সে অনেক অনেক দিন আগের কথা, তখনো পৃথিবীর বয়স খুব কম। প্রমিথিউস অবশ্য ততদিনে মানব জাতির জন্য স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে এনেছিলেন। এই গল্প সেই সময়ের গল্প।
সেই সময়ে দুইজন শিকারী জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। আসলে বলা ভালো, বেশ কিছুদিন যাবত তারা একটি হরিন শিকারে ব্যস্ত। হরিনটির পিছু ধাওয়া করতে করতে একসময় হরিনটিকে আর দেখা গেলো না, কিন্তু ততক্ষনে তারা গ্রাম থেকে অনেক দূরে চলে এসেছেন। আর সূর্যও পশ্চিমাকাশে ডুবে গিয়েছিলো, শুরু হলো অন্ধকার রাত্রি। সেই রাত্রিটি ছিলো নিকষ কালো অন্ধকার এবং বিষন্ন। কিন্তু শিকারী দুইজন লক্ষ্য করলেন, পশ্চিমাকাশে কিসের যেনো উজ্জ্বল আলো দেখা যাচ্ছে!
“এটা অবশ্যই চাঁদ”, একজন বলে উঠলেন।
“না”, অন্যজন প্রতিবাদ করে বললেন, “আমরা অনেক অনেক রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে অসম্ভব সুন্দর গোলাকার চাঁদ দেখেছি, মুগ্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে ছিলাম। এটা সেই চাঁদ নয়। এটা কি উত্তরের আলো?”
“না, এটা দেখতে উত্তরের আলোর মতো লাগছে না, আর উত্তরের আলো পশ্চিমাকাশে দেখা যাবে কেনো? ধূমকেতুর মতোও মনে হচ্ছে না। কি হতে পারে এটি?”
শিকারী দুইজন চিন্তায় পড়ে গেলেন, একটু একটু করে ভয়ও পেতে শুরু করলেন। মনে হচ্ছে কোনো বহ্নিশিখা আকাশের দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, অনেকটা উইগওয়ামে (আগেকার দিনে উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের ব্যবহৃত পশুর চামড়া বা মাদুর দিয়ে তৈরী কুটির বা তাঁবু) আগুন লাগলে শিখা যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে! শিখা থেকে আবার নীল, ঘন ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেনো আকাশের তারাকে আঘাত করছে।
“শিখা আর ধোঁয়া কি বড় আত্মার উইগওয়াম থেকে আসছে?” শিকারীদের একজন জানতে চাইলেন।
“আমি ভয় পাচ্ছি, বড় আত্মা তাঁর সন্তানদের উপর বোধহয় ক্ষুদ্ধ হয়েছেন। এই শিখা আর ধোঁয়া মনে হচ্ছে তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ,” ফিসফিসিয়ে আরেকজন বললেন। শিকারী দুইজনের কারো দুই চোখের পাতা এক হলো না- ভয়ে আর আতংকে। সারা রাত তারা অবাক হয়ে আলোর খেলা দেখতে লাগলেন আর অপেক্ষা করতে লাগলেন ভয়ংকর কিছু ঘটার।
যখন অন্ধকার কেটে সূর্য চলে এলো আকাশে, তখনো দুই শিকারী সেই আলোর দিকে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে তারা দেখতে পেলেন পশ্চিম দিকে এক বিশাল পাহাড় আছে এবং সেখান থেকেই এই বহ্নিশিখা আর নীলাভ ধোঁয়া বের হচ্ছে। “চলো,” একজন শিকারী বলে উঠলেন, “আমরা কাছে গিয়ে ভালোভাবে দেখে আসি”।
তারা হাঁটতে লাগলেন, হাঁটতে থাকলেন পাহাড়ের একদম কাছে না পৌঁছা পর্যন্ত। তারা দেখতে পেলেন, আগুন আসছে পাহাড়ের শীর্ষে থাকা পাথরগুলোর সন্ধিমুখ থেকে। “এই আগুন পাহাড়ের আগুন!”, ফিসফিসিয়ে একজন বললেন, “আমরা কি আরো কাছে যাবো?” “যাবো,” জবাব দিলেন আরেকজন শিকারী, এবং তারা পাহাড়ের উঁচু থেকে উঁচুতে উঠতে লাগলেন। অবশেষে তারা পাহাড়টির শীর্ষে উঠলেন। “এখন আমরা এই আগুনের রহস্য জানি,” স্বস্তি ভরা কন্ঠে তারা বললেন, “গ্রামবাসীরা যখন শুনবে, তখন খুব খুশি হবে”।
