“ইওর ওনার.. আমার মক্কেল সম্পর্ণ নির্দোষ। তিনি এ কাজ করেননি তাকে বাধ্য করা হয়েছে, অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। বিন্তু তিনি আঘাত করেননি।"
অবজেকশন ইওর ওনার ....
উকিলদের জেরা শুনতে শুনতে কান্ত হয়ে পড়লো অনিক। কেন এমন হলো ? তার তো আসামীর কাঠগড়ার দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিলো না। পৃথিবী আর পৃথিবী মানুষের প্রতি প্রচন্ড ঘৃনা অনুভব করলো সে। বার বার চোখে ভেসে উঠতে লাগলো দরিদ্র বাবার অসহায় মুখ, দুঃখিনী মায়ের অশ্র সজল চোখ আর ছোট চোনের মায়াবী ; সে চাহনী । বুক ভরা আশা নিয়ে আজ ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের মুখোমুখী।
মা বাবার আশা আকাঙ্খা আজ স্বপ্নের চোরাবালী আদরের সন্তান অনিক তার বাবা প্রান্তিক কৃষক । অভাবের সংসার নুন আনতে পান্তা ফুরায় । তবুও বাবা মা’র স্বপ্ন ছেলে অনেক বড় হবে। তাই সন্তানের লেখা পড়ার খরচ চালাতে ছাগল বিক্রি থেকে শুরু করে যরে ধন ভিটেমাটি ও বন্ধক রাখতে দিধা করেন নি তারা। অনিকের চেষ্টার কমতি ছিলো না। যার প্রতিফল ঘটিয়েছিলো এস এস সি ও এইস এস সিতে এ প্লাস পেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখে অনিক। চেষ্টার শেষ বিন্দু পর্যন্ত ব্যায় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পায় সে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কাস শুরু এক অজানা আতঙ্ক আর কৌতুহুল ঘিরে ধরে তাকে। নতুন, মুখ, নতুন দেয়াল, নতুন বাতাস যেন নতুন জীবনে নতুন স্বপ্নের যাত্রা। হল উঠতে হবে তাকে। হল প্রভোষ্টের কাছে সিটের জন্য আবেদন করলো। কিন্তু প্রভোষ্ট অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হলো হলের বড় ভাইদের মাধ্যমে সিট নিতে হবে। কিন্তু স্যার আমি তো বড় ভাইদের চিনি না। স্যার রাগত সূরে বললেন হলে থাকতে হলে বড় ভাইদের চিনতে হবে। কিন্তু অনিক বুঝতে পারে না প্রশাসন থাকতে কেন তাকে সিটের জন্য বড় ভাইদের কাছে যেতে হবে। কিছু একটা বলতে চেয়ে ভয়ে বলতে পারলোনা সে।
বড় ভাইদের খোজে গেষ্ট রুমে গেল সে। সিগারেটের ধোয়ায় ভরা একটি ঘরে আড্ডা দিচ্ছে কয়েক জন বড় ভাই সালাম ও পরিচয় দিয়ে হলের সিটের কথা বললো অনিক। জবাবে তাকে মানষিক ভাবে অপদস্থ করে এবং অশ্লিল ভাষায় গালি দিয়ে সম্বোধন করে। কিন্তু অনিক কোন প্রতিবাদ করতে পারলো না । কারন সে এখানে নতুন। এছাড়া হলের একটি সিট তার জন্য খুব দরকার । আর বাইরের মেসে থাকতে ও অনেক টাকা লাগে। অবশেষে বড় ভাইয়েরা বললো
-আমাদের কথা মতো চলতি পারবি ?
- তাহলে কমন রুমে যা। আর শুন বড়ভাইদের সম্মান করে চলবি। ঠিক আছে ?
