আমি বোধহয় কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমায় অথবা সবকিছুর প্রতিক্রিয়া বোধহয় একটু দেরীতে দেখাই। এর কারণ কি- সেটা নিয়ে ভেবেছি। দেখলাম অনেক সময় খবর দেরীতে আমার নজরে আসে, তখন আর প্রতিক্রিয়া দেখাতে ইচ্ছে করে না, অথবা অনেক সময় খবরটা জেনেও অন্য অনেকের প্রতিক্রিয়া পড়ে আর নিজেরটা জানাতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু আজ যে কি হলো! কিছু নতুন পুরানো খবরের অনুভূতি জানাতে কেনো মনটা এতো আনচান করছে
(১)
গত দুইদিন ধরে একটি খোলা চিঠি বা কলাম খুব করে পঠিত হচ্ছে। চিঠিটা যে The Washington Times-এ প্রকাশিত হয়েছে, সেটা বোধহয় একটি কারণ। আরেকটি কারণ হচ্ছে এই কলামের সাথে বাংলাদেশের নাম আছে। তবে প্রধান কারণ মনে হচ্ছে – এর লেখিকা। তিনি আর কেউ নন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, বর্তমানে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, যাকে আমরা আপোষহীন নেত্রী বলে অনেক আগে থেকেই জানতাম- বেগম খালেদা জিয়া।
লেখাটির অনেক ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়া পড়েছি, পড়েছি মূল লেখাটাও। একই সাথে মাথায় এসেছে অনেক চিন্তাও। লেখায় কি আছে, সেটা নিয়ে আলোচনায় যাবো না, আপনারা এখান থেকে পড়ে নিতে পারেন। আমি শুধু আমার চিন্তাগুলিই শেয়ার করতে চাই।
আমার জেনে খুব ভালো লাগছে বেগম খালেদা জিয়ার লেখার ব্যপ্তি বাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে মার্কিন মুলুক পর্যন্ত পৌঁছেছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার বাসসের মাধ্যমে একটি লেখা কিছু অনলাইন পত্রিকা এবং ব্লগে এবং জাতীয় পত্রিকায় দিয়েছিলেন। তিনি বেশ কিছু বইও লিখেছেন। কিন্তু আমার জানা নেই তাঁর কোনো লেখা আমেরিকার মেইন স্ট্রীমের কোনো পত্রিকায় এসেছে কি না। সেদিক দিয়ে খালেদা জিয়া প্রশংসার দাবীদার। আরো একটি ব্যাপারে খালেদা জিয়া প্রশংসা দাবী করতেই পারেন, সেটি হচ্ছে- অসম্ভব সুন্দর ইংরেজী লেখার জন্য। তাঁর সম্পর্কে আমার পূর্ব ধারণাটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। দুর্মূখেরা বলে থাকেন তিনি না কি ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তারা যে কত মিথ্যা কথা বলেন, এই সুরচিত লেখাটাই তার প্রমাণ।
আরেকটি চিন্তা আমার মাথায় এসে ভর করেছে। আসলে চিন্তা নয়, তিনি একটি জিনিস জাতির কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছেন। দেশে চলমান যুদ্ধপরাধী ট্রাইবুনাল সম্পর্কে তাঁর অভিমত। আগে অনেকেই এটা নিয়ে ফিসফাস করতেন, তিনি আর সে সুযোগ দিতে চাইলেন না। তিনি এই কলামের মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন তিনি যুদ্ধপরাধীদের বিচার চান না, তিনি গোলাম আযম, নিজামী, সাইদী, বাচ্চু, সাকা চৌধুরী গংদের বিচার চান না- মুক্তিযুদ্ধের সময় এই হায়েনাদের ভূমিকা যতোই অপরাধমূলক হোক। অসংখ্য ধন্যবাদ বেগম খালেদা জিয়া, আপনার মনের কথাটি এতো সুন্দরভাবে অকপটে বলার জন্য। আমার একটি পূর্ব ধারণা ছিলো, বিএনপির জন্ম জলপাই উর্দি থেকে হলেও, বিরোধীরা তাদেরকে স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি না বললেও- বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি নয়। আমার এই ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার জন্যও খালেদা জিয়ার ধন্যবাদ প্রাপ্য।