খুব দ্রুতই তারা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গ্রামের দিকে চললো। “আমরা এক বিস্ময় খুঁজে পেয়েছি,” তারা চিৎকার করে বলতে লাগলো, “আমরা আগুন আত্মার বাড়ি খুঁজে পেয়েছি। আমরা এখন জানি আগুন আত্মা কোথায় তার শিখা বড় আত্মা ও তাঁর সন্তানদের সাহায্য করার জন্য রেখেছেন- আগুনের পাহাড়! এটা আগুনের পাহাড়ে তিনি রেখেছেন, সেখান থেকে দিনে রাতে প্রতিনিয়ত নীল ধোঁয়া বের হচ্ছে, আর পাহাড়ের বুকের মধ্যে আছে অগ্নিগর্ভ সাগর- যেখানে রক্ত বর্ণ শিখা অবিরত লাফাচ্ছে আর নাচছে। তোমরা আসো আমাদের সাথে এবং দেখো এই অসাধারণ সুন্দর আগুনের পাহাড়কে”।
সেই সময়ে ছিলো প্রচন্ড শীত। গ্রামের মানুষেরা প্রতি রাতে ঠান্ডায় জমে যেতো, প্রমিথিউস মানুষকে আগুন এনে দিলেও, সেই গ্রামে কোনো আগুন ছিলো না। “ও আমার শিকারী ভাইয়েরা! তোমাদের উপর বড় আত্মার আশির্বাদ পড়ুক,” গ্রামবাসীরা আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “আমরা এখন থেকে সেই যাদুময় পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে বসবাস করবো। আমরা আমাদের বাড়িগুলোকে পাহাড় থেকে উদ্গীরত শিখার ছটায় গরম রাখতে পারবো, তাহলে আমরা আর দীর্ঘ শীত আর লম্বা ঠান্ডা রাতকে ভয় পাবো না!”
তাই গ্রামবাসীরা আগুন পাহাড়ের পাদদেশে গেলেন বসবাস করার জন্য। যখন ঠান্ডা রাত শুরু হলো, তারা বলে উঠলেন, “আমাদের এখন আর ঠান্ডা লাগছে না। আগুন আত্মার সাথে আমাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। তিনি আমাদেরকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করছেন”।
এরপর অনেক, অনেক চাঁদ রাত পেরিয়ে গেলো। গ্রামবাসীরা এবং তাদের বাচ্চারা শীতে আর কাবু হলো না। এক সময় শীত চলে গেলো, গ্রীষ্ম এলো। তারপর এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বাচ্চারা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে সেই আলো দেখতে দেখতে, হঠাৎ করে এক বাচ্চা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা, এই শিখা কিভাবে তৈরী হলো?” বাবা বললেন, “এই পাহাড় হলো আগুনের আত্মার বাড়ি, যিনি আমাদের খুব ভালো বন্ধু। এই শিখা তিনিই তৈরী করেছেন”।
সব বাচ্চারা আশ্বস্ত হয়ে রাতে ঘুমাতে গেলো এবং সকাল না হওয়া পর্যন্ত ঘুমিয়েই থাকলো।
কিন্তু সেই রাতে সবাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, পাহাড়ের মধ্যে আগুনের শিখা হঠাৎ করেই ফুর্তি করা শুরু করলো। আগুনের ফুলকিগুলো পাহাড়ের বুকের মধ্যে থাকা আগুনের সাগরের উপর দিয়ে নাচতে শুরু করলো, যুদ্ধ শুরুর নাচের মতো মাতাল নাচ। বড় বড় পাথরখন্ডগুলোকে জাপটে ধরে আদিম, বন্য উল্লাসে আকাশ পানে ছুড়তে লাগলো। যে নীলাভ ধোঁয়া শিখার উপরে থাকতো, সেটা কেমন যেনো লালচে বর্ণ ধারণ করতে লাগলো, সেই লালচে ধোঁয়ায় আকাশের তারাগুলো যেনো সব লুকিয়ে পড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আগুন