আমি একজন সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ মানুষের যত অসাধারণত্ব, সবকিছুই ব্লগিং করতে এসে অর্জন করা। একসময় নিজেকে ব্লগার পরিচয় দিতে খুব গর্ববোধ করতাম। এই গর্বটা এভারেষ্ট-এর উচ্চতায় উঠে গিয়েছিলো শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম দিকে। ফেসবুকে আর ব্লগে লিখে কি করা যায়- তা যেনো দেখিয়ে দিতে লাগলাম আমরা। নতুন কারো সাথে পরিচয় হলে আগ বাড়িয়ে বলতাম, আমি একজন ব্লগার। আমার ডাক্তার পরিচয়টা বেমালুম ভুলে যেতাম। আর এখন? বেশ কিছুদিন যাবত আমি যে ব্লগার, সেই পরিচয়টাই ভুলে যেতে চাচ্ছিলাম। আর লিখবো না, লিখবো না বলে- কেনো যে আজ আবার লিখতে বসলাম!
(১)
শাহবাগে যে অবস্থান ধর্মঘট রাজাকার কাদের মোল্লার রায়ের পর শুরু হয়েছিলো, সত্যি কথা বলতে গেলে তখন আমি ইমরান সরকারের নামও জানতাম না। অথচ তিনি একজন ডাক্তার, আর আমিও ডাক্তার! অবশ্য সব ডাক্তারের পক্ষে সবাইকে চেনা সম্ভব নয়, তাই না? খুব খুশি হয়েছিলাম, একজন ডাক্তারকে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে দেখে। হৃদয়ের দাবীর সাথে শাহবাগের দাবীর মিল দেখে একাত্মতা অনুভব করলাম। চাকরীর জন্য থাকতাম চাঁদপুরের মতলবে, কিন্তু মন পরে থাকতো শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে। টিভিতে দেখতাম ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে মুখরিত প্রজন্ম চত্বর। খুব ভালো লেগেছিলো- এই শ্লোগানের নতুন করে জন্মে। কিন্তু মনের গহীনে চিন চিন করে উঠলো- ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ যে নাই! বুঝতে পারলাম- এটাকে দলীয় শ্লোগান বলে বর্জন করা হয়েছে। অথচ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলেই একাত্তরে সবাই যুদ্ধ করতে গিয়েছিলো, তখন দলীয় শ্লোগান মনে হয় নি। মানি, এই ব্যর্থতা আওয়ামী লীগেরই, তারাই বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ করেছে। ভেবেছিলাম এতে যদি বিএনপিও সমর্থন দেয়, তাহলে এই ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বর্জন হজম করা যাবে। কিছু ছাত্রদল সমর্থক বা নেতাদের শাহবাগে দেখে আশান্বিতও হয়েছিলাম। বিএনপির নেতাদেরও বেশ কিছুদিন নিশ্চুপ থাকার পর আন্দোলনের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখে আশায় বুক বেঁধেছিলাম।
মানুষ ভাবে এক, কিন্তু হয় আরেক। আরেকবার বিশাল ঢাক্কা খেলাম মহাসমাবেশে ইমরান সরকারের বক্তব্য শুনে। এ কি! এটাতো কোনো নেতার ভাষন নয়! ইমরানের আশে পাশের লোকগুলোকে দেখেও আশাহত হলাম। জানলাম, তিনি না কি স্বাচিপের নেতা! তবুও সবকিছু মেনে নিলাম প্রাণের দাবীর জন্য।
(২)
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনেকের কথা শুনতে লাগলাম। অনেক নেতা, অ-নেতা অনেক রকম কথা বলতে লাগলো। কেউ কেউ বলে উঠলো, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিষিদ্ধ চাই। তারা ভুলে গেলেন কিসের বিরুদ্ধে তারা লড়তে শাহবাগে জড়ো হয়েছেন। আমার মতো যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পছন্দ করি না, তারা প্রমাদ গুণলাম, কারণ- এতে আমও যাবে, ছালাও