তপু গ্রিল খাঁমচে ধরে শব্দ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বিছানায় বসে আছে পা ছড়িয়ে। পায়ের কাছে ছড়ানো ছেটানো সাদা কাগজ আর রঙ পেন্সিল। এলো মেলো ভাবে নানান শব্দ লেখা, কোথাও বা মানুষের মুখ আঁকা। হিজিবিজি আঁকা বুকিতে সবটা ভরিয়ে ফেলেছে।
দরজায় নক করার শব্দ হল। তাকালো না সেদিকে, গ্রিল দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে এখনো।
দরজার পাল্লা ভেজানো ছিল, ঠেলে ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে উঁকি দিলেন মুনির সাহেব। ছেলে বিছানায় বসে জানালার গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর উস্কো খুস্কো চুলে তপুকে কেমন যেন অপার্থিব লাগছে। এক মুহূর্ত নীরবে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে গলা খাকারি দিলেন, “তপু বাবা? কি করো?”
তপু এখনো বাহিরে তাকিয়ে আছে। জবাব দিল না।
ভেতরে ঢুকলেন। হাতে একটা বড় খয়েরি রঙের খাম। মেঝেতে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা রং-তুলি, ইজেল বোর্ড, কাগজ পত্র আর ছবির বই- সাবধানে পেড়িয়ে বিছানার কাছে এলেন। ছেলের পাশে পা তুলে বিছানায় উঠে বসলেন। জানালা দিয়ে বাহিরে খেলতে থাকা ছেলে গুলোকে দেখা যায়। মুনির সাহেব ছেলের মাথায় হাত রাখলেন, “খেলা দেখো বাবা?”
তপু জবাব দিল না। কেবল গ্রিলের ভেতরে মুখ চেপে ধরল আরো। যেন গ্রিল পেরিয়ে ওপাশে চলে যাবে।
ফোঁস করে একয়াত নিঃশ্বাস ফেললেন মুনির সাহেব। হাতের খামটা আপন মনেই উল্টে পালটে দেখলেন এক নজর। তারপর ছেলের ডান হাতটা টেনে খামটা ধরিয়ে দিলেন, “মৃদুলা মেয়েটা এসে দিয়ে গেল একটু আগে। তোকে দিতে বলেছে।”
মৃদুলার নামটা শুনে ফিরে তাকালো তপু। হাতের খামটা খুব অবাক হয়ে দেখল। ঘাড় সামান্য কাঁত করে আস্তে আস্তে বলতে লাগল, “মৃদু, মৃদু, মৃদু.... ভাল মেয়ে, ভাল মেয়ে!”
মুনির সাহেব মাথা ঝাঁকালেন, “হ্যাঁ, অনেক ভাল মেয়ে ও। তোমাকে বিয়ের দাওয়াত দিয়ে গেছে।”
তপু খুব খুশি হয়ে উঠল, “অনেক ভাল মেয়ে, অনেক ভাল বিয়ে...... আমিও অনেক ভাল। অনেক ভাল বাবা? আমরা দুই জন অনেক ভালো!” খাময়াট খুলতে থাকে তপু আনন্দিত চোখে মুখে।
মুনির সাহেব ছেলের মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিলেন, “হ্যাঁ বাবা। তুমিও অনেক ভাল। কিন্তু মৃদুলার বিয়ে তো রায়হানের সাথে হবে। খুব ভাল ছেলে। অনেক ভাল থাকবে ওরা।”
খামটা খুলতে থাকা হাত দুটো থমকে গেল তপুর। করুণ মুখে তাকালো। মুনির সাহেব মৃদু গলায় বললেন, “তপু বাবার জন্য আমরা আরো ভাল মেয়ে নিয়ে আসবো, কেমন? মৃদুলা থেকেও অনেক অনেক ভাল।” হাসলেন।
তপু হাতের খামটা ধীরে ধীরে খোলে। নীল জমিনে সোনা রঙের হরফে বিয়ের কার্ড ছাপানো। বর-কনের নামগুলোয় চোখ বুলালো ভাবলেশহীন চোখে। বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বলতে লাগল, “মৃদুলা বলেছে তপু ভাল ছেলে। তপুকে বিয়ে করবে.... মৃদুলা ভাল না। কথা রাখে না..... তপুর মন খারাপ..... অনেক.....”