পাহাড় যেনো হঠাৎ করেই ধড়াস ধড়াস শুরু করলো, অজানা আতংকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো। আগুনের ফুলকিগুলো নাচতে নাচতে উঁচুতে, আরো উঁচুতে উঠে গেলো। এক সময়, তারা পাথরগুলোর সন্ধিমুখ থেকে বাইরে বেড়িয়ে এলো, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ধেয়ে আসতে লাগলো ঘুমন্ত গ্রামবাসীদের দিকে, যেনো লালচে আগুনের প্রবল স্রোতস্বিনী, প্রবল খরস্রোতা নদীর মতো।
ঠিক তখনই অসহায় কন্ঠে আগুন আত্মা তার শিখা আর ফুলকিগুলোকে অনুরোধ করতে লাগলো, “ফিরে দাঁড়াও। ফিরে দাড়াও আমার শিখা, ফিরে এসো আমার আগুন পাহাড়ের বুকের ভিতরে। গ্রামের মানুষেরা জানে না যে, আজ তোমরা উন্মত্ত। তারা তোমাদের এই উন্মাদনা দেখে হয়ে যাবে দিশেহারা”।
ফুলকি আর শিখা আগুন আত্মার কথায় কোনো কর্নপাত করলো না, আর আগুনের নদীও তার মতো করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সোজা নামতে লাগলো। যাত্রা পথে যত সুন্দর সুন্দর ফুল পেলো, সব ডুবিয়ে দিয়ে গেলো। বড় বড় গাছগুলোর উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলার পথে গাছগুলোকে মাটির সাথে শুইয়ে দিলো, পাখিগুলো কিচির মিচির করে তাদের বাসা থেকে উড়াল দিলো এবং ঘন আচ্ছন্ন ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে গেলো। পাহাড়ের বন্য প্রানীগুলোকেও তাড়া করলো এই উদ্দাম বেগে ছুটে চলা আগুন নদী।
অবশেষে গ্রামবাসীদের একজনের এই হুল্লোড়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে ঘুম থেকে উঠেই ঘন ধোঁয়ার গন্ধ পেলো, কানে শুনতে পেলো শিখার যুদ্ধ কান্না। সেই গ্রামবাসী লাফিয়ে দরজা খুলে দেখলেন, আগুনের উদ্দাম নদী পাহাড় লাফিয়ে তাদের গ্রামের দিকেই এগিয়ে আসছে। “ও গ্রাম বাসী, গ্রামবাসী,” চিৎকার করতে লাগলেন তিনি, “আগুন নদী আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে!” তার চিৎকারে গ্রামবাসীরা হত বিহব্বল হয়ে, ভয়ে কান্না করতে করতে গ্রাম থেকে বের হয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটে যেতে লাগলেন। কেউ পারলেন, কেউ পারলেন না। এক সময় আগুন নদী গ্রামবাসীদের ভালোবাসার ঘরগুলোকেও তার জলন্ত অঙ্গারে ডুবিয়ে দিলো, সেইসব ঘরগুলোতে তখনো ঘুমিয়ে ছিলে স্বস্তিতে ঘুমাতে যাওয়া সেইসব বাচ্চারা!
সেই দুইজন শিকারী তখন পাহাড়ের দিকে তাকালেন, তারা সবকিছুই দেখলেন এবং বিষন্ন কন্ঠে বলে উঠলেন, “পাহাড়ে আর কোনো ফুল নেই! আর কোনো পাখির গান আমরা শুনছি না! কোনো জীবিত প্রানী আমরা দেখছি না! শুধু দেখছি বিশাল এক রিক্ততা, শূন্যতা, হাহাকার আর বিষন্নতা। আমরা জানি সেখানে এখনো আগুন আছে, নীলাভ শিখা আবার আকাশের দিকে আগের মতো উঠে যাবে, কিন্তু আগুন পাহাড় আর কখনো আমাদের বন্ধু হবে না!”
বড় আত্মা সবকিছুই দেখলেন, তিনি শিখার প্রতি খুবই রাগান্বিত হলেন। “এই পাহাড়ের আগুনকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে,” বড় আত্মা বিড় বিড় করে বলতে লাগলেন, “এর লালচে আর নীলাভ শিখা আর কখনোই মধ্যরাতের আকাশকে আলোকিত করবে না!”