ওহ হো! আরেকটি ভ্রান্ত ধারণার অবসান করেছেন খালেদা জিয়া। ৮৬- এর নির্বাচনে অংশগ্রহন না করে যে আপোষহীন ভাবমূর্তি তিনি গড়ে তুলেছিলেন, ১৫ই ফেব্রুয়ারীর নির্বাচন দিয়ে (এরপর নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস করে) যে ভাবমূর্তিকে তিনি আরো বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, সামরিক শক্তি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বিদেশে না গিয়ে যেটাকে তিনি এভারেষ্টসম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই ভাবমূর্তি যে নিছকই একটা মিথ- সেটা তিনি এই খোলা চিঠিই বলেন আর কলামই বলেন, এর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। আমরা এখন আশায় আশায় আছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা বিশ্ব তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষায় এগিয়ে আসবেন এবং বাংলার আপোষহীন নেত্রীকে আবার আপোষহীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন।
এই বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই।
(২)
পুরানো একটি ব্যাপার নিয়ে একটু কথা বলতে চাই। প্রসঙ্গ- বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি। আমি ফেসবুকে একটি স্টাটাস দিয়েছিলাম, সেটিই এখানে আবার দিচ্ছি (শুধুমাত্র রেকর্ড থাকার জন্য)-
“আজ সারাদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম। দিনের ক্লান্তি শেষে রুমে এসে কিছুক্ষন আগে যখন ল্যাপটপ খুলে বসলাম-- আমি বাকরুদ্ধ, শিহরিত, আনন্দিত...!
জন্মেছি আমি অনেক পরে। ৭১ এর যুদ্ধ আমি দেখিনি। যে সময়টা পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পড়ার কথা, সঠিক ইতিহাসটা তখন জানি নি। রাষ্ট্রযন্ত্রে শুনেছি অনেক অপপ্রচার। কিন্তু একজন মানুষ আমাকে ইতিহাসের পাঠ দিয়েছেন- সঠিক এবং সম্পূর্ণভাবে এবং প্রচন্ড আবেগ নিয়ে- তিনি আমার বাবা। সেই থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকার আমার দুইটি চরম ঘৃনার জন্তু।
৯১- এ রাজনীতির কিছুই বুঝতাম না, ক্লাস সিক্সে বোধহয় পড়তাম। মনে আছে, তারপরও পাড়ায় পাড়ায় নৌকা নৌকা বলে চেঁচিয়েছি- এই আশায় যে নৌকা ক্ষমতায় গেলে বিটিভিতে "শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠ" গানটি শুনতে পাবো, বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি হবে, পাকিস্তান আমাদের কাছে ক্ষমা চাইবে আর গোলাম আযমের (ছোট ছিলাম বলে তখনো নিজামী, সাইদী গংদের সম্পর্কে কম জানতাম) ফাঁসি দেখবো। সেই বছর আমার আশা পূর্ণ হয়নি!
৯৬-এ আমার প্রথম আশা পূর্ণ হলো। আর আওয়ামী লীগের এবারের শাসনামলের অনেক কাজ নিয়ে আমি সংক্ষুদ্ধ, বিক্ষুদ্ধ, আশাহত হলেও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফাঁসি হওয়াটা ছিলো আমার জন্য চরম পাওয়া।
আর আজ?