মুনির সাহেব অসহায় ভাবে গভীর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছেলের দিকে তাকালেন। সামনে কার্ড হাতে বসে থাকা বাইশ বছরের শরীরটায় চার বছরের আটকে থাকা বাচ্চাটার দুই চোখে এক সমুদ্র পানি জড়ো হয়েছে। সেই সমুদ্রের পানি স্থির হয়ে আছে। ঢেউ নেই কোথাও।
গত বছর এক্সিডেন্টটা হয়েছিল। ভার্সিটিতে সবে ভর্তি হয়েছে তপু, ঈদের আগের দিন মায়ের সঙ্গে মার্কেটে গিয়েছিল রিক্সায় করে। ফেরার পথে কোত্থেকে যেন একটা বাস এসে পেছন দিক থেকে মেরে ধাক্কা বসে রিক্সাটায়। রাস্তার ওপর ছিটকে পড়ার পর থেকে তপুর আর কিছু মনে নেই। ওর মা রওশান আরা সেদিন ওখানেই মারা যান। তপু মাথায় আঘাত পায় বেশ খারাপ ভাবে। ব্রেনের ফ্রন্টাল লোবে বাড়িটা লেগেছিল। জ্ঞান ফেরে প্রায় চারদিনের মাথায়। কাউকে চিনতে পারেনি সেদিন। বাচ্চাদের মত ইতিউতি করে চাইছিল। বুঝতে পারছিল না কোথায় আছে সে। মুনির সাহেব নিজে ডাক্তার মানুষ। কিন্তু তাঁরও বুঝতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল যে তপু বাচ্চাদের মত হয়ে গেছে। সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকা ছেলেটার মাঝে অনেক ছোট একটা বাচ্চার মন যে তৈরি হয়েছে- ধরতে পারেননি।
যখন সুস্থ ছিল তখন রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে শুনতে ছবি আঁকার একয়াট নেশা ছিল তপুর। এক্সিডেন্টের পর থেকে সেটা অনেক কমে গেছে। সারাদিন দরজা বন্ধ করে খালি কাগজে পেন্সিল দিয়ে অর্থহীন দাগ টানে। হঠাৎ হঠাৎ রবীন্দ্র সঙ্গীতের সিডি চালিয়ে গান শোনে। মুনির সাহেব গানের শব্দ শুনে ভাবেন তপু বুঝি আবার আগের মত হয়ে গেছে। কিন্তু দরজা খুলে হতাশ হতে হয় তাঁকে। তপু রঙ পেন্সিল দিয়ে কাগজে অর্থহীন দাগ টেনে যাচ্ছে আগের মত- কিংবা গ্রিলে মুখ লাগিয়ে বাহিরের মাঠে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে।
তপুর ঘরের দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বাহিরে এসে দাঁড়াতেই কাঁধ ঝুঁকে পড়ে মুনির সাহেবের। রওশান আরার মৃত্যুটা তাঁকে জীবনে থেকে অনেক খানি দূরে ঠেলে দিয়েছে, যতটা অর্থহীন করে দিয়েছে তপুর এভাবে বেঁচে থাকাকে।
তপুর পড়াশোনা শেষ হলে পাশের বাড়ির মৃদুলা নামের মেয়েটাকে ঘরের বৌ করে আনার খুব ইচ্ছে ছিল রওশান আরার। কথাও দেয়া হয়ে গিয়েছিল দু বাড়ির মধ্যে এ নিয়ে। এখন আর সেটা সম্ভব না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রকিং চেয়ারটায় শুয়ে পরলেন মুনির সাহেব। ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলেন শূণ্য দৃষ্টিতে। পাশের ঘর থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুর চেসে আসছে। তপু আবার সিডি চালিয়েছে বোধ হয়।
“তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি,
ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি.....”
ছেলেটার গলাও পাওয়া যাচ্ছে। গানের সাথে গলা মিলিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করছে। পারছে না।
চোখ বন্ধ করলেন মুনির সাহেব। একটা বছর আগেও তপুর গানের গলা শুনলে মনে হত রবীন্দ্রনাথ বুঝি তাঁর সব গান তপুর জন্য লিখে গেছেন। এত ভাল গাইতে পারতো ছেলেটা.......
বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা করছে মুনির সাহেবের। ব্যথাটা ছাপিয়ে গিয়ে তপুর গানের ভাঙ্গা ভাঙ্গা কথা গুলো আছড়ে পড়ছে চারপাশে..... মুনির সাহেব ঝাপসা চোখে দেয়ালে ঝোলানো ছবিটার দিকে তাকালেন। রওশান আরা আর মুনির সাহেবকে দু হাতে গড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটা। অস্থির লাগছে নিজেকে তাঁর। মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমে বাঁধা যায়, মানুষগুলোকে যায় না কেন? বেঁধে রাখতে পারলে ভাল হত। কখনো কখনো সময়টা নদীর মাঝে চড়ে নৌকা আটকে থাকা মত হয়ে যায়। মুনির সাহেবের সময়ের নৌকাটাও এক বছর ধরে চড়ে আটকে আছে। পানির দেখা নেই এখানে।
মৃদুলার বিয়ের সারাটা দিন তপু চিলেকোঠার জানালায় পা ছড়িয়ে বসে তাকিয়ে ছিল বাড়িটার দিকে। জানালাটা মেঝের খুব কাছাকাছি। চিলেকোঠার মেঝেতে বসেই জানালা দেখা যায়। সন্ধ্যার পর পুরো বাড়িটা লাল-নীল আলোয় ভরে গেছে। তপু ছটফট করতে লাগল আলোর দিকে তাকিয়ে। মৃদুলাকে কোথাও দেখা যায় না কেন? জানালার শিকে মুখ লাগিয়ে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে ও। বোঝা গেল না। পা ঘষছে কাঠের মেঝেতে।
হঠাৎ নূপুরের শব্দ পাওয়া গেল। চমকে ফিরে তাকালো তপু। মৃদুলা বিয়ের পোশাক পরে চলে এসেছে তপুদের বাড়ির চিলেকোঠায়। চোখগুলো লাল হয়ে ফুলে আছে। বোঝাই যায় কাঁদছিল এতক্ষণ। তপুকে কেমন যেন বিভ্রান্ত মনে হল। বিড়বিড় করে নিজেকেই বলল যেন, “মৃদুলা ভাল মেয়ে...... মৃদুলা দেখা করতে এসেছে....” জানালা দিয়ে বাহিরে আবার বিয়ে বাড়ির দিকে তাকালো।
মৃদুলা তপুর পাশে এসে জানালার সামনে বসল। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল।
“তপু?” কান্না ভেজা গলায় ডাকল মৃদুলা।
“উঁ?” জানালার বাহিরে দৃষ্টি ওর।
“আমার ওপর রাগ করেছিস?”
“হ্যাঁ।”
ঠোঁট কামড়ে কান্না ঠেকাবার চেষ্টা করল মৃদুলা, “কেন?”
“মৃদুলা তপুকে বিয়ে করবে না আর। তপু একলা থাকবে। তপুর খারাপ লাগে....” জানালার শিকে মুখ চেপে ধরল তপু। গালে দাগ বসে যাচ্ছে জং ধরা শিকের।
মৃদুলা ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওর একটা হাত ধরল, “তোকে ছাড়া থাকতে আমারও অনেক কষ্ট লাগবে তপু.....”
তপু মৃদুলার দিকে অবাক মুখে তাকালো, “মৃদুলা ভাল মেয়ে.... কাঁদে না...” ছোট বাচ্চাদের আদর করে দেয়ার মত মৃদুলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তপু।
মৃদুলা ওর হাতটা ধরে কাঁদতে থাকে আকুল হয়ে। তপু বুঝতে পারে না মেয়েটা এত কাঁদছে কেন? ওর মাথায় হাত রেখে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। রাতের আকাশটায় একটা একটা করে তারা জ্বলতে শুরু করেছে। নিচের বাড়িটার থেকেও আকাশটা বেশি সুন্দর লাগছে।
ট্রেনের শব্দ পাওয়া গেল। মৃদুলাকে ওখানে রেখে দৌড়ে নিজের ঘরে নেমে এলো তপু। জানালা দিয়ে মুগ্ধ চোখে ট্রেন যাওয়া দেখতে লাগল। রাতের আঁধারে ট্রেনের আবছা অবয়বটা দেখা যায়। শুধু সামনে বিশাল একয়াট লাইট জ্বলছে। তপু গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ট্রেনের দিকে।
মুনির সাহেব অবাক হয়ে দেখলেন মৃদুলা কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। পেছন থেকে কিছু বলার জন্য ডাকতে গিয়েও থেমে গেলেন। পেছন থেকে না ডাকাই ভাল। অন্য ঘরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে মেয়েটার। কাঁদুক না হয় একটু, কেঁদে হাল্কা করুক মনটা।
বুকের ব্যথাটা বাড়ছে মুনির সাহেবের। ত্রস্ত পদে নিজের ঘরে ফিরে এলেন। শুনতে পাচ্ছেন পাশের ঘরে তপু গান গাওয়ার চেষ্টা করছে-
“তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে......”
গলা ভেঙ্গে যাচ্ছে তপুর..... মুনির সাহেব বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করলেন তপুর গলাতে কোথায় যেন ভয়ংকর একটা চাপা কষ্ট মিশে আছে। সুরের ভেতর সেই কষ্টটা ঢুকে গিয়ে জগতময় ছড়িয়ে পড়ছে....