যাবে- কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। যুদ্ধে খুব কৌশলী হতে হয়, কিন্তু শাহবাগের নেতারা দেখলাম অন্যের পরামর্শে চলতে লাগলো। জনগন কি চায়, প্রজন্ম কি চায়- সেদিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। আর তাই শাহবাগের আন্দোলনকারীদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই নেতারা হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন- শাহবাগে টানা অবস্থান থেকে সরে আসার। সেদিন রাতেই খুন হলো রাজীব।
শাহবাগের নেতারা অসাধারণ এক অস্ত্র তুলে দিলেন এবার জামাত-শিবিরের হাতে। সামনে চলে এলো আস্তিক-নাস্তিক বিষয়। ফেসবুক, ব্লগে বিশাল বিশাল গবেষনা হলো নতুন বানানো ব্লগের লেখাগুলো রাজীবের নয়। কিন্তু এতে কি প্রমান হয়ে যায় রাজীব আস্তিক ছিলো? জামাত শিবির খুব কৌশলের সাথে ব্লগারদের নাস্তিক বানিয়ে দিলো, অন্যান্য ইসলামী দলগুলোকেও একই আন্দোলনে শরিক করালো ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিষিদ্ধের ধুয়া তুলে। আমাদের পাপেট নেতা ইমরান সরকারের কৌশল চরমভাবে মার খেলো। এই আন্দোলন যে আস্তিক আর নাস্তিকের নয়- সেটা বুঝাতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেন তারা। অবশ্য নিজেদের নিরাপত্তার জন্য গানম্যান ঠিকই আদায় করে নিলেন। আর আন্দোলন হয়ে গেলো স্তিমিত। তবুও আন্দোলনের প্রতি আমার সমর্থন ছিলো, কারণ মূল দাবীতো কাগজে কলমে তখনো ছিলো জামাত শিবিরের নিষিদ্ধকরণ আর যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি।
(৩)
এই সময়ে আন্দোলনে কিছু স্ববিরোধীতা লক্ষ্য করলাম। দেখতে পেলাম আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বক্তব্য দিতে পারছেন, আবার কিছু নেতা লাঞ্চিত হচ্ছেন। বামপন্থী নেতারা আবার দেখলাম খুব ভালোভাবেই বক্তব্য দিচ্ছেন। আর ইমরানের আশে পাশে তো ছাত্রলীগের নেতারা ছিলেনই। আবার বলা হচ্ছে এই আন্দোলন রাজনীতিবিদদের নয়। আসলে কি বলতে হবে, কি করতে চাচ্ছে- শাহবাগের নেতারা কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনাই দিতে পারছিলো না। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দাবীদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীসভার সভাতে মন্ত্রীদের বেফাঁস মন্তব্যের জন্য তিরস্কার করলেন। সেই বেফাঁস মন্তব্য কি? অচিরেই জামাত শিবির নিষিদ্ধ হবে।
আমরা তখনই প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য বুঝে গেলাম। তিনি জামাত নিয়ে ভোটের খেলা খেলছেন। ইমরান সরকারও একটি বালকসুলভ খেলা খেললেন- আল্টিমেটাম দিলেন ২৬শে মার্চের মধ্যে জামাতকে নিষিদ্ধের। কিন্তু চাপে রাখার জন্য সেরকম কোনো কর্মসূচী দিলেন না, মুখে ঝুলে রইলো মহাত্মা গান্ধীর সেই মহান বানী, বর্তমান যুগে যা অচল- ‘অহিংস আন্দোলন’।
(৪)