-জি ভাই।
ডান দিকের সিড়ি চেয়ে দোতলায় উঠলো অনিক । সামনে তাকাইতে দেখলো বড় একটি রূমে মেঝেতে সারি সারি তোষক -বিছানা ছড়ানো। কতগুলো ছেলে এককোনে আড্ডা দিচ্ছে আর কিছু ছেলো দুষ্টমিতে মেতে উঠছে। রুমটির দেয়ালে কি সব অশ্লিল আজেবাজে লেখা। সে আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করলো বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্ররা যে রুমে থাকে সে রূমে একটি টেবিল পর্যন্ত নেই। যা হোক কষ্ট করে সেখানে থাকতে শুরু করলো অনিক।
সকালে উঠে বাথরুমে দীর্ঘ লাইন, ক্লাসে দলবেধে আসা যাওয়া , বন্ধুদের আড্ডা সব মিলে ভালই চলছিল
একদিন রাত্রে একজন বড়ভাই(!? ) এসে সবাইকে গেষ্ট রুমে যেতে বললো। সিগারেটের ধোয়ায় ভরা ঐ রুমটাকে যেতে ইচ্ছা করেনা অনিকের। কিন্তু বাধ্য হয়ে সবার সঙ্গে যেতে হল। বড় ভাইয়েরা (!?) বললো -
কালকে পার্টির মিছিল আছে সবকয়টি মিছিলে যাবি। নইলে খবর আছে কইলাম।
অনিকের একজন বন্ধু বললো - ভাই কালকে ক্লাস আছে।
বড় ভাই তাকে ধমক দিয়ে বললো
-চুপ বেয়াদব বড় ভাইদের মূখে মূখে বলিস?
কিছু একটা বলতে চেয়ে ও বলতে পারলো না অনিক। কি আর করা পরের দিন ক্লাস ফেলে মিছিলে যেতে হলো তাকে।
এভাবেই ঘটে গেলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা। দিনটি ছির রবিবার। সন্ধ্যায় পড়তে বসে ছিল অনিক। একজন বড় ভাই এসে সবাইকে গেষ্ট রুমে নিয়ে গেলো । সেখানে থেকে বড়ভাইরা তাদের একটি রুমে যেতে বললো এরপর সবাইকে রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো । রুমের ভেতরে ও আশেপাশের সব আলো বন্ধ করে দেওয়া হলো। ছেট রুমটিতে ২০-২৫বন্ধু ও কয়েক জন বড় ভাই। অন্ধকারের মাঝে কিছু সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো খাটের নিচে কি যেন চকচক করছে। শিওরে উঠলো অনিক। বড়বড় ছুড়ি ,দা কুড়াল সহ ধারালো সব অস্ত্র। অজানা আতঙ্কে কেঁপে উঠল শরীর।
পরে সে জানতে পারলো বিরোধী নেতাকে মারতে হবে তাদের। অস্ত্র গুলো তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো। দুজন বড়ভাই গেল বাইরের পরিস্থিতি পর্যাবেক্ষন করার জন্য। তার ফিরে এসে জানালো - ঐ নেতার রূমে গিয়ে তাকে মেরে আসতে হবে।
অনিকদের মধ্যে একজন এর প্রতিবাদ করলো । সঙ্গে সঙ্গে একজন বড়ভাই (!?) তার গালে কষে একটি থাপ্পর মারলো -হুস্কার দিয়ে বললো
-ঐ ব্যাটা ঐ গ্রপের লগে তোর আতাত আছে নাকি যা ব্যাটা তুই আগে মারবি, নইলে কিন্তু তোরেই মারমু কইলাম।
চিৎকার করে এর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হলো অনিকের । কিন্তু কিছুই বলতে পারলোনা সে। বরং বাধ্য হয়ে সবার সঙ্গে বিরোধী গ্রুপের নেতারত রুমে গেল। কিন্তু কোন ভাবেই নেতার রুমের দরজা ভাঙতে না পেরে আবার আগের রূমে ফিরে আসে তারা ।
