somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার দেখা শান্তিনিকেতন

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দুপুর ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শান্তি নিকেতন নামটির মধ্যেই মনে হয় শান্তি শান্তি ভাব আছে। শুধু নামে নয়, সেই জায়গাতে গেলেও মনে শান্তি শান্তি ভাব লাগে। অবশ্য আমার শান্তি নিকেতনে যাওয়াটাই ছিলো অদ্ভুতভাবে। বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমার উদ্দেশ্যে দার্জিলিং যাবো ঠিক করেছিলাম। বিধাতা বোধহয় মুচকি হাসছিলেন। বেনাপোল, পেট্রাপোল, বনগাঁ হয়ে কলকাতা পৌঁছে শুনি পাহাড় ধ্বসে দার্জিলিং- এ যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। ঠিক তখনই নিরুপায় হয়ে শান্তি নিকেতনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। কিন্তু শান্তি নিকেতনে এসে মনে হলো বিধাতা যা কিছু করেন ভালোর জন্যই করেন।

হাওড়া রেলস্টেশন থেকে সকালেই ট্রেনে করে বোলপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ইলেক্ট্রিক ট্রেনে করে বোলপুরে যেতে যেতে শান্তি নিকেতনের ইতিহাস কিছুটা বলি। কলকাতা থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বীরভূম জেলার বোলপুর পৌর শহরের শান্তি নিকেতন অঞ্চলটি একসময় জমিদার ভুবন সিংহের নামানুসারে ভুবনডাঙ্গা নামে পরিচিত ছিলো। এই সিংহ পরিবারের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো। একবার তিনি নিমন্ত্রণ রক্ষায় সেখানে গেলে ভুবনডাঙ্গায় রাত হয়ে যায়। সেদিন আবার জ্যোৎস্না ছিলো আর ছিলো মাঠের মধ্যে একটি ছাতিম গাছ। এই নৈসর্গিক দৃশ্যে অভিভূত হয়ে ১৮৬৩ সালের ৩১শে মার্চ তিনি কুড়ি বিঘা জমি পাঁচ টাকায় পাট্টা নিলেন। সেখানেই তিনি শান্তি নিকেতন নামে গৃহটি তৈরী করেন।

১৮৮৮ সালের ৮ই মার্চ দেবেন্দ্রনাথ ট্রাস্টি চুক্তির মাধ্যমে শান্তি নিকেতনকে সবার জন্য উন্মুক্ত করেন। এরপর এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০১ সালে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও এর উদ্যোক্তা ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন ব্রক্ষ্মবান্ধব উপাধ্যায় আর ছাত্র হিসেবে ছিলেন গৌরগোবিন্দ গুপ্ত, প্রেমকুমার গুপ্ত, অশোককুমার গুপ্ত, সুধীরচন্দ্র, গিরিন ভট্টাচার্য, যোগানন্দ মিত্র, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় এখানে ১৯২১ সালে বিখ্যাত বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

যা হোক, ইতিহাস পাঠের মধ্যেই প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার যাত্রায় অবশেষে বোলপুরে এলাম। ট্রেন থেকে স্টেশনের বাইরে এসেই কেমন যেনো রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ গন্ধ পেলাম। প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। শহরের প্রবেশ পথেই এক বিশাল তোরণ, যেনো আমাদের স্বাগত জানাচ্ছেঃ

"আমাদের শান্তিনিকেতন, সে-যে সব হতে আপন
তার আকাশ ভরা কোলে, মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন।।"

এক রিকশাচালক আমাদের সামনে এসে বললো চারশত টাকা দিলে সে আমাদেরকে পুরো শান্তি নিকেতন ঘুরে দেখাবে। এলাকার রিকশা ভাড়া সম্পর্কে অজ্ঞাত আমরা খুব সহজেই এই প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম। প্রথমেই থাকার জন্য হোটেলে রুম বুকড করতে গেলাম। অনেক হোটেলের ভীড়ে যে হোটেলে আমরা গেলাম, সেটার নামও শান্তি নিকেতন লজ। রুমে ব্যাগ রেখে এবার আমরা শান্তি নিকেতন ভ্রমণে বের হলাম।