পৃথিবীবাসীকে আমি জোর গলায় বলতে পারবো আমরা যত বছরই হোক, রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের কখনো ক্ষমা করিনি, করতে পারি না। আমার সন্তানকে আমি বলতে পারবো- আমরা যেমন জাতির জনকের হত্যাকারী কুলাঙ্গারদের ফাসিতে ঝুলিয়েছি, ঠিক তেমনি জাতির বেইমান রাজাকার গোলাম আযম, নিজামী, সাইদী, সাকা, বাচ্চু গংদেরও ফাঁসিতে ঝুলানোর ব্যবস্থা করেছি। শুধু একটি কষ্টই আমার রইলো- আমার ইতিহাস পাঠের প্রথম শিক্ষক, আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবা সেটা দেখে যেতে পারলেন না।
আমার এখন আর দুইটি ইচ্ছাই আছে- আমি সবগুলোর ফাঁসি দেখে যেতে চাই, আর দেখতে চাই- পাকিস্তান আমাদের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাচ্ছে”।
(৩)
এবার একটু রাজনীতির বাইরে যেতে হচ্ছে, ইদানীং একটি গান নিয়ে খুব আলোচনা শুনতে পাচ্ছি। যদিও অনেক দেরীতে আমি গানটির ভিডিও দেখেছি এবং শুনেছি।
গানটি হচ্ছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখা ও সুর করা (যদিও মূল সুরটি শিলাইদহের ডাকপিয়ন গগন হরকরার একটি গান থেকে নেওয়া) “আমার সোনার বাংলা” ।
যেহেতু এটি রবীন্দ্রনাথের লেখা, তারমানে এটি একটি রবীন্দ্রসংগীত। এই গানটির আরো একটি বিশেষ পরিচয় আছে। সেটা হচ্ছে এটি আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
এই গানটি সাম্প্রতিককালে একটি ব্রিটিশ বাংলাদেশী ব্যান্ড দল “ক্ষ” আধুনিক যন্ত্রসহ গেয়ে ফেসবুক, ইউটিউবে আপলোড করেছে। বিতর্কের সূত্র এরপর থেকেই।
বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া বা বাজানো বা শোনা নিয়ে একটি আইন আছে, যা ‘জাতীয় সঙ্গীত বিধিমালা’১৯৭৮ নামে পরিচিত। এছাড়াও বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় প্রতীক অবমাননা (সংশোধনী) আইন ২০১০- নামেও একটি খসড়া আছে। তদুপরি, বেশ কিছুদিন আগেই মোবাইল ফোনে জাতীয় সংগীত রিং টোন হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের রায়ের উদাহরণও আছে। তাই আমার কাছে মনে হয় জাতীয় সংগীত ব্যাপারটি একটি প্রচন্ড স্পর্শকাতর বিষয়। তাই এটা নিয়ে কোনোরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করাই ভালো এবং অনুচিত (এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধও বটে)।
‘ক্ষ’ অবশ্য তাদের গানের কোথাও এটা বলেনি যে তারা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাচ্ছে। মিউজিক ভিডিওতে লেখা ছিলো- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’।
তাই আমি ধরে নিচ্ছি এটি তারা রবীন্দ্র সংগীত হিসেবেই গেয়েছে। আর যেহেতু গানটিতে অংশগ্রহনকারী কেউই বাংলাদেশের নাগরিক নয় (বোধহয় দুইজন আছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত), এবং দৃশ্যায়নও বাংলাদেশে হয় নি, আমার কাছে মনে হচ্ছে জাতীয় সংগীত সংক্রান্ত আইনগুলো এই গানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। উপরন্ত, গানটি শুরু হয়েছে দ্বিতীয় প্যারা থেকে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মেধাসত্ত্ব বিষয়টি বোধহয় মেয়াদ পেরিয়ে গেছে (আমার জানায় ভুল থাকতে পারে, কেউ সঠিকটি জানালে বাধিত হবো), তাই কেউ যদি রবীন্দ্র সংগীত ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন উপস্থাপনায় পরিবেশন করতে পারে, তাহলে ক্ষতি কি!
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের জাতীয় সংগীতের সুরটিও কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের করা আসল সুর নয় ।
আমার কাছে তাই মনে হয়েছে- ‘ক্ষ’ এর গাওয়া গানটিকে খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যে আনা উচিত হবে না। কারণ, ওদের গাওয়া গানটিকে আমি জাতীয় সংগীত হিসেবে বিবেচনাই করছি না। আর রবীন্দ্র সংগীত হিসেবে বিবেচনা করলে সোহিনী আলমের গাওয়াটা খারাপ লাগেনি, যেমন খারাপ লাগেনি কম্পোজিশনটাও।