রাত জাগা আমার খুব পুরানো অভ্যাস। কিন্তু পুরো রাত জেগে থাকি, এই রকম ঘটনা খুব কম ঘটে! গতকাল ঘটেছিলো। ল্যাপটপে কাজ করতে করতে কখন যে পূব আকাশে ঊষার আগমন ঘটলো টেরই পাই নি! টের পেলাম যখন, ক্লান্তিতে দু’চোখ বুজে এলো।
যে সময়ে ঘুম ভাঙ্গলো, তখন দুপুর বারোটা বেজে গেছে। বেড সাইড টেবিলে রাখা চিরকুট পড়ে বুঝলাম, আজ আমারো বারোটা বেজেছে! সারারাত জেগে থাকার জন্য আমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভিমান করে আমার জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা না করেই অফিসে চলে গিয়েছেন।
এই এক সমস্যা! হোষ্টেল জীবনে কেনো যে রান্না করাটা শিখিনি! বাইরে খেতে হবে – এটা চিন্তা করতেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। কি করবো, কি করবো ভাবতে ভাবতেই আর্কিমিডিসের ‘ইউরেকা’র মতো খড়কুটো পেয়ে গেলাম। কয়েকদিন আগে একজনের সাথে কথা বলতে গিয়েই ফুডপান্ডার নাম প্রথম শুনেছিলাম। ‘ফুডপান্ডা’- অনলাইনে খাবারের অর্ডার দিলে বাসায় খাবার নিয়ে আসে। সিদ্ধান্ত নিলাম- আজ ফুডপান্ডার জারিজুরী দেখবো!
গুগলে ফুডপান্ডা বিডি সার্চ দিয়ে ওদের ওয়েবসাইট পেয়ে গেলাম। প্রথমেই রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে। এইসব রেজিষ্ট্রেশন করা আমার জন্য সবসময়ই বিরক্তিকর। তবু পেট পুজো যেহেতু করতে হবে, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও রেজিষ্ট্রেশন করলাম। এরপরের ধাপগুলো সম্পন্ন করে ধানমন্ডি নান্দোস থেকে কিছু খাবার অর্ডার দিলাম। আমাকে বলা হলো পঞ্চান্ন মিনিটের মধ্যে আমার বাসায় অর্ডারকৃত খাবার নিয়ে চলে আসবে তারা। আমি ঘড়ি ধরে বসে রইলাম!
আমি নিশ্চিত – নান্দোস থেকে অর্ডারকৃত খাবার তৈরী করে আমার বাসায় এরা কখনই পঞ্চান্ন মিনিটের মধ্যে আনতে পারবে না। আর যখন খাবার নিয়ে আসবে, দেখা যাবে সেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। তাই চিন্তা করলাম সহজে কিছু রান্না করে এই যাত্রায় পার পেতে পারি কি না! মনে পড়লো আমারই খুব প্রিয় একজন মানুষ, স্বনামধন্য ব্লগার সাহাদাত উদরাজীর ‘গল্প ও রান্না’ ব্লগের কথা, যেখানে তিনি আমাদেরই মতো হতভাগাদের জন্য প্রায় পাঁচশ-এর মতো রেসিপি লিখেছেন- সহজবোধ্য ভাষায় এবং ছবি তুলে দিয়েছেন মনমুগ্ধকর ভঙ্গিমায়।
কিচেনে এবং ফ্রিজে দেখে নিলাম আমার সম্বল কি আছে। সেই উপকরণ দিয়ে ‘গল্প ও রান্না’য় সহজে কি উপাদেয় খাবার রান্না করা যায়, খুঁজতে লাগলাম। খুঁজতে খুঁজতে একটা রেসিপি যখন আমার জন্য সহজ মনে হলো, যখন ঠিক করলাম- আজ একটা এক্সপেরিমেন্টই করে ফেলি, ঠিক তখনই বাসার বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখি- একজন সুদর্শন তরুণ সুন্দর হাসি দিয়ে আমাকে বললেল, ‘আমি ফুডপান্ডা থেকে এসেছি। এই যে আপনার খাবার!’ অনেকটা অবিশ্বাসের মতো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি- পঞ্চান্ন মিনিট হতে তখনো পাঁচ মিনিটের মতো বাকী! মনের গহীনে কে যেনো বলে উঠলো, ‘দেখ, দেখ, খাবার গরম আছে কি না!’ তাই দ্রুত প্যাকেট খুলে যখন দেখলাম হাতে ভালোই তাপ পাচ্ছি, তখন মনে হলো ‘আমি ইহাকে পাইলাম! আমি ইহাকে পাইলাম!’ চিৎকার করে আমার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতে ইচ্ছে করছিল, আমি এখন আর তোমার অভিমানের পরোয়া করি না!
ইদানীং আমি গ্রীক মিথলজি নিয়ে লিখছি। এর মাঝে এই লেখাতে অনেকেই অবাক হতে পারেন। তবুও আমি ঠিক করেছি আজ ফুডপান্ডা নিয়েই লিখবো, যারা আমাকে বাসায় নান্দোসের খাবার গরম অবস্থায় এনে দিতে পারে, তাদের প্রতি একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না হয় করলাম!
