‘শালা, তুই একটা মীরজাফর!’ শুধু একটা নামই একটা গালি হয়ে গেলো! মীরজাফর চরিত্রটি বাংলার ইতিহাসে এমনভাবে আছে, তা যেনো বিশ্বাসঘাতকতারই অন্য নাম। নবাব সিরাজউদ্দৌলার আপন খালু এবং প্রধান সেনাপতি হয়েও শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে পলাশীর প্রান্তরে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা এই লোকটির পরিণতিও খুব একটা ভালো ছিলো না। ইতিহাসে দেখা যায়, শেষ জীবনে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে এই বিশ্বাসঘাতকের মৃত্যু হয়। এই মীরজাফরেরই বংশধর হচ্ছে ইস্কান্দার মীর্জা, পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসনের কৃতিত্বও তার। তারও পরিণতি খুব সুখকর ছিলো না। সামরিক শাসন জারীর বিশ দিনের মাথাতেই তাকে দেশ এবং ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়।
মীরজাফরের প্রসঙ্গ কেনো আসলো এবার সেটা বলি। গতরাতে একটি পুরানো মুভি দেখছিলাম- ‘প্যাশন অব ক্রাইস্ট’।
মেল গিবসনের এই মুভিটি দেখতে দেখতেই মীরজাফরের কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো জুডাসের কারণে। জুডাস ইস্কারিয়ট ছিলো যিশুর বারজন শিষ্যের একজন। সামান্য ৩০টি রৌপ্য মুদ্রার জন্য সে ধরিয়ে দিলো যিশুকে। এখানে একটা ব্যাপার আমাকে খুব খুঁচিয়েছে। যিশু যেভাবে দিন দিন ধর্ম প্রচার করছিলেন, তাতে তাঁকে অবশ্যই ইহুদী পুরোহিতদের চেনার কথা ছিলো। তাহলে জুডাসকে কেনো প্রয়োজন পরলো যিশুকে চুম্বনের মাধ্যমে চিনিয়ে দেবার? জুডাসের পরিণতিও খুব ভালো ছিলো না। আত্মগ্লানিতে ভুগে সে মুদ্রাগুলো ফিরিয়ে দিয়েছিলো এবং পরে অর্ধ উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যাও করে।
আরেক বিখ্যাত বিশ্বাসঘাতক হচ্ছে ব্রুটাস। মার্কাস জুনিয়াস ব্রুটাস। জুলিয়াস সীজার যাকে পুত্রবৎ মনে করতেন, করেছিলেন গলের গভর্নর। অথচ এই ব্রুটাসই সিজারের হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত ছিলো। ব্রুটাস যখন সীজারকে ছুরিকাঘাত করছিলো, সীজার বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে আর্ত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘ব্রুটাস তুমিও!’ যদিও ব্রুটাসের দৃষ্টিকোণ থেকে ছিলো- রোমের সিনেটকে সীজারের একনায়কতন্ত্রের হাত থেকে রক্ষা করা। ব্রুটাসেরও শেষ পরিণতি ছিলো আত্মহত্যা।
ব্রুটাস প্রসঙ্গে একটা মজার কথা মনে পড়ে গেলো। এই ব্রুটাস যেমন রোমের রিপাবলিক সিস্টেমকে রক্ষার জন্য সীজার হত্যাকান্ডের অন্যতম ষড়যন্ত্রী ছিলো, ঠিক তেমনি আরেক ব্রুটাসের নেতৃত্বেই সীজারকে হত্যার প্রায় পাঁচশ বছর আগে রোমে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এই ব্রুটাসের পুরো নাম লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাস। সেই সময় রোম শাসন হতো রাজাদের দ্বারা। আর রাজা নির্বাচিত হতো জনগনের ভোটে। শেষ রাজার ছেলে এক সম্ভ্রান্ত মহিলার শ্লীলতাহানি করলে ব্রুটাস রাজার বিরুদ্ধে জনগনকে ক্ষেপিয়ে তুলেন এবং রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে রিপাবলিকের প্রতিষ্ঠা করেন। মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, শেষ রাজাটি সম্পর্কে ছিলেন ব্রুটাসের মামা। সেই হিসেবে এই ব্রুটাসও বিশ্বাসঘাতক, তাই না! লুসিয়াস জুনিয়াস ব্রুটাস মারা গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে এবং দাবী করা হয়ে থাকে সীজার হত্যাকারী ব্রুটাস, এই ব্রুটাসেরই উত্তরসূরী।
বিশ্বাসঘাতকদের তালিকায় প্রথম দিকেই এক দম্পতির নাম চলে আসে। রোজেনবার্গ দম্পতি- জুলিয়াস ও ইথেল রোজেনবার্গ। তারা ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো, তারা গোপনে সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের কাছে আমেরিকার আণবিক বোমার তথ্য উপাত্ত পাচার করেছেন। বিচারে তারা দোষী সাব্যস্ত হোন এবং ১৯৫৩ সালে তাদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। আধুনিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে অবশ্য ইথেল রোজেনবার্গ এই কাজে জড়িত ছিলেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।
মার্কিন গোপন তথ্য সোভিয়েত রাশিয়ার কাছে বিক্রি- শুধু এই ব্যাপারটি ধরলেও বিশ্বাসঘাতকদের সংখ্যা প্রচুর চলে আসে, বা যদি এটাও ধরা হয়ে থাকে, সোভিয়েত গোপন তথ্য আমেরিকার কাছে বিক্রি করা। এইসব তালিকার উপরের দিকেই নাম আছে এলড্রিচ এমেসের। এলকোহলিক এই মার্কিন নাগরিক তার স্ত্রীর বিলাসী জীবনের খরচ যোগানোর জন্যই এই কাজ করেছিলেন বলে ধারণা প্রচলিত আছে। এমেসও যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করেছিলেন আর তার স্ত্রী পালিয়ে ফিয়েছিলেন দক্ষিন আমেরিকায়।
বিখ্যাত হলিউডি অভিনেত্রী জেন ফোন্ডাকেও অনেক আমেরিকান বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেন- ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় তার ভূমিকার জন্য। আসলে বিশ্বাসঘাতকদের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। এমনকি গ্রীক মিথলজিতেও আমরা বিশ্বাসঘাতকদের দেখা পাই।
জ্যাসন ও মিডিয়া, এট্রিয়ুস ও থেয়েস্টাস, আগামেমনন ও ক্লাইটেমনেস্ট্রা- প্রভৃতির কাহিনীতেও যেনো বিশ্বাসঘাতকতার ছড়াছড়ি। আবার রামায়নে বিভীষন বিশ্বাসঘাতকতা করেও বীরের সম্মান পায়!
বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না! কারণ নিজের দেশেই এরা এতো অধিক সংখ্যায় আছে! তবু আশা নিয়ে থাকি, অন্যান্য বিশ্বাসঘাতকদের মতো তাদেরও শোচনীয় অবস্থা হবে। তাই চাতক পাখির মতো প্রতীক্ষায় আছে কবে গোলাম আযম, মুজাহিদ, নিজামী, সাইদী, কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামান গংদের ফাঁসিতে ঝুলতে দেখবো। অপেক্ষায় আছি সেই সোনালী ভোরের।