মুনির সাহেবের লাশটা ঘরের মাঝখানে খাঁটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। অল্প কয়েকজন লোক এসেছে। আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ নেই যে তাঁকে দেখতে আসবে শেষ বারের মত। কাফনের মুখটা অল্প খোলা। খুব শান্তিতে চোখ বুজে ঘুমাচ্ছেন তিনি। মুখে প্রস্বস্তির একটা হাসি ফুটে রয়েছে। নিচু স্বরে কেউ কোরআন শরীফ পড়ছে। আগর বাতির গন্ধে ভরে গেছে ঘরটা ।
তপু ওর ঘরের জানালার কাছে বসে আছে মূর্তির মত। গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে বিছিয়ে থাকা ধান ক্ষেতটার শেষ প্রান্তের রেল লাইনটার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। মাথার ওপর ঘুরতে থাকা ফ্যানের বাতাসে বিছানার ওপরের কাগজগুলো গড়াগড়ি খাচ্ছে।
তপু নিঃশব্দে ডান হাতটা বুকে দিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “তপু অনেক ভাল ছেলে.... তপুর বাবা অনেক খারাপ মানুষ। মাঝপথে এভাবে কেউ চলে যায়?”
গতরাতে মুনির সাহেব মারা যাওয়ার আগ মুহূর্তে বিছানায় শুয়ে তপুর ডান হাতটা তপুর বুকে ধরে এই কথাগুলো বলেছিলেন। তপু মনে রেখেছে বাবার কথাগুলো। ভোলেনি।
সূর্যটা দ্বি-প্রহরের চৌকাঠ পেড়িয়ে ঝুলে পড়তে আরাম্ভ করেছে পশ্চিমের ধান ক্ষেতগুলোয়। আকাশে একরত্তি মেঘ নেই। নীলের মধ্যে হাল্কা সাদার স্ক্যাচ টেনেছে কেউ যেন খুব নিপুন হাতে। তার মাঝেই সূর্যটা আগুণ ঢেলে কমলা বর্ণ ধারণ করছে ধীরে ধীরে। বাঁক নিয়ে চলে যাওয়া রেল লাইনটায় পা টেনে টেনে হাটছে তপু। মুখ ঝুঁকিয়ে রেখেছে নিচের দিকে। বহু দূর থেকে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
কাঠের স্লিপারগুলো কাঁপছে। তপু টের পাচ্ছে সেই কম্পন। বিড়বিড় করে বুকে হাত দিয়ে আপন মনে বলতে লাগল, “তপু ভাল ছেলে..... তপু গান গায়...... কিন্তু তপু একলা বসে থাকে জানালায়.....কেউ জানতে চায় না তপু কি দেখে জানালায় বসে? তপু প্রতিদিন রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে.... কেউ হাটে না এখানে, কেউ থাকে না..... আজকে তপু হাটবে। কেউ তপুর জানালায় বসলে একটু দেখো তো এই ছবিটা রঙ তুলিতে আঁকা যায় নাকি? তপু হাটছে?”
ট্রেনের হুইসেল বেজে যাচ্ছে একটানা। থামছে না। স্লিপারগুলো কাঁপছে পাগলের মত।
তপু ধীরে ধীরে মুখ তুলে আকাশের সূর্যটার দিকে তাকাল। ও যেদিকে হাটছে, সূর্যটাও ওদিকেই নামছে। কে জানে, হয়তো হাটতে হাটতে আজ দেখা হয়ে যেতে পারে।
বুক ভরে একটা দম নিল। পা টেনে টেনে হাটছে এখনো সূর্যের বাড়িটার দিকে। যতই হাটছে, সব যেন দূরে সরে যাচ্ছে। আপনা আপনি দু চোখ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল তপুর। অবাক লাগছে ওর। আজকের সমুদ্রটায় অনেক ঢেউ।
অনুচ্চ স্বরে গাইতে লাগল তপু -
“তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি,
ডুবতে রাজি আছি, আমি ডুবতে রাজি আছি॥
সকাল আমার গেল মিছে, বিকেল যে যায় তারি পিছে গো,
রেখো না আর, বেঁধো না আর কুলের কাছাকাছি॥
মাঝির লাগি আছি জাগি সকল রাত্রিবেলা,
ঢেউগুলো যে আমায় নিয়ে করে কেবল খেলা।
ঝড়কে আমি করব মিতে, ডরব না তার ভ্রুকুটিতে
দাও ছেড়ে দাও, ওগো, আমি তুফান পেলে বাঁচি.....”
কন্ঠটা পৃথিবীর এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দৌড়ে বেড়াচ্ছে প্রতিধ্বনিত হয়ে......