বাংলাদেশে যে এই রকম একটি পদ্ধতি চালু আছে, জিনিসটাই আমার কাছে খুব ভালো লাগলো। পেট পুজো করে তাই একটু খোঁজ খবর নিলাম।
ফুডপান্ডা একটি ইন্টারন্যাশনাল ফুড ডেলিভারি অনলাইন কোম্পানী। এর সদর দপ্তর জার্মানীর বার্লিনে অবস্থিত। বিশ্বের ৩২টি দেশে এই কোম্পানী কাজ করছে। এশিয়া মহাদেশের নবম দেশ হিসেবে ২০১৩ সালের ১৩ই নভেম্বর থেকে ফুডপান্ডা বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। এই মুহূর্তে তারা শুধু ঢাকাতেই কাজ করছে, যতদূর জানি অদূর ভবিষ্যতে সিলেট এবং চট্টগ্রামেও কার্যক্রম চালু করার কথা।
যারা আমার মতো মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে যান, তারা কিভাবে ফুডপান্ডার মাধ্যমে পছন্দসই রেষ্টুরেন্ট থেকে খাবার আনিয়ে খেতে পারবেন- সেই ব্যাপারটা একটু সংক্ষেপে বলি। প্রথমেই http://www.foodpanda.com.bd/ - এই ওয়েবসাইটে গিয়ে রেজিষ্ট্রেশন করে নিবেন। এরপর শহর নির্বাচন করে, যে জায়গায় আছেন সেটি নির্বাচন করবেন। যেমন, শহর হিসেবে ঢাকা নির্বাচন করে জায়গা নির্বাচন করলেন ধানমন্ডি (সেক্ষেত্রে আপনার বাসার ঠিকানাও হতে হবে ধানমন্ডিতে)। তখন ধানমন্ডি এলাকার রেষ্টুরেন্টগুলোর একটি তালিকা চলে আসবে। সেই তালিকা থেকে আপনি একটি রেষ্টুরেন্ট পছন্দ করলে, এরপরে আসবে খাবারের মেনু মূল্যতালিকা সহ। আপনি এবার পছন্দমত খাবার নির্বাচন করুন এবং অর্ডার দিয়ে দিন। একটু পরেই ফুডপান্ডা থেকে আপনাকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে পঞ্চান্ন মিনিটের মধ্যে আপনার পছন্দকৃত রেষ্টুরেন্ট থেকে অর্ডারকৃত খাবার গরম গরম অবস্থায় নিয়ে আপনার বাসার দরজায় উপস্থিত হয়ে যাবে। যারা আইফোন ব্যবহার করেন তারা অ্যাপল স্টোর থেকে ফুডপান্ডার এপ্লিকেশন ইনস্টল করে নিতে পারেন। অনলাইন ছাড়াও ফোনের মাধ্যমেও ফুডপান্ডাতে খাবার অর্ডার দিতে পারবেন, সেক্ষেত্রে আপনাকে ০১৭৫৫৬৬০০৬০, ০১৭৭৭৭৭৭২২২ অথবা ০১৭৭৭৭৭৭২২০ – এই নাম্বারগুলোতে ফোন করতে হবে।
সামনে যে হারে আন্দোলনের আভাস পাচ্ছি, তাতে যদি বাইরের কোনো রেষ্টুরেন্টের খাবার খেতে ইচ্ছে করে, মনে হচ্ছে ফুডপান্ডাই ভরসাস্থল! যা হোক, ফুডপান্ডা নিয়ে অনেক বলে ফেললাম। বেশি বললে আমাকে না আবার এজেন্ট বলে ফেলেন! তারচেয়ে শেষের পথ ধরি।
শেষ করার আগে একটা মন খারাপের কথা বলি। দেশে গত কয়েকদিন যাবত সনাতন ধর্মের অনুসারীদের উপর হামলা হচ্ছে। এসব দেখে নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা এই কোন দেশে বসবাস করছি? এই ঘটনাগুলোর পিছনে শুধুমাত্র বিরোধী শিবিরের প্রতি ঢালাও অভিযোগ করে লাভ নেই। কীভাবে আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ই আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার অপরাধে তারা নিগৃহীত হয়? আমি মনে করি, তাদের রক্ষা করতে সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা স্বাধীনতা বিরোধীদের, রাজাকারদের বিরুদ্ধে লড়াই করছি- এই অবস্থাতে যে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হবে সেটা বুঝতে পারে নি! আমাকে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রবল ক্ষোভ এবং চরম হতাশা নিয়ে বলেছেন, ‘সরকারকে বলেন, একটা আইন করতে। যে আইনের ফলে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আর ভোট দিতে পারবে না! ভোট দিতে না পারলে, মারও খেতে হবে না!’ আমি লজ্জায় তার কথার কোনো জবাব দিতে পারি নি।
আমরা স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার আর জামাত শিবিরমুক্ত একটি সুন্দর বাংলাদেশ চাই, যে বাংলাদেশে ধর্মের নামে কোনো রাজনীতি থাকবে না, থাকবে না সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিষ বাষ্প। সেই বাংলাদেশে মনুষ্যত্বের মঞ্চায়নই যেনো হয় প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ প্রযোজনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৫০