আগুন আত্মা বড় আত্মার কথায় ভয়ে কেঁপে উঠলেন, “ওহ! জগতের সকল আগুন আর আলোর পিতা!”, কেঁদে উঠলেন আগুন আত্মা, “আমি জানি, আগুনের শিখা যে কাজ করেছে তা অত্যন্ত নৃশংস। তারা সুন্দর সুন্দর ফুলগুলোকে ধ্বংস করেছে, সুন্দর সুন্দর বাচ্চাগুলোকে ডুবিয়ে দিয়েছে, কিন্তু অনেক অনেক চাঁদ সময় পর্যন্ত তারা আমার কথা শুনেছিলো, তারা ছিলো ভালো এবং শান্ত। তারা গ্রামবাসীদেরকে শীতের সময় ঠান্ডায় জমে যাবার হাত থেকে রক্ষা করেছিলো বহু চাঁদ সময় ধরে। ছোট ছোট বাচ্চারা আকাশের দিকে তাকিয়ে এর লাল আর নীলাভ শিখা দেখে নির্মল আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলো। তাই যদি আপনি আগুনকে পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেন, আপনার মানুষদের হৃদয়ই এতে ব্যথিত হবে”।
বড় আত্মা আগুন আত্মার কথা শুনলেন, কিন্তু তিনি বললেন, “আগুনকে অবশ্যই নিশ্চিহ্ন হতে হবে। সে আমার মানুষদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, ছোট ছোট বাচ্চারা এখন থেকে আগুন দেখলে ভয় পাবে; কিন্তু একসময় যেহেতু বাচ্চারা শিখাকে খুব ভালোবাসতো, তাই শিখার অদ্ভুত সুন্দর রংগুলি বেঁচে থাকবে- শুধুমাত্র তাদের হৃদয়কেই আনন্দে পরিপূর্ণ করার জন্য, যারা তার দিকে তাকাবে”।
তখন বড় আত্মা তাঁর যাদুর লাঠি দিয়ে আগুন পাহাড়কে আঘাত করলেন। পাহাড়ের উপরের ধোঁয়া দূর হয়ে গেলো, এর আগুন ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে নিশ্চল হয়ে রইলো। কিন্তু পাহাড়ের অন্ধকার এবং বিষন্ন বুকে একটি মাত্র ছোট শিখা তখনো ছটফট করছিলো। এটাকে দেখতে আকাশের তারার মতো লাগছিলো। কী অদ্ভুত সুন্দর এই ছোট্ট শিখাটি!
বড় আত্মা এই ছোট শিখাটির দিকে তাকালেন। তিনি এর অপরূপ সৌন্দর্য এবং শান্ত ছটফটে ভাব দেখে মুগ্ধ হলেন, তিনি ভালোবেসে ফেললেন এই ছোট্ট শিখাটিকে। “পাহাড়ের আগুনকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে,” বললেন বড় আত্মা, “কিন্তু তুমি ছোট্ট, শান্ত শিখা তোমার গায়ে সুন্দর পাখির ডানা পাবে এবং এই নিষ্ঠুর আগুন থেকে অনেক দূরে চলে যাবে, এবং ছোট ছোট বাচ্চারা তোমাকে দেখে ভালোবাসবে, যেভাবে আমি ভালোবেসেছি”।ঠিক তখনই ছোট্ট শিখাটি পাহাড় থেকে উপরে উঠে গেলো এবং সূর্যালোকের দিকে উড়াল দিলো। শিখার আলোটি এখনো তার মাথায় আছে, আছে অদ্ভুত সুন্দর রং- তার অদ্ভুত সুন্দর ডানায়।
এভাবেই আগুন পাহাড়ের বুকের আগুন থেকে উঠে এসেছে পৃথিবীর প্রথম হামিংবার্ড। হামিংবার্ড- শিখার পাখি, যেহেতু শিখার সব সুন্দর রংগুলো এর ডানায় আছে, কিন্তু খুব শান্ত পাখি এবং পৃথিবীর প্রত্যেক শিশুই একে খুব ভালোবাসে এবং মুগ্ধ হয় যখন এটা ফুলের উপর ডানা ঝাপটাতে থাকে।