প্রাচীনকালের মানুষেরা ভেবেছিলো সাগরটির অবস্থান পৃথিবীর মধ্যখানে, যে কারণে নাম হয়েছিলো ভূমধ্যসাগর। আর কেনইবা ভূমধ্যসাগর বলবে না? এটা যে এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সংযোগস্থলে অবস্থিত! তাই ছোটবেলা থেকেই ভূমধ্যসাগর দেখার এক প্রবল ইচ্ছা মনের ভিতর সুপ্ত ছিলো। সেই ইচ্ছাটা পূর্ণ হলো এই যৌবনে এসে।
লিবিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের অধীনে চাকরী নিয়ে ২০১০ সালে স্বস্ত্রীক গিয়েছিলাম লিবিয়াতে। আমাদের পোস্টিং হয়েছিলো লিবিয়ার গারিয়ান টিচিং হাসপাতালে। গারিয়ান শহরটি আমাদের দেশের বান্দরবনের মতো, এক বিশাল পর্বতশ্রেণির গা বেয়ে উঠে যেতে হয়। পর্বতশ্রেণিটি নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জ নামে পরিচিত। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দক্ষিনে অবস্থিত নাফুসা মাউন্টেন এরিয়া লিবিয়ান সিভিল ওয়ারে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা রেখেছিলো। অনেক কাল থেকেই নাফুসা মাউন্টেন এরিয়া লিবিয়ার উপজাতি মানুষদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিলো, কিন্তু গাদ্দাফীর শাসনামলে তাদের এই বৈশিষ্ট্য চাপা পড়ে, তাই যখন গণ আন্দোলন শুরু হয়, প্রথম থেকেই এই এলাকার জনসাধারণ বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয়। ১৮ই আগষ্ট, ২০১১-তে বিদ্রোহী বাহিনী যখন গারিয়ান দখল করে, ত্রিপলী দখল করা তখন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ত্রিপলীর পতন ঘটে ২৩ আগষ্ট, ২০১১।
নাফুসা মাউন্টেন রেঞ্জ
গারিয়ান টিচিং হাসপাতালে সেই সময়ে আমরা স্বামী স্ত্রী ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী ডাক্তার বা নার্স ছিলো না। পুরো গারিয়ানেই এক বাংলাদেশী পরিবার ছিলো, তারা প্রায় দশ বছর যাবত সেখানে বসবাস করছিলেন। গারিয়ানে যাওয়ার তৃতীয় দিনেই তাঁদের সাথে আমাদের পরিচয় হলো। সেলিম ভাই এবং তাঁর স্ত্রী আমাদের দুইজনকে প্রথম দেখাতেই আপন করে নিলেন। সেই হাসপাতালে বেশকিছু ভারতীয় ডাক্তার ছিলেন, ছিলো পাকিস্তানী ডাক্তার পরিবারও। এক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের আড্ডাগুলো হয়ে উঠলো উপমহাদেশের ছোট সংস্করণ- বাংলাদেশী, ভারতীয় আর পাকিস্তানীদের মিলনমেলা। এরকমই এক আড্ডায় সিদ্ধান্ত হলো শুক্রবার জুমার নামযের পর আমরা সবাই ত্রিপলিতে যাবো। ত্রিপলিতে তখন বাণিজ্যমেলা চলছিলো, বানিজ্যমেলায় ঘুরে রাতে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে খাবার খাবো। ঠিক হলো প্রত্যেক পরিবার একটি করে আইটেম রান্না করে নিয়ে যাবে।
যথাসময়ে শুক্রবার দুপুর দুইটায় আমরা বাংলাদেশী দুই পরিবার, ভারতীয় দুই পরিবার আর পাকিস্তানী তিন পরিবার পাঁচটি প্রাইভেট কারে করে ত্রিপলির উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সময় খুব বেশি লাগেনি, আশি কিলোমিটারের মতো রাস্তা প্রায় এক ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম। যাত্রাপথে ছোট একটি শহরের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় সেলিম ভাই জায়গাটার নাম বললেন আজিজিয়া। মনে পড়ে গেলো স্কুলের ভুগোল পড়ার সময় পড়েছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম জায়গার নাম লিবিয়ার আজিজিয়া। ১৯২২ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর আজিজিয়ার তাপমাত্রা দেখা যায় ৫৭.৮° সেলসিয়াস। সেই থেকে আজিজিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান। এখন কিন্তু সেরকম উষ্ণ লাগলো না!
