে এক ঝলক রক্ত ছলকে পড়ল মাটিতে। আমি তার রক্তাক্ত জরায়ু আমার নৃশংস হাতের হ্যাচকা টানে টেনে ছিঁড়ে ফেললাম এবং প্রবল আক্রোশে তার বিচ্ছিন্ন জরায়ু খন্ডটি ছুঁড়ে ফেললাম দূরে। সে তীব্র যন্ত্রণায় অমানুষিক আর্তনাদ করে উঠলো। কিন্তু তার আর্তনাদে কান দেবার মত সময় আমাদের হাতে ছিল না। আমি তার যন্ত্রণা চিরস্থায়ীভাবে দূর করে দেয়ার ব্যবস্থা করলাম। তার চারপাশে কিছু খড়কুটো জমা করে তাতে আগুন ধরিয়ে তাকে অগ্নিশয্যায় শায়িত করে সদ্যজাত ঈশ্বরকে হাতের তালুতে নিয়ে আমরা গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। পেছনে তার গর্ভধারিণী মাকে বক্ষে ধারণ করে নিয়ে অগ্নিগুহা জ্বলতে লাগলো দাউ দাউ করে..........
০৫.
আমরা সদ্যজাত ঈশ্বরকে নিয়ে ছুটে যাচ্ছিলাম লোকালয়,পাহাড় পর্বত,সমুদ্র ও মরুভূমি ছাড়িয়ে ক্রমশ দূর থেকে দূরে। অবশেষে এক দুর্গম ঘন জঙ্গলে এসে আমরা স্থির হলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই আমরা ঈশ্বরের চিরসমাধি রচনা করব এবং পৃথিবীর ইতিহাস থেকে মুছে দেব তার অস্তিত্ব। কিন্তু আমরা জানতাম সমগ্র পৃথিবীবাসী অধীর আগ্রহে ঈশ্বরের আগমনের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে। সুতরাং তাদের চোখে ধূলো দেয়ার জন্য আমরা সামান্য কৌশলের আশ্রয় নিলাম। প্রথমেই আমরা শিশু ঈশ্বরের শরীর থেকে নিপুণভাবে তার চামড়া তুলে আলাদা করে নিলাম। অতঃপর তার দেহের আদলে বুনো মাটি দিয়ে নির্মাণ করলাম নতুন এক দৈহিক কাঠামো। বিষাক্ত জংলী গাছপালা দিয়ে তৈরী করলাম চুল আর বুনো মোষের দাঁত ভেঙ্গে এনে বানালাম নখ। তার উপর শিশু ঈশ্বরের গায়ের চামড়া নিপুণভাবে সেঁটে দিয়ে আমরা জন্ম দিলাম নতুন এক ঈশ্বরের। সবশেষে মৃতপ্রায় ঈশ্বরের ত্বকহীন নগ্ন দেহকে পুঁতে দিলাম আমাদের খুঁড়ে রাখা কবরে এবং তার ওপর কয়েকশ ফিট মাটিচাপা দিয়ে চিরদিনের মত রুদ্ধ করে দিলাম তার কন্ঠস্বর। এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিপত্তিকে এত অবলীলায় পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পেরে আমরা সকলে যারপরনাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং ঈশ্বরের সমাধির উপর পৈশাচিক উল্লাসনৃত্য করতে করতে আমরা দৃশ্যতঃ আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললাম। আমি হাত দুটোকে মুষ্টিবদ্ধ করে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলাম আর মত্ত স্বরে চিত্কার করতে করতে বললাম, আমি জানতাম আমি জয়ী হবই, আমি জয়ী হবই এবং অবশেষে আমিই জয়ী হলাম..................
০৬.
ঈশ্বরের মৃত্যুর সাথে সাথেই অবধারিতভাবে আমরা কিছু শক্তিশালী অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলাম। আমরা সেই ক্ষমতাবলে আমাদের অলৌকিক যাদুদন্ড নেড়ে নেড়ে সমগ্র পৃথিবীবাসীকে কিছু অন্ধ ও বধির গুটিপোকায় পরিণত করলাম। অতঃপর তাদের দুই দলে ভাগ করে এক দলের হাতে তুলে দিলাম আমাদের তৈরী নকল ঈশ্বর। তারা সেই ঈশ্বরকে তাদের ত্রাণকর্তা রূপে মেনে নিয়ে দিবারাত্রি কঠিন বাক্যচ্ছটায় তার কপট উপাসনা করতে লাগলো। আর অন্য দলকে করলাম ঈশ্বরের পথ থেকে বিচ্যুত। তারা নকল ঈশ্বরের ভয়ঙ্কর রূপে বিভ্রান্ত হয়ে দিনরাত তাকে ঘৃণায় ডুবিয়ে অভিশাপ দিতে লাগলো।
আমরা অলক্ষ্যে বসে জাদুর কলকাঠি নেড়ে দু'দলের সংঘাত দেখে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুললাম আর মুগ্ধ নয়নে দেখতে লাগলাম কেমন করে সব অন্ধ ও বধির গুটিপোকারা দিনের পর দিন সুতো বুনে যায় না জেনেই যে তাদের সুতোয় বোনা জালে চিরদিনের মত আটকা পড়ে আছে তারা নিজেরাই........
ছবি: সালভাদর দালি
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০১০ রাত ৮:৫১