রাত কেটে তখন ভোর হয় হয় হয় অবস্থা। তন্দ্রাছ্ছন্ন সবাই পাশের দুই তিনটি রূমে যে যার মত গাদাগাদি হয়ে শুয়ে পড়লো । বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছিল অনিক। ঘূম ভাঙ্গলো বড় ভাইয়ের ডাকে হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে নিচে যেতে নির্দেশ করলো। ঘুম জড়ানো শরীরে কোন রকমে সিড়ি বেয়ে নিচে নামলো। দেখলো হলের সামনে দিয়ে ঐ নেতা যাচ্ছিল। অনিকের গ্রুপের দুজন গিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে লাগালো। বাধ্য হয়ে অনিকও গেল দা হাতে । এবারে আঘাত করলো অনিক । আহতের ডান পায়ে লেগে হা হয়ে গেল জায়গাটি। ফিনকি দিয়ে নক্ত বের হলো। চিৎকার করে উঠলো আহত দেহটি। চিৎকার ভেদ করলো অনিকের মস্তিষ্ক। সে আর আঘাত করতে পারলো না। দাড়িয়ে নিশ্চুম হয়ে দেখলো একটি তাজা প্রান নিথর হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। সবাই ফিরে গেলে সেই রুমটিতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আহত নেতার লোকজন বপুল অস্ত্রসজ্জ সজ্জিত হয়ে অনিকদের আক্রমন করলো, প্রচন্ড লড়াই। হুঙ্কার গর্জন আহাজারী, ভাঙ্গচুর গুলাগুলী যেন এক কুর ক্ষোত্র, মাতাল রনাক্ষন।
টিকতে না পেরে অনিকসহ পাঁচজন একটি রূমে আশ্রয় নিল। আক্রমনের শিকার হলো সে রুমটিও । মুহুর্তই গুলী, রডের আঘাতে জানালার কাঁচ, দরজার কাঠ ভাঙ্গার শব্দে কান তালি লেগে যাচ্ছিল । আর নিরাপদে থাকতে পারলোনা তারা। জীবন হাতে নিয়ে দোতলা থেকে লাফ দিলো অনিক মচকে গেলো ডান পা। আহত পা নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে কোন রকমে পাশের গ্রামে আশ্রয় নিল সে। পরদিন দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় পৌছে সে।
তার পরের ঘটনা গুলো ঘটে গেল খুব দ্রত। ঘটনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ৫০ জনের মত আহত হল। নিহত হল সেই নেতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলো। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনিকের জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেল। আরো কয়েক নেতার সাথে বহিস্কার করা হলো তাকেও। হত্যা মামলা সে আত্মীয়ের বাসা থেকে অনিককে গ্রেফতার করলো পুলিশ। সে আদালতে আজ বিচারের মুখোমুখি, আসামীর কাঠগড়ায়।
বিষন্নতার পর বিষন্নতা ভর করছে তাকে। ক্ষোভের পাহাড় আঘাত করছে তার হূদয়ে । সব কিছু ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে সে ক্ষোভ। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে তার না বলা কথা গুলো। যে কথা গুলো সে বলকে পারেনি হলে উঠার সময় প্রশাসনকে, গেষ্ট রূমে বড় ভাইদেরকে , পড়ার টেবিল থেকে তুলে অস্ত্র হাতে খুনি বানানো সে নরপিশাচদেরকে।
হঠাৎ সমস্ত ক্ষোভের বিস্ফোরন হলো। আর পারলো না সে চিৎকার করে বলতে লাগলো থামুন আপনারা থামুন। কেন আমার বিচার করছেন; আমিতো অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম, মানুষের মত মানুষ হবার আশায়। কেন আমাকে প্রশাসন নামের অথব্যরা একটি সিট পর্যন্ত বরাদ্দ দিতে পারলো না। কেন আমাকে আর একজন ছাত্র তার ইচ্ছে মত ব্যবহার করার সুযোগ পেলো ? কেন আমাকে ক্লাস করতে না দিয়ে মিছিলে যাওয়া যেতে বাধ্য করা হল? কেন পড়ার টেবিল থেকে ধরে এনে অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হলো ? কেন কলম ফেলে অস্ত্র হাতে মানুষ খুন করতে বাধ্য করা হলো? কেন? কেন ? কেন ? আমি খুনি! হ্যা হ্যা আমি খুনি। আমি খুন করেছি । কেন খুন করেছি কাদের মদদে খুন করেছি জবাব দিন , জবাব দিন ...
আদালত নিস্তব্ধ। জবাব খুজে পেল না কেউ। পিন পতন নিরবতা ভাঙ্গালো বিচারক। অর্ডার .. অর্ডার ... অর্ডার ...