এক সময়ের আপোষহীন নেত্রী খালেদা জিয়া বিদেশ থেকে এসেই শাহবাগের আন্দোলনের বিরুদ্ধে বলা শুরু করলেন। উনাকে ধন্যবাদ- উনি উনার স্ট্যান্ট জাতির কাছে স্পষ্ট করেছেন। উনি পরিষ্কারভাবেই সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে জানিয়ে দিলেন, তিনি জামাতকে ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিন্তু সেই সাহস দেখালেন না। তাই ২৬শে মার্চের মধ্যে জামাত শিবির নিষিদ্ধ হলো না। আমাদের পরম নেতা ইমরান সরকার ঘোষনা দিলেন, এবার প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিবেন। আমার কাছে মনে হলো প্রধানমন্ত্রী বরাবর তার আসনে সংসদ নির্বাচনের জন্য আবেদন করলেন।
আন্দোলনের মাঝে এক চমৎকার ঘটনা ঘটেছিলো। ইমরানের দাদা যে রাজাকার তা নিয়ে রাজাকার পত্রিকা তথ্য উপাত্ত হাজির করলো। আমরা ঝাপিয়ে পরলাম ইমরানের দাদাকে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে। আমাদের কিছু ব্লগার নেতা বললেন, দাদা কি কাজ করলো, সেটা বড় কথা নয়, ইমরান কি কাজ করছে- সেটাই সবচেয়ে বড় কথা। আমরা হাততালি দিলাম।
২৬শে মার্চ রাত থেকে শহীদ রুমী স্কোয়াডের কিছু ছেলে জামাত নিষিদ্ধের দাবীতে আমরণ অনশন শুরু করলেন। আমাদের সেই ব্লগার নেতারাই আবার বললেন, এদের মধ্যে কে যেনো বঙ্গবন্ধু খুনী বজলুল হুদার সন্তান, তাই এই অনশনে তাদের সমর্থন নেই। আমাদের সুশীল সমাজও বোধহয় সমর্থন দিলেন না, তাই অনশনের ১০০ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও কোনো সমাজসেবক অনশন ভাঙ্গাতে পানির গ্লাস হাতে এগিয়ে এলেন না। ব্লগে, ফেসবুকে আমরা এই অনশনকারীদের চৌদ্দগুষ্ঠির উদ্ধার করতে লাগলাম।
(৫)
আর কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে না। যে আশা নিয়ে, যে উদ্দীপনা নিয়ে শাহবাগ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো, তার অবশিষ্ট আর কিছু নেই। কয়েকদিন আগে কাকে যেনো বলেছিলাম, আমি ব্লগে লিখি। তার তৎক্ষনাত প্রতিক্রিয়া ছিলো, “ও, তুমি তাহলে নাস্তিক!” শাহবাগের আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে লাভ হলো আমাদের-
- নাস্তিক উপাধি পেলাম
- সরকারকে ব্লগ আর ফেসবুকে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিলাম
- শহীদ রুমী স্কোয়াডের অনশনকে উপহাস করে আজ অমানুষও হলাম
নিজেকে তাই এখন আর ব্লগার পরিচয় দিতে খুবই লজ্জা লাগে। মনে মনে বলি, ছি! আমি একজন ব্লগার!
পরিশিষ্টঃ
এই লেখাটা চরম হতাশা নিয়ে লেখা। আসলে শাহবাগের প্রারম্ভে যে প্রবল উচ্ছ্বাস ছিলো, আশা ছিলো- তার কোনোটারই আর দেখা পাচ্ছি না। পাপেট নেতারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছে, খালেদা জিয়া তার সম্পর্কে ধারনাটাকে আরো পাকাপোক্ত করেছেন, শেখ হাসিনা তার মুখোশটাকে খুলে ফেলেছেন, আমরা ব্লগাররা যেভাবে একতাবদ্ধ হয়েছিলাম, সেখানে এখন কেবলই অনৈক্য আর বিশৃঙ্খলা। কোনো সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই, নেই কোনো কান্ডারী।
আমরা সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা চাই, শক্ত মেরুদন্ডের নেতা চাই, সকল যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসি চাই, জামাত শিবিরের নিষিদ্ধ চাই, জামাত শিবিরের সকল প্রতিষ্ঠানের বর্জন চাই। কেউ কি আছেন আশার বানী নিয়ে কোনো লেখা লিখবেন, আমাদেরকে আবার উদ্দীপিত করবেন?
(পুনশ্চঃ যে কাজটা করা উচিত ছিলো গণজাগরন মঞ্চ থেকে, সেই কাজটা করছে শহীদ রুমী স্কোয়াড। স্যালুট তাদেরকে।)