সবার আগে এলাম উত্তরায়ন কমপ্লেক্সে। কয়েকটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কমপ্লেক্স- উদয়ন,কোনার্ক,শ্যামলী,পুনশ্চ এবং উদিচী। সময় পেলই এই ভবনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসে থাকতেন । তাঁর অসংখ্য কালজয়ী লেখা এখানেই সৃষ্টি হয়েছে । এখানে আবার ছবি তোলা নিষেধ, ভিতরে ঢুকতে গেলে ক্যামেরা রেখে দেয়। তবুও মোবাইল ক্যামেরায় লুকিয়ে কিছু ছবি তুলে ফেললাম। এর পরে আছে বিচিত্রা বা রবীন্দ্র ভবন। এই ভবনের নকশা করেছিলেন কবি পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।এই জায়গাটা অনেকটা মিউজিয়ামের মতো। মুগ্ধ নয়নে কবির ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামগ্রী, পেইন্টিং ইত্যাদি দেখে একটু সামনে এগোতেই দেখতে পেলাম উপাসনা গৃহ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৩ সালে উপাসনা গৃহ ভবনের প্রতিষ্ঠা করেন ।রঙীন বেলজিয়ান কাঁচ এবং মার্বেল পাথরে চারদিক অলংকৃত এই ভবনটিতে সন্ধ্যার সময় অসংখ্য মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হলে এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হয়। এরপর গেলাম শান্তিনিকেতন গৃহে। শান্তি নিকেতন গৃহ হচ্ছে শান্তিনিকেতনের সবচেয়ে পুরানো ভবন ।আরো দেখলাম দুইতলা একটি বাড়ি, নাম দেহলী। দেহলীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সাথে বসবাস করতেন ।

এরপরেই দেখলাম কালো বাড়ি। কালো বাড়িটি মাটির তৈরী, দেয়ালে বিভিন্ন কারুকাজ করা। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল বর্ষের ছাত্ররাই সাধারণত এখানে থাকে। ঘুরলাম ছাতিমতলা। দেখলাম কীভাবে কোন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটদের সমাবর্তন হয়। সমাবর্তনে স্নাতকদের সপ্তপর্ণী গাছের পাঁচটি পাতার গুচ্ছ উপহার দেওয়া হয় ।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজরিত এইসব দেখতে দেখতে কখন যে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া শুরু করলো টেরই পাই নি। দ্রুতই একটি রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে চড়া দামে কিছু খেয়ে নিয়েই আমার গিন্নী দৌড়ালেন এখানকার রাস্তার দুধারে সারি সারি করে গজিয়ে উঠা হ্যান্ডিক্রাফটসের দোকানগুলোতে। নিজের জন্য, আমার জন্য, দেশে থাকা আরো অনেকের জন্যই অনেক কিছু কিনে ফেললো। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম কোথাও স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে গেলে মানিব্যাগটাকে কখনোই ভারী করে নেওয়া যাবে না!

এবার হয়ে এলো সন্ধ্যা। সন্ধ্যার শান্তি নিকেতন আবার সম্পূর্ণ অন্যরুপ। সেই রুপের বর্ণনা দেবার সাধ্য বিধাতা আমায় দেননি। দেশে থাকতে শান্তি নিকেতনের বিভিন্ন উৎসবের কথা শুনেছিলাম- রবীন্দ্রজয়ন্তী, বসন্ত উত্সব,বর্ষামঙ্গল,শরতউত্সব,নন্দনমেলা , পৌষমেলা, মাঘমেলা ইত্যাদি। আমরা যে সময়টাতে গিয়েছিলাম, সেই সময়ে অবশ্য কোনো উৎসবের দেখা পাই নি। তখন মনে হয়েছিলো হয়তোবা আবার কখনো এই উৎসবগুলি দেখার জন্যই আবার শান্তি নিকেতনে আসবো।

পরেরদিন সকাল বেলায় আমরা গেলাম শান্তি নিকেতন থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ডিয়ার পার্কে। নাম শুনে ভেবেছিলাম প্রচুর হরিন দেখতে পাবো, ততটা দেখতে না পেলেও প্রকৃতির অপরুপ শোভায় যেনো বিমোহিতই হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কখন যে ট্রেনের সময় হয়ে গিয়েছে খেয়ালই করিনি। যখন খেয়াল হলো, দ্রুত রেল স্টেশনে আসতে গিয়ে আরো অনেক কিছুই দেখা হয়নি ভালোভাবে। ট্রেনে করে যখন আবার হাওড়ার উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম, মনে মনে বললাম- আমি আসবো, আবার আসবো, তোমাতে হারিয়ে যেতে, হে প্রিয় শান্তি নিকেতন!


( আমি এখানে কোনো ছবি এড করতে পারছি না। কেউ কি আমাকে বলতে পারবেন কেনো এমন হচ্ছে? ছবিগুলো দেখার জন্য এখানেঃ Click This Link আসুন)

( এই লেখাটি ৮ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩-এর দৈনিক যুগান্তরের 'যেতে যেতে পথে'- এ প্রকাশিত- আমার দেখা শান্তিনিকেতন )

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×