আজিজিয়া- পৃথিবীর উষ্ণতম স্থান
ত্রিপলিতে পৌঁছেই আমরা বাণিজ্য মেলায় চলে গেলাম। ঢাকা বাণিজ্য মেলা দেখে ত্রিপলি বাণিজ্য মেলা খুব ছোট লাগলো। কিন্তু সাজানো গোছানো। লোক সমাগম ভালোই ছিলো। এক শালের দোকানে কথা বলতে গিয়ে জানা গেলো তারা এই বছরই ঢাকা বাণিজ্যমেলায় স্টল দিয়েছিলেন, ইরানী স্টল। ঢাকার মেলার খুব প্রশংসা করলেন। আমাদের দলের ভারতীয় আর পাকিস্তানী সদস্যদের সামনে গর্বে আমার চোখে জল এসে গেলো।
ত্রিপলি বাণিজ্য মেলায় আমরা ক’জনা
বাণিজ্য মেলায় উত্তর আফ্রিকার অনেকগুলো দেশের স্টল ছিলো, ছিলো অনেক ইরানী স্টলও। আর ছিলো একপ্রান্তে বিশাল প্যাভিলিয়ান জুড়ে ভারতীয় স্টল। আমাদের ভারতীয় সদস্যরা সেই স্টলেই সময় কাটালেন অনেকক্ষণ। কোনো বাংলাদেশী স্টল না দেখে আমি একা একা মেলার এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। কখন সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়ে গেলো খেয়ালই হয় নি। রাত আটটার দিকে আমরা সবাই মেলার প্রধান গেটে একত্রিত হয়ে রাতের ত্রিপলি দেখতে বের হলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত ত্রিপলির মার্কেটগুলো ঘুরে রাত দশটার দিকে ভূমধ্যসাগরের পাড়ে গেলাম।
ভূমধ্যসাগরের ত্রিপলির অংশটি খুব সুন্দর করে বাঁধানো। গাদ্দাফী সরকার এটিকে টুরিস্ট স্পট হিসেবে গড়ে তুলছিলো। ত্রিপলিতে আমাদের কক্সবাজারের মতো কোনো সমুদ্র সৈকত দেখতে পেলাম না। তবে লিবিয়ার প্রায় সব বড় বড় শহর ভূমধ্যসাগরের তীরেই অবস্থিত। অন্যান্য বেশ কিছু শহরে কক্সবাজারের মতোই সমুদ্র সৈকত আছে। ত্রিপলির তীরে বিশাল জায়গা জুড়ে বাঁধানো। শিশুদের খেলার জন্য অনেকগুলো স্লিপার জাতীয় জিনিস আছে, আছে বসার জন্য প্রচুর বেঞ্চ, একটু পর পর খেজুর গাছ, আর আছে পয় নিষ্কাশনের জন্য ভালো সুব্যবস্থা। রাতের বেলাতে আশে পাশ খুব ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম না। দূর থেকে নোঙর করা বিভিন্ন জাহাজের আলোগুলো দেখে এক অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল। ঠিক করলাম একবার দিনের আলোয় এখানে আসবো। পরের সপ্তাহেই আমি এবং আমার স্ত্রী আবার এসেছিলাম, দিনের আলোয় অবলোকন করেছিলাম ভূমধ্যসাগরকে। খুব ভালোও লাগেনি আবার খুব খারাপও লাগেনি। আসলে ত্রিপলি অংশটিকে কখনোই সৈকতের মতো মনে হয় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এর ভালো লাগার অংশটিই হারিয়ে গেছে।
দিনের আলোয় ভূমধ্যসাগর
ভূমধ্যসাগরের তীরে আমি আর লিসা
যাহোক রাতের আলোয় আমাদের উপমহাদেশীয় আড্ডা হয়ে উঠলো অসাধারণ। খেলাধুলা, ধর্ম, সমাজনীতি থেকে শুরু করে রাজনীতিও পর্যন্ত চলে এলো সেই আড্ডায়। হলো অনেক তর্ক বিতর্ক, কিন্তু কোনো তর্কই আমাদের উপমহাদেশের মতো যুদ্ধংদেহী হলো না! অবশেষে রাত প্রায় বারোটার দিকে আমরা খাওয়ার আয়োজন শুরু করলাম।
ভূমধ্যসাগরের তীরে রাতের খাওয়
খেতে খেতে এবং গল্প করতে করতে কখন যে রাত দু’টো বেজে গেলো! পাঁচটি কারে করে আবার গারিয়ানের দিকে যাত্রা করলাম। বাসায় এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে দিতে রাত প্রায় চারটা। অসাধারণ একটা দিন কেটেছিলো সেদিন, আজো যা ভুলিনি।
(এই লেখাটি ২১শে ডিসেম্বর, ২০১২ সালে দৈনিক যুগান্তরের 'যেতে যেতে পথে'- এ একই শিরোনামে প্রকাশিত, এবং আমার ধারাবাহিক লেখা 'লিবিয়ার পথে পথে' থেকে কিছুটা নেওয়া)
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